টাকা ও জমির লোভে মনুকে হত্যা করেন জাহিদ কবিরাজ
হেমায়েত ওরফে জাহিদ কবিরাজ। ১৫ বছর বয়স থেকেই তিনি কবিরাজি করেন। এখন বয়স ৫২। ২০০৫ এর অক্টোবরের কথা। মনু বেগম নামের এক রোগীর কাছে থাকা প্রায় এক লাখ টাকা ও জমিজমা হাতিয়ে নিতে তাঁকে কুপিয়ে ও শ্বাসরোধে হত্যা করেন হেমায়েত ও তাঁর সহযোগী।
এ অভিযোগে আদালত জাহিদ কবিরাজকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। কিন্তু, সাজা থেকে বাঁচতে তিনি ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে ছিলেন। গতকাল বুধবার রাতে রাজধানীর কেরাণীগঞ্জ থেকে ১৭ বছর পলাতক থাকা হেমায়েতকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এ তথ্য জানান।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘১৫ বছর বয়স থেকে কবিরাজি পেশা শুরু করে জাহিদ। বিভিন্ন ছদ্মবেশে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলেন তিনি। মূলত নারীরাই ছিল তার প্রতারণার মূল টার্গেট। ২০০৫ সালে বাগেরহাটের নারী উদ্যোক্তা মনোয়ারা মনু বেগমকে অর্থ ও জমির কারণে হত্যা করে জাহিদ। সেই মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন জাহিদ।’
খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘২০০৫ সালের অক্টোবর মাসে বাগেরহাট জেলার সদর এলাকায় মনু বেগম নামে এক নারীর বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয়। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় হেমায়েতসহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে বাগেরহাট থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের হয়। মামলাটির তদন্ত শেষে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ২০০৯ সালের জুন মাসে আদালত আসামি হেমায়েতকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। কিন্তু, বিভিন্ন ছদ্মবেশে হেমায়েত ওরফে জাহিদ কবিরাজ পলাতক ছিলেন।
গ্রেপ্তারের সময় উদ্ধার করা হয় কবিরাজি চিকিৎসায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের আংটি- ১২৯টি, বক্স একটি, শঙ্খ তিনটি, আলাদিনের চেরাগ একটি, ক্রেস্ট দুটি, কবিরাজিবিষয়ক বই ১৫টি, পিতলের পাঞ্জা একটি ও কবিরাজিবিষয়ক অন্যান্য সরঞ্জামাদি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত মনু হত্যার বিষয়টিও তিনি স্বীকার করেছেন বলে জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
মনু হত্যার ঘটনা বর্ণনা দিয়ে র্যাবের মুখপাত্র বলেন, কবিরাজি পেশায় তার অন্যতম সহযোগী ছিল মনু হত্যা মামলার অপর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সোবহান। ২০০৫ সালে জানুয়ারি মাসে সোবহান মনুর মাথা ব্যথার রোগকে মানসিক রোগ বলে আখ্যায়িত করে কবিরাজি চিকিৎসার জন্য হেমায়েতের কাছে নিয়ে আসেন। মনুর স্বামী ঢাকায় চাকরি করতেন এবং প্রতিমাসে সংসারের খরচ চালানোর জন্য মনুর কাছে টাকা পাঠাতেন। মনু তার জমানো টাকা দিয়ে কাপড়ের ব্যবসা করত এবং নারী উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেন। কাপড়ের ব্যবসা করে এবং স্বামীর পাঠানো টাকা জমিয়ে মনুর কাছে লক্ষাধিক টাকা জমা হয়। এই টাকায় হেমায়েতের দৃষ্টি পড়ে। হেমায়েত মনুর সরলতার সুযোগে তার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার উদ্দেশে মনুকে টার্গেট করেন।’
খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, ‘হেমায়েত মনুকে কিছু ভেষজ উপাদানের মাধ্যম নিয়মিত ঘুমের চিকিৎসা দেওয়া শুরু করেন। একপর্যায়ে যাবতীয় সম্পত্তির দলিলপত্র এবং টাকা পয়সা শত্রুপক্ষের জ্বিনের আক্রমণে পড়তে পারে বলে ভয় ভীতি দেখিয়ে নিরাপত্তার জন্য হেমায়েতের কাছে জমা রাখতে মনুকে উদ্বুদ্ধ করে। নিয়মিত ভেষজ উপাদান সেবনের ফলে মনুর ঘুম হয় এবং মাথা ব্যথা কিছুটা কমে। এতে হেমায়েতের ওপর ভুক্তভোগী আস্থা তৈরি হয়। পরবর্তীতে সরল বিশ্বসে মনু তার টাকা পয়সা ও সম্পত্তির দলিল হেমায়েতের কাছে জমা রাখে।’
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘মনুর সরল বিশ্বাসের সুযোগ নেন কবিরাজ। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, হেমায়েত সহযোগীসহ মনুকে চেতনানাশক ওষুধ খাওয়ান। পরে দলিলপত্রে টিপসই নিয়ে তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে মনুর জ্ঞান ফিরে আসলে তিনি পুলিশের কাছে অভিযোগ করার জন্য যেতে চান। পরে মনুর সঙ্গে ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে সহযোগীসহ হেমায়েত মনুকে কুপিয়ে এবং শেষ পর্যন্ত গলা কেটে হত্যা নিশ্চিত করেন। এরপর রাতের অন্ধকারে মনুর গলাকাটা মরদেহ বস্তাবন্দি করে হেমায়েতের বাড়ির সামনের খালের ওপাড়ে ধান ক্ষেতে লুকিয়ে রাখেন। এরপর থেকে হত্যাকারীরা পলাতক।’
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘ছদ্মবেশকালে জাহিদ কবিরাজ মিরপুরে তিন বছর অবস্থানের পর তার প্রতারণার বিরুদ্ধে জনরোষ সৃষ্টি হয়। পরে ঠিকানা পরিবর্তন করে কিছুদিন আদাবর, কিছুদিন কেরাণীগঞ্জ এবং সর্বশেষে বিগত পাঁচ বছর যাবৎ মোহাম্মদপুর বসিলায় বিভিন্ন স্থানে কবিরাজি ব্যবসার আড়ালে প্রতারণা করে আসছেন। তাঁর বশবর্তী জ্বিনের বাদশার মাধ্যমে মানুষের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের কথা বলে নতুনভাবে প্রতারণা করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ হাতিয়ে নেন।