‘স্কুলড্রেস পরা মেয়েদের দেখলেই বুক ফেটে যায়’
‘স্কুল ড্রেস পরা মেয়েদের দেখলেই বুক ফেটে যায়। যদি গাড়িতে দেখি চোখ বন্ধ করে রাখি, সামনে পড়লে চোখ ফিরিয়ে নেই। মনে হয় আমার মিনুর মতো কেউ সামনে চলে আসে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারি না। আপনা আপনি চোখে পানি চলে আসে। কান্না চাপতে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসে। গত সাত বছর আমি বাড়ি থেকে বের হতে পারি না।’
কথাগুলো বলার সময় চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল শাহিদা বেগমের। ২০১৫ সালের ২০ আগস্ট মেয়ে মিনুকে হারিয়েছেন তিনি।
চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার আয়নাতলী ফরিদ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির ছাত্রী শারমিন আক্তার মিনু শ্রেণিকক্ষে ও বিরতির সময় ক্যাম্পাসে সহপাঠির দ্বারা উত্ত্যক্তের শিকার এবং উত্ত্যক্তকারীর পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে নাজেহাল হয়ে ক্ষোভে আত্মহত্যা করেছিল।
গণমাধ্যমের কাছে সেই মেয়েকে নিয়েই স্মৃতিচারণ করছিলেন শাহিদা বেগম। সাত বছর ধরে একমাত্র মেয়ের স্মৃতি আঁকড়ে আছেন তিনি। প্রতিদিনই একবার ছুঁয়ে দেখেন মেয়ের বই-খাতা, জামা-কাপড়, ছাতা ও কসমেটিকস। মিনুর রুমে কেউ ঢোকা বারণ। অনেকদিন আগে রাখা বইগুলোর রং মলিন হলেও তাঁর হৃদয়ের দগদগে ঘা একটুও শুকায়নি। প্রতিদিন মেয়ের স্মৃতি রোমন্থনে ৫২ বছর বয়সে বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন তিনি। শরীরে জেঁকে বসেছে বিভিন্ন ব্যাধি।
পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, মিনু আত্মহননের সাত বছর অতিবাহিত হলেও এখনো আসামিদের মামলা তুলে নেওয়ার হুমকিতে হতাশ তারা।
মিনুর আত্মহননের পর তার ঘর হতে একটি সুইসাইড নোট উদ্ধার করেছিল পুলিশ। যাতে লেখা ছিল—‘মা, ভাইয়া, আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নিষ্ঠুর পৃথিবীর মানুষেরা আমাকে বাঁচতে দিল না। আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী তারেক, তারেকের মা ও তার বোন কনিকা। আমার মৃত্যুর প্রতিশোধ তোমরা নিও।’
ঘটনার পর মিনুর ভাই শাহাবুদ্দিন নয়ন পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে শাহরাস্তি থানায় একটি মামলা করেন। ওই মামলায় শুধু বখাটে তারেককে গ্রেপ্তার করা হয়।
শাহরাস্তি থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) মো. নিজাম উদ্দিন ২০১৫ সালের ২২ ডিসেম্বর তারেক ও তার মা রূপবান বেগমকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। পরে ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারি অভিযোগপত্রে তদন্ত কর্মকর্তা পক্ষপাতদুষ্ট তদন্ত করেছেন মর্মে তার দাখিলকৃত চার্জশিটের উপর নারাজি আবেদন করে বাদীপক্ষ। ওই বছরের ১৬ মার্চ নারাজি আবেদন মঞ্জুর করে মামলাটি বিজ্ঞ আদালত সিআইডিতে পাঠান। সিআইডি পুনর্তদন্ত শেষে একই বছর ৬ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিলে আদালত মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) আবারও তদন্তের নির্দেশ দেন। পিবিআই ২০১৭ সালে তারেক, তার মা রূপবান বেগম ও বোন কনিকাকে আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল করে। যা বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে।
মিনুর ভাই মামলার বাদী শাহাবুদ্দিন নয়ন জানান, তারেকের পরিবার বয়স কমিয়ে ভুয়া জন্মসনদ তৈরি করে। তাতে তারেকের বয়স দেখায় ১৭ বছর পাঁচ মাস ১২ দিন। অথচ পরবর্তী সময়ে মেডিকেল রিপোর্টে প্রমাণিত হয় তারেকের বয়স ২০ বছর। ওই ভুয়া জন্মসনদ দ্বারা তারেক অপ্রাপ্ত বয়স্ক দেখিয়ে তার জামিন নেওয়া হয়। কিন্তু মিনুর আত্মহত্যায় প্রধান প্ররোচনাকারী বখাটে তারেকের মা রূপবান বেগম ও তার বোন কনিকা আজও ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
নয়ন বলেন, তারেক ও তার মা আমাকে প্রতিনিয়ত মামলা তুলে নিতে হুমকি দিয়ে আসছে। নিজের বোন হারানোর ঘটনার বিচার চেয়ে আমি নিজেই প্রাণ শঙ্কায় রয়েছি।’
মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট শাহেদুল হক মজুমদার সোহেল জানান, মিনু আত্মহননের মামলায় দায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়েছে। বর্তমানে মামলাটি বিজ্ঞ আদালতে বিচারাধীন। আসামিপক্ষের হুমকি-ধমকির পরিপ্রেক্ষিতে মিনুর পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হবে।
প্রসঙ্গত, উপজেলার চিতোষী পশ্চিম ইউনিয়নের হাড়িয়া গ্রামের পণ্ডিত বাড়ির প্রবাসী মোহাম্মদ আলীর মেয়ে শারমিন আক্তার মিনুকে প্রায়ই উত্ত্যক্ত করত সহপাঠী একই ইউনিয়নের সংহাই গ্রামের প্রবাসী আবু তাহেরের ছেলে মমিন হোসেন তারেক। ঘটনার দিন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের উপস্থিতিতে ইংরেজি ক্লাস চলাকালে রূপবান বেগম ক্লাসের ভেতর ঢুকে মিনুকে দাঁড় করান। পরে তার ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার পরামর্শ দেন। এ প্রস্তাব মিনু প্রত্যাখ্যান করলে বিরতির সময় রূপবান বেগমের সঙ্গে তার মেয়ে কনিকা এসে আরও অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করেন। ওই সময় তারেক মিনুকে চড় মারেন এবং মুখে থুতু দেন। উপস্থিত সহপাঠীদের সামনে অপমানিত হয়ে রাগে ক্ষোভে চতুর্থ ঘণ্টার পর ছুটি নিয়ে বাড়িতে গিয়ে বসত ঘরের ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে মিনু।