উৎকোচ না দেওয়ায় চাকরিচ্যুতির অভিযোগ বদলগাছীর ইউএনওর বিরুদ্ধে
নওগাঁর বদলগাছী উপজেলা পরিষদে দীর্ঘ ২৫ বছর যাবত কর্মরত এক মালিকে জোরপূর্বক চাকরিচ্যুত করে ২ লাখ টাকা উৎকোচ দাবি করার অভিযোগ উঠেছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলপনা ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে। দাবিকৃত টাকা দিতে না পারায় ৭ মাস যাবত ওই কর্মচারীর বেতন ভাতাদিও বন্ধ রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী গত ৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মন্ত্রীর একান্ত সচিব ও স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এবং রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন। এর আগে গত ২৮শে জুলাই নওগাঁর জেলা প্রশাসকের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগ করেও মেলেনি কোনো প্রতিকার। চাকরি পুনর্বহাল ও বেতন ভাতাদি পরিশোধে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এই ভুক্তভোগী।
প্রধানমন্ত্রী বরাবর লিখিত অভিযোগ ও ভুক্তভোগীর পরিবার সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের (উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রকল্প-২) অধীনে নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলা পরিষদে এমএলএসএস পদে যোগদান করেন জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলার মালঞ্চ গ্রামের রফিকুল ইসলাম।
রফিকুল ইসলাম জানান, ২০০৩ সালে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে গেলে আমি আমার পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে থাকলে তৎকালীন উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং তৎকালীন ইউএনও আমার অসহায়ত্বের কথা বিবেচনা করে স্থানীয় সরকার বিভাগের নিয়োগবিধি মোতাবেক মালি পদে নিয়োগ দেন। চাকরির সুবাদে উপজেলা পরিষদের কোয়ার্টারে সপরিবারে থাকতেন তিনি। মালির দায়িত্বের পাশাপাশি ইউএনওর বাড়িতে খাবার সরবরাহ এবং বাড়ির অন্যান্য কাজগুলোও তাকে দিয়েই করানো হতো। সবকিছু ঠিকভাবেই হয়ে আসছিল। এরই মধ্যে গত বছর ১ এপ্রিল উপজেলায় নতুন ইউএনও হিসেবে যোগদান করেন আলপনা ইয়াসমিন। যোগদানের পর মালিকে বাড়তি কাজের চাপে ফেলতে শুরু করেন। টানা তিন মাস নৈশপ্রহরী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য করা হয় মালি রফিকুল ইসলামকে। এসময় তাঁকে দিয়ে ইউএনওর বাসায় রান্নার কাজও করানো হতো। হঠাৎ সমস্যা শুরু হয় ২৭ জানুয়ারি থেকে। রাত ৮টার দিকে মালিকে বাংলোতে ডাকেন ইউএনও। বাংলোতে মালি পৌঁছানোর পর তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ এবং চাকরিচ্যুত করার হুমকি প্রদান করেন ইউএনও। এক পর্যায়ে মালির চাকরি পুনর্বহালে ২ লাখ টাকা দাবি করা হয়। পাশাপাশি মালিকে কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে না গেলে মাদক মামলায় ফাঁসানোর হুমকিও দেন ইউএনও। এরপরেও মালি কোয়ার্টার থেকে বের না হওয়ায় দীর্ঘ ৭ মাস যাবত তার বেতন ভাতাদি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে গত ২৮ জুলাই নওগাঁর জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন মালি রফিকুল ইসলাম।
ভুক্তভোগী মালি রফিকুল ইসলাম বলেন, বর্তমান ইউএনও গত বছর যোগদানের পর থেকেই আমার সাথে প্রতিনিয়ত অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও দুর্বব্যহার শুরু করেন। কখনোই এসবের প্রতিবাদ করিনি। তারপরেও হুট করে উনি আমার বেতন দেওয়া বন্ধ করে দেন। ২ লাখ টাকা দিয়ে চাকরিতে আবারও যোগদান করতে বলেন। আমি গরিব মানুষ। এতো টাকা কোথা থেকে দিব। তাই তাকে অনেক অনুরোধ করেছিলাম। তিনি আমার কোনো কথা না শুনেই আমাকে কোয়ার্টার থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। গত ৭ মাস যাবত আমার বেতন বন্ধ করে দিয়েছেন। বেতন না পেয়ে বৃদ্ধ মা, স্ত্রী, সন্তানসহ পরিবারের ৫ জন সদস্য নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছি। নিজের কোন ভিটেমাটিও নেই। এ অবস্থায় কোয়ার্টার থেকে বের করে দিলে আমরা কোথায় যাব।
তিনি আরও বলেন, আমার দুটি মেয়ে রয়েছে। বড় মেয়েটি চলতি বছর এসএসসি পরিক্ষার্থী। সে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে জিপিএ-৫ পেয়েছে। আমার মেয়ের এসএসসি পরীক্ষা নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় আছি। বর্তমানে অন্য জায়গায় আবাসস্থল নেওয়ার মতো আমার আর্থিক কোনো সঙ্গতি নেই। আবাসস্থল ত্যাগ করলে তার লেখাপড়ার চরম ক্ষতি হবে এবং তার জীবনটা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। তাই বর্তমানে আমি পরিবার পরিজন নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।
তিনি আরও বলেন, উপায় না পেয়ে এর সুষ্ঠু বিচার চেয়ে গত ৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মন্ত্রীর একান্ত সচিব ও স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এবং রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। গত ২৮শে জুলাই ডিসি স্যারকেও একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।
চাকরি পুনর্বহাল ও বেতন ভাতাদি পরিশোধে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
এ ব্যাপারে বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলপনা ইয়াসমিন বলেন, মালি হিসেবে এখানে কে কাজ করবে সেটা উপজেলা পরিষদের সিদ্ধান্ত। পরিষদের মাসিক সভায় সিদ্ধান্তে অন্য একজনকে মালি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে অফিসে এসে কথা বলেন।
বদলগাছী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শামসুল আলম খাঁন বলেন, মালি রফিকুল ইসলাম ভদ্র একটি ছেলে। অনেক আগে থেকে এখানে চাকরি করেন। এখন পর্যন্ত তার খারাপ কোনো দিক আমার নজরে আসেনি। ইউএনও কোনভাবেই মালি হিসেবে রফিকুলকে রাখতে চাচ্ছেন না। ওই মালিকে বহাল রাখতে আমি নিজেই ইউএনও, ডিসি ও সংসদ সদস্যকেও অনেক অনুরোধ করেছি। কিন্তু এতে কোনো লাভ হয়নি। ইউএনওর একটাই কথা ‘এখানে ঐ মালি থাকবে, না হয় আমি থাকব।’ তাই বাধ্য হয়ে মাসিক সভায় অন্য একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
মালির প্রাপ্য টাকাসহ সম্মানি বাবদ অন্তত ২ লাখ টাকা দেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ইউএনও আলপনা ইয়াসমিন এখানে যোগদানের পর থেকেই বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। তিনি কারও কথাই শোনেন না। নিজের খেয়ালখুশি মতো চলেন। মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন।
এ ব্যাপারে নওগাঁর জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান বলেন, মালি কোনো স্থায়ী সরকারি কর্মচারীর পদ নয়। এটা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে রাখা হয়। মালি পদে কাকে রাখা যাবে বা যাবে না, এটা একেবারেই উপজেলা পরিষদের নিজস্ব সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তার পরেও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলপনা ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ উঠেছে, বিষয়টি আমি তদন্ত করে দেখব।