বরগুনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহরমসহ ১৩ জনকে অভিযুক্ত করে প্রতিবেদন
বরগুনায় জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের পুলিশের বেপারোয়া লাঠিপেটার ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশের অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি। গতকাল রোববার বিকেলে ওই রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে বরিশাল রেঞ্জ পুলিশের ডিআইজি আকতারুজ্জামানের কাছে। তবে ডিআইজি আকতারুজ্জামান এ বিষয়ে মিডিয়ার কাছে কোনো কিছু বলতে রাজি হননি।
রেঞ্জ পুলিশের নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, তদন্ত প্রতিবেদনে ঘটনার জন্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহরম আলীসহ ১৩ জনকে দায়ী করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশসহ ওই প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে পুলিশ হেডকোয়ার্টারসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগে।
গত ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে বরগুনা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ওপর বেপারোয়া লাঠিচার্জ করে পুলিশ। একাডেমি মিলনায়তনে তখন জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে চলছিল শোক দিবসের অনুষ্ঠান। বরগুনা সদর আসনের সংসদ সদস্য, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন সেখানে। সভা চলাকালে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শিল্পকলা একাডেমি সংলগ্ন সড়ক দিয়ে ফিরছিল বরগুনা জেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটির নেতাকর্মী ও তাদের সমর্থকরা। অপরদিকে শিল্পকলা একাডেমির দ্বিতীয় ও তৃতীয়তলায় অবস্থান করছিল সংসদ সদস্য শম্ভুর অনুসারী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। একাডেমি চত্বর অতিক্রমকালে নতুন কমিটির নেতাকর্মীদের লক্ষ্য করে শিল্পকলার দোতলা ও তিনতলা থেকে ইটপাটকেল ছোড়ে আগে থেকেই সেখানে অবস্থান নেওয়া ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এর আগে গত ২৪ জুলাই ঘোষিত ছাত্রলীগের নতুন কমিটির বিরুদ্ধে টানা তিন সপ্তাহ ধরে আন্দোলন করছিল তারা। আন্দোলন চলাকালে নতুন কমিটির নেতাকর্মীদের ওপর বেশ কয়েকবার হামলা, মোটরসাইকেল ভাঙচুর এবং মারধরের ঘটনা ঘটে। এমনকি শোক দিবসের সকালেও নতুন কমিটির নেতাকর্মীদের ওপর একদফা হামলা, মারধর ও মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়। ফুল দিয়ে ফেরার পথে শিল্পকলা একাডেমির উপর থেকে চালানো হয় দ্বিতীয় দফা হামলা। নিচে থাকা নেতাকর্মীরা পাল্টা ইট-পাটকেল ছুড়লে সংঘর্ষ বাঁধে দুই পক্ষের মধ্যে। একপর্যায়ে নিচে থাকা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ধাওয়া করে ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। ইটপাটকেল নিক্ষেপের এই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশের একটি গাড়ি। ইটের আঘাতে আহত হন বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য। এতে ক্ষোভ ছড়ায় সেখানে থাকা পুলিশের মধ্যে। ফলে শিল্পকলা ভবনে থাকা সংসদ সদস্য শম্ভুর অনুসারী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের লাঠিপেটা করে তারা। এর আগে শিল্পকলায় থাকা নেতাকর্মীদের নির্বিঘ্নে চলে যেতে দিতে বলেন শম্ভু। এই নিয়ে তার সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয় সেখানকার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহরম আলীর। এমপির সঙ্গে বাকবিতণ্ডাসহ বেপরোয়া লাঠিচার্জের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ালে এক পক্ষ বাহবা দেয় অপর পক্ষ তীব্র সমালোচনা করে পুলিশের। পরে ঘটনার সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের শাস্তির দাবিতে আন্দোলনে নামে বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগ। সমাবেশ ও বিক্ষোভ থেকে চাকরিচ্যুতির দাবি জানানো হয় মহরম আলীর।
এরপর পরিস্থিতি সামাল দিতে বরগুনা থেকে প্রত্যাহার করে চট্টগ্রাম রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহরম আলীকে। একই সঙ্গে আরও পাঁচ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করে সংযুক্ত করা হয় ভোলা ও পিরোজপুর জেলা পুলিশে। পরিস্থিতি শান্ত করতে পরের দিন বরগুনায় যান রেঞ্জ ডিআইজি আকতারুজ্জামান। এমপি শম্ভুসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি।
পরে পুরো ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত ডিআইজি ফারুককে প্রধান করে গঠিত হয় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। গতকাল এই কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে রেঞ্জ ডিআইজির কাছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী গত কয়েকদিনে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশের সদস্য, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং অভিযোগকারীদের সঙ্গে কথা বলেন কমিটির সদস্যরা। ঘটনার সময় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজও বিশ্লেষণ করেন তারা। সবদিক বিচার-বিশ্লেষণ করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহরম আলীসহ মোট ১৩ জনকে দায়ী করে এ কমিটি। তদন্ত প্রতিবেদনে এদের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ এবং অসহিষ্ণু আচরণের অভিযোগ। বলা হয়েছে, পুলিশ চাইলেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারত। কিন্তু তা না করে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করা হয়েছে উল্লেখ করে তদন্ত প্রতিবেদনে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশও করা হয়।
অভিযুক্ত ১৩ পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে ছয়জনের নাম রেঞ্জ পুলিশের দপ্তর থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। এরা হলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহরম আলী, বর্তমানে ভোলা জেলা পুলিশে সংযুক্ত বরগুনা সদর থানার সদ্য সাবেক সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. সাগর, পুলিশ কনস্টেবল মো. রবিউল ও কে এম সানি, বর্তমানে পিরোজপুর জেলা পুলিশে সংযুক্ত বরগুনা জেলা ডিবির সদ্য সাবেক এএসআই মো. ইসমাইল এবং কনস্টেবল রুহুল আমীন। বাকি সাতজনের নাম জানা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে বিস্তারিত কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান রেঞ্জ ডিআইজি আকতারুজ্জামান। বিষয়টি পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরীণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তদন্ত কমিটি তাদের রিপোর্ট দাখিল করেছে। বিষয়টি যেহেতু দাপ্তরিক, তাই এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলা সম্ভব নয়।’
অভিযুক্ত হলে সেক্ষেত্রে আলোচ্য পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটাও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ব্যাপার। আমি এ ব্যাপারে কিছুই বলতে পারব না।’