নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন হাইকোর্টে
তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ ও তদারকিতে গঠিত ১৭ সদস্যের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স হাইকোর্টে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। টাস্কফোর্স এ বিষয়ে ২০টি সুপারিশ করেছে বলে হাইকোর্টে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। এ সংক্রান্ত এক রিটের শুনানি শেষে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের নির্দেশে গত ২৬ এপ্রিলের মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ও বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলেন হাইকোর্ট। আগামী ১৬ আগস্ট শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
আদালতে ওইদিন রিটকারীর পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী অ্যাডভোকেট সৈয়দ মহিদুল কবির ও আইনজীবী অ্যাডভোকেট সৈয়দা নাসরিন। তাদের সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনির হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল প্রতিকার চাকমা। তার সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও আবুল কালাম খান।
প্রতিবেদনে উল্লেখিত সুপারিশগুলো
ক. টাস্কফোর্স কমিটিতে বাংলাদেশ ব্যাংক নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয় এবং কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশকে (ক্যাপ) কোআপ্ট করার সিদ্ধান্ত হয়।
খ. নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের আমদানির তথ্য সংগ্রহ এবং মজুত পরিস্থিতি সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
গ. চট্টগ্রাম ও পায়রাবন্দর কর্তৃপক্ষ, স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ এবং শুল্ক স্টেশনসমূহ কর্তৃক পবিত্র রমজানের সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য খালাসের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ঘ. নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে ফেরি পারাপারে বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃক সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ঙ. পণ্য-পরিবহণ ও বাজারজাতকরণসহ যে কোনো পর্যায়ে যেন ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়ে যথাযথ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সিনিয়র সচিব জননিরাপত্তা বিভাগকে অনুরোধ করা হয়।
চ. আন্তর্জাতিক বাজারদর সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়।
ছ. রিফাইন্ড সয়াবিন/পামওয়েল তেল আমদানি বৃদ্ধি উৎসাহিত করার লক্ষ্যে শুল্ক/ভ্যাট প্রত্যাহারের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) অনুরোধ করা হয়।
জ. সিটি করপোরেশনকে নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে মাংসের মূল্য নির্ধারণের জন্য অনুরোধ করা হয়।
ঝ. ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর জেলা উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ঞ. কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ও মজুতদারির বিষয়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ট. নিত্যপণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জেলা পুলিশ কর্তৃক অগ্রাধিকার প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ঠ. পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে অতিরিক্ত মুনাফা বিষয়ে কঠোর নজরদারি বৃদ্ধির জন্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও জেলা উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ড. খুচরা পর্যায়ে মূল্যতালিকা প্রদর্শন এবং প্রতিটি ধাপে পাকা রশিদ সংরক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিতকরণে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর জেলা উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়।
ঢ. ভোজ্যতেল কেনাবেচায় পাইকারি থেকে খুচরা সব পর্যায়ে পাকা রশিদ (প্রতিষ্ঠানের নাম ও ঠিকানাসহ মুদ্রিত তথ্য) প্রধান নিশ্চিত করার জন্য ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও জেলা উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ণ. ভোজ্যতেলের মিলগেট ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ সঠিকভাবে প্রদর্শন বাস্তবায়নের জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর জেলা উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ত. অবৈধভাবে পণ্য মজুত ও বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
থ. ভোজ্যতেল পরিশোধন কাজে মিল কর্তৃক অপরিশোধিত তেল আমদানির পরিমাণ এর সাথে পরিশোধনের পরিমাণ ও পরিবেশকদের কাছে সরবরাহের পরিমাণ সামঞ্জস্য রয়েছে কি না তা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কর্তৃক নিশ্চিতকরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
দ. মিলসমূহ কর্তৃক পরিবেশক নিয়োগ সংক্রান্ত হালনাগাদ তালিকা বাংলাদেশ স্টেট অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কাছে সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ভ. ভোজ্যতেল মিলগেটে নিয়মিত তদারকির জন্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কর্তৃক যৌথ টিম মোতায়েনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, দেশীয় প্রয়োজনীয় ভোজ্যতেলের সরবরাহ স্থিতিশীল রাখার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদেয় সরবরাহ আদেশ বা এ পণ্যের একক মূল্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ-২০১১ আবশ্যিকভাবে উল্লেখ করার জন্য সব মিল মালিক/প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
দেশের ইতিহাসে ভোজ্যতেলের মূল্য একবার বৃদ্ধি পেলে তা আর কমার কোনো নজির নেই। বর্তমান সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপের কারণে বোতলের মূল্য হ্রাসের নতুন নজির সৃষ্টি হয়েছে।
প্রতিবেদনে দেশের সব সিটি করপোরেশন, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর মাঝে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে ভর্তুকি দিয়ে টিসিবি পণ্য বিক্রির চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে অভিযান-জরিমানাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরে বলা হয়, সরকারের গৃহীত কার্যক্রমের ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে, যা সব মহলে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারের অস্থিরতা গড়ায় হাইকোর্ট পর্যন্ত। সয়াবিন তেলের দাম বাড়ার ঘটনাটি উচ্চ আদালতের নজরে এনে ৬ মার্চ হাইকোর্টে রিটটি করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনির হোসেন, সৈয়দা নাসরিন, সৈয়দ মহিদুল কবীর ও মোহাম্মদ উল্লাহ।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৫ মার্চ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে বাজার অস্থিতিশীল করা অবৈধ জোটবদ্ধ (সিন্ডিকেশন) ব্যবসা বন্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে। সেই সঙ্গে দাম বাড়িয়ে বাজার অস্থিতিশীল করা দুষ্কৃতকারীদের খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনকে বলা হয়।
এ ছাড়া সয়াবিন তেল এবং পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং সেল গঠন ও নীতিমালা তৈরি নিয়ে মজুতদারদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে সিন্ডিকেটে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
রিটকারী আইনজীবী সৈয়দ মহিদুল কবির বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুতদারদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বাজার অস্থিতিশীল করা দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনকে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল রুলে।
এ ছাড়া অবৈধ জোটবদ্ধ ব্যবসা প্রতিরোধে প্রতিযোগিতা আইন, ২০১২-এর ২১ (১) ধারা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় প্রবিধান প্রণয়নে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, একইসঙ্গে চাল, ডাল, গম, চিনি, পেঁয়াজ ও ভোজ্যতেলের মতো পণ্য বিক্রির ওএমএস (খোলাবাজারে বিক্রয়) নীতিতে রেশন কার্ডের বিধান অন্তর্ভুক্ত করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, রুলে সে প্রশ্নও রাখা হয়। সেই সঙ্গে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয় রুলে।
বাণিজ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, খাদ্য সচিব, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) চেয়ারম্যান ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতিকে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়।