জাতিসংঘ ভবনে সেমিনার : অবিলম্বে একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতি চাই
জেনেভায় জাতিসংঘ ভবনে অনুষ্ঠিত সেমিনারে বক্তারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তান কর্তৃক সংঘটিত বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। আর কালক্ষেপণ না করে তারা ১৯৭১ সালের গণহত্যাকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। ইউরোপ ভিত্তিক প্রবাসী সংগঠন বাসুগ এই সেমিনারের আয়োজন করে।
এই সম্মেলনটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হয়, যখন জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ৫১তম অধিবেশন চলছে। সেমিনারের এই সাইড ইভেন্টটি ইউরোপ-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইউরোপীয় বাংলাদেশ ফোরাম (ইবিএফ) এবং সুইজারল্যান্ড মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশের সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনার শুরুতে আমরা একাত্তর, প্রজন্ম একাত্তর ও বাসুগ নির্মিত একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ভিডিও চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়।
বাসুগের চেয়ারম্যান বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন জেনেভায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের উপস্থায়ী প্রতিনিধি সঞ্চিতা হক, সুইডেনের হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি সৈয়দ আসিফ শাকার, ব্রাসেলস ভিত্তিক উন্নয়ন গবেষণা সহযোগিতার পরিচালক অধ্যাপক ড. তাজিন মুরশিদ, জার্মানি থেকে প্রকাশিত ৫০ বছর বাংলাদেশ এর সম্পাদক ও বাংলাদেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ড্যানিয়েল জাইডল, জুরিখের যোগাযোগ পরিচালক ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন, ইউনাইটেড কাশ্মীর পিপলস ন্যাশনাল পার্টির নির্বাসিত চেয়ারম্যান সরদার শওকত আলী কাশ্মীরি, বেলুচ ভয়েস অ্যাসোসিয়েশন, ফ্রান্সে সভাপতি মুনির মেঙ্গল, ইবিএফ ইউকের প্রেসিডেন্ট আনসার আহমেদ উল্লাহ, সর্ব ইউরোপীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কালাম মিয়া এবং ইন্টারন্যাশনাল এইচআর কমিশন বিডি, সুইজারল্যান্ড এর প্রেসিডেন্ট রহমান খলিলুর মামুন।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীরা বিংশ শতাব্দীতে বিশ্বের অন্যতম জঘন্যতম গণহত্যা সংঘটিত করেছিল। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী নয় মাসে প্রায় ত্রিশ লাখ মানুষ হত্যা করে, দুই লাখেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ করে এবং লাখ লাখ মানুষকে বাধ্য করে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৯৭১ সালের হত্যাযজ্ঞের খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত এবং সেই সময়ের কূটনৈতিক চিঠিপত্রে নথিভুক্ত এবং রিপোর্ট করা হয়েছে।
জেনেভায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের উপস্থায়ী প্রতিনিধি সঞ্চিতা হক তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষ তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য ও শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নয়মাস লড়াই করেছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশের নিরস্ত্র নারী-শিশুসহ সাধারণ মানুষের পর অবর্ণনীয় নির্যাতন করেছে। বাংলাদেশের মানুষ জাতিসংঘের কাছে এই গণহত্যার সুবিচার চায়। জাতিসংঘের স্বীকৃতি চায়।’
বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ সরকার একাত্তরের গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকার বিশ্বের যে কোন জায়গায় নির্যাতন-নিপীড়ন ও গণহত্যার নিন্দা জানায়। তিনি এই স্পর্শকাতর বিষয়ে বাংলাদেশের প্রতি বিশ্ববাসির সমর্থন আহ্বান করেন।
বিচারপতি সৈয়দ আলী শাকার বলেন, ‘গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং সঠিক বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক কমিশন গঠন করতে হবে, যেখানে পাকিস্তানের পক্ষ থেকেও প্রতিনিধি থাকতে হবে।’
বর্তমানে সুইডেনে নির্বাসিত পাকিস্তানি এই নাগরিক শাকার বাংলাদেশের একজন প্রবল সমর্থক এবং একাত্তরে গণহত্যার তীব্র সমালোচক। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকার ও সামরিক শাসনে বাংলাদেশের পক্ষে তার ভূমিকার জন্য তাকে ছয় মাসের জন্য কারাগারে পাঠানো হয়।
অধ্যাপক ডা. তাজিন মুরশিদ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য আমাদের প্রচেষ্টা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। যদি এ ব্যাপারে দ্রুত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা না হয়, জনতার আদালত গঠন করে একাত্তরের গণহত্যার একক এবং সম্মিলিত হত্যাযজ্ঞের শুনানি নথিভুক্ত করা হবে এবং দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করা হবে, যদিও সেই রায় কার্যকর করা সম্ভব নাও হতে পারে। এ ছাড়া এই গণহত্যার রায় এবং দলিল ও প্রমাণ ব্যাপকভাবে প্রচার করা হবে।’
বাংলাদেশের বন্ধু পদকে ভূষিত আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন বলেন, ‘বাংলাদেশ গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চায়।’
সাইড ইভেন্টটি সরাসরি সম্প্রচার করেছে লন্ডন ভিত্তিক ব্রিটিশ বাংলা নিউজ চ্যানেল, যা ঢাকা ও নিউইয়র্কসহ বিশ্বের বিভিন্ন নগরীতে প্রদর্শিত হয়েছে।