প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল কর্মকর্তা পরিচয়ে হাতিয়েছেন কোটি কোটি টাকা
হরিদাস চন্দ্র ওরফে তাওহীদ (৩৪)। পেশাদার এসি মেকানিক। কিন্তু, নিজেকে পরিচয় দিতেন প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল কর্মকর্তা, মন্ত্রীর সহকারী ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা হিসেবে। এসব পরিচয়ে শুরু করেন বদলি, বাণিজ্য, টেন্ডারবাজিসহ নানা প্রতারণা। এভাবেই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিতেন কোটি কোটি টাকা।
এমনকি সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের নামে সহযোগীদের মোবাইল নম্বর সেভ করাসহ বিভিন্ন ফন্দি আঁটেন এই প্রতারক। গতকাল সোমবার রাতে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও র্যাবের যৌথ অভিযানে রাজধানীর বনানী থেকে হরিদাস চন্দ্র ও ইমরান মেহেদী হাসান নামে তাঁর এক সহযোগীকে গ্রেপ্তারের পর এ তথ্য জানিয়েছে র্যাব।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
গ্রেপ্তারের সময় প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত চারটি মুঠোফোন, জালিয়াতিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন ডকুমেন্টস ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এডিট করা ভুয়া ছবি জব্দ করা হয়।
খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রতারক হরিদাস ওরফে তাওহীদ প্রতারকচক্রের মূলহোতা। তিনি ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়ে অবৈধভাবে ভারতে গিয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। আত্মীয়ের মাধ্যমে সেখানকার পঞ্চায়েত প্রধানের কাছ থেকে কৌশলে একটি এতিম সার্টিফিকেট নিয়ে স্থানীয় একটি স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এবং ইলেক্ট্রনিক বিষয়ে দুই বছরের বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ২০১০ সালে বাংলাদেশে এসে রাজধানীর উত্তরায় পুরাতন এসি কেনাবেচা ও মেরামত করে বিক্রির কাজ শুরু করেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এরপর উত্তরার একটি হাসপাতালের এসি মেরামত ও বিক্রির চুক্তি হয়। ২০১৮ সালে একজন সবজি বিক্রেতার সঙ্গে বাসা ভাড়া নেন। বাসা ভাড়া থাকা অবস্থায় তাঁর মেয়েকে বিয়ে করার জন্য ২০১৯ সালে সনাতন ধর্ম পরিবর্তন করে ধর্মান্তরিত হন হরিদাস চন্দ্র। হরিদাস নাম পরিবর্তন করে তাওহীদ ইসলাম নাম ধারণ করেন।
র্যাব জানায়, হরিদাস ওরফে তাওহীদ তাঁর শ্বশুরের পরিচয়ে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া এলাকায় কিছু জমি কেনেন। শ্বশুরের মাধ্যমে এলাকায় নিজেকে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও বিত্তশালী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন। এই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের প্রটোকল অফিসার পরিচয় দেন। তখন তিনি দামি গাড়ি ও দামি পোশাক পরে মাঝে মাঝে এলাকায় গিয়ে স্থানীয় রাজনীতিবিদ, গণ্যমান্য বিত্তশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচিত হতেন। এ সময়ে প্রধানমন্ত্রীর নিকটাত্মীয়ের সহায়তায় প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রজেক্টের প্রস্তাব দিতেন। এলাকার বিত্তশালী লোক এসব প্রজেক্টে বিনিয়োগ করলে তাদের লভ্যাংশ প্রদান করা হবে বলে জানানো হতো। এ ছাড়া প্রজেক্ট শুরু হলে, প্রজেক্ট সমাপ্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় বিভিন্ন সরকারি দপ্তর থেকে অর্থ নেওয়ার আশ্বাস দিতেন। তা ছাড়া চাকরি, বদলি, টেন্ডারসহ বিভিন্ন বিষয়ে তদ্বির, জমি কেনা-বেচাসহ নানা প্রতিশ্রুতি টাকা হাতিয়ে নিতেন, যেগুলো সত্য নয়।
খন্দকার আল মঈন বলেন, তাওহীদের সহযোগী ইমরান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কর্মরত পরিচয় দিতেন। তিনি বিভিন্ন সহযোগীদের মাধ্যমে হরিদাসের কাছে আনতেন। এরপর অধিদপ্তরের বিভিন্ন পদে চাকরি, পদোন্নতি এবং বদলির আশ্বাসে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিতেন। হরিদাস ওরফে তাওহীদ অত্যন্ত বচনপটু। একবার তাঁর সঙ্গে কেউ পরিচিত হলে, প্রতারণার খপ্পর হতে বের হতে পারতেন না।
গ্রেপ্তার তাওহীদকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিতে খন্দকার মঈন জানান, প্রতারণার মাধ্যমে আয় করা টাকা দিয়ে ২০১৯ সালে ফুলবাড়িয়া এলাকায় প্রায় এক বিঘা জমি কিনে প্যারিস সুইমিংপুল এন্টারটেইনমেন্ট পার্ক নামে রিসোর্টের কাজ শুরু করেন। এই রিসোর্টের কাজ করার সময়ে আরও অনেকেই টাকা লেনদেনের রশিদ ছাড়া তাঁকে লাখ লাখ টাকা প্রদান করেন। ২০২০ সাল প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে রিসোর্টের কাজ শেষ হলে পরবর্তীতে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। তাঁর চক্রে ৫ থেকে ৬ জন সহযোগী রয়েছেন। তাঁর মুঠোফোনে বিভিন্ন নম্বর প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের এবং নিকটাত্মীয়ের বিভিন্ন সদস্যদের নামে সেভ করা থাকতো। তিনি প্রতারণা করার সময় ওই সেভ নম্বরগুলোতে কল দিয়ে ভুক্তভোগীকে প্রতারিত করে মোবাইল স্ক্রিনে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের নাম প্রদর্শন করতো। সহজ সরল মানুষ এ নম্বরকেই প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যের নম্বর মনে করে প্রতারিত হতো। প্রকৃতপক্ষে তাঁর কোনো রাজনৈতিক নেতা বা কর্মীর সঙ্গে পরিচয় বা পদ নেই। প্রতারণাই তার পেশা।