ঘর মেরামত প্রকল্প আওয়ামী লীগ ও বিএনপির
ঘর মেরামত নিয়ে ব্যস্ত বড় দুই দল। এ অঞ্চলের ইতিহাসে নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার উত্তাল সময় মার্চ মাসেই তারা সারতে চায় এ মেরামতের কাজটি। কাউন্সিলের মাধ্যমে মেরামতের প্রাক প্রক্রিয়ায় সরগরম ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির অন্দরমহল। প্রাপ্তির আশার বিপরীতে ছিটকে পড়ার আতঙ্ক ভর করেছে দুই দলের বেশ কিছু নেতাকর্মীর মধ্যে। তবে এবার অসাধারণ ঘটনা হচ্ছে, সাংগঠনিক দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ সাধারণ সম্পাদক বা মহাসচিব নিয়ে তোড়জোড় নেই কোনো দলেই। বিষয়টি মোটামুটি ফয়সালা হয়েই আছে। আওয়ামী লীগে সাধারণ সম্পাদক পদে জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের টানা তৃতীয় দফা দায়িত্ব পাওয়া প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। প্রায় একই অবস্থা বিএনপিতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে নির্ভার করে পুরোদস্তুর মহাসচিব করার বিষয়টি। দলের নাম্বার ওয়ান পদ সভানেত্রী ও চেয়ারপারসন বদল হচ্ছে না কোনো দলেই।
সচরাচর দলগত সামান্য সমস্যায়ও বিরোধী দল যেভাবে ভারাক্রান্ত হয়, ক্ষমতাসীন ঘরে তা হয় না। বড় টুটা-ফাটা দিয়েও ক্ষমতাসীনদের ঘরে পানি চুইয়ে পড়তে পারে না। ক্ষমতা, প্রশাসন, অর্থবিত্তে সব সামলে যায়। এরপরও বর্তমান গদিনশীন দলে মেরামতের আয়োজনে কোনো গা-ছাড়া ভাব নেই। বরং আয়োজনের কর্মযজ্ঞে তারা বিরোধী দল বিএনপির চেয়ে এগিয়ে। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বেশ চমক আসার আগাম খবর পাওয়া যাচ্ছে। গঠনতন্ত্র সংশোধন ও কমিটির আকার বাড়ানোর পাশাপাশি কাউন্সিলে ভাগ্য বিপর্যয় ঘটতে পারে ক্ষমতাসীন দলটির প্রভাবশালী কয়েক নেতার। সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত আসতে পারে- এমন আতঙ্কে টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, এমনকি মাদক ব্যবসার মতো জঘন্য কাজে জড়িয়ে পড়া কিছু নেতা-এমপি। তৃণমূল নেতাদের অবমূল্যায়ন থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ ও পৌর নির্বাচনে তাঁদের বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্য, এলাকায় পারিবারিক ও ব্যক্তিগত কোটারি তৈরির অভিযোগও রয়েছে কারো কারো বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্যপদ হারাতে পারেন অনেক নেতাই। এবার আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদে একঝাঁক তরুণের অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে। এর বাইরে রয়েছে সহযোগী সংগঠন এবং পদবঞ্চিত সাবেক ছাত্রনেতাদের মধ্য থেকে নেতৃত্ব উঠে আসার সম্ভাবনা।
বিএনপিতে এ ধরনের ঘটনা আরো বেশি ঘটার কথা বেশ প্রচার পেয়েছে। ‘এক ব্যক্তির এক পদ’ তত্ত্ব দলে অত্যন্ত আলোচিত। নেতৃত্ব বিকাশে ‘এক নেতার এক পদ’ এ বিধান গঠনতন্ত্রে রাখার পক্ষে দলে জোরালো মতামত তৈরি হয়েছে। শোনা যায়, এতে চেয়ারপারসনেরও মৌন সম্মতি রয়েছে। বিএনপিতে জাতীয় স্থায়ী ও নির্বাহী কমিটিতে নতুন মুখ বেশি দেখা যেতে পারে। দলের গঠনতন্ত্রেও আনা হচ্ছে সময়োপযোগী কিছু সংশোধনী। নেতৃত্ব-প্রত্যাশীদের আনাগোনা বেড়েছে নয়াপল্টন ও খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে। গতি এসেছে তৃণমূল পুনর্গঠনেও। লবিং আর তদবিরে এবার বিএনপিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ার সম্ভাবনা কম বলেও প্রচার রয়েছে। দলের প্রতি অনুগত, বিগত আন্দোলনে সক্রিয় এবং মানুষের কাছে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি রয়েছে- এমন নেতারা এবার গুরুত্ব পাবেন বলে আলোচনা ছড়িয়ে পড়েছে। এতে বিগত আন্দোলন ও দলীয় কর্মসূচিতে সক্রিয়রা বেশ চাঙ্গা। অন্যদিকে নিষ্ক্রিয় এবং সুবিধাবাদীরাও বসে নেই। বাদপড়ার ঝুঁকি মোকাবিলায় তৎপর হয়ে উঠেছেন তাঁরা। পদ রক্ষায় তাঁদের অনেকেও উল্লিখিত দুই অফিসে হাজিরা বাড়িয়ে দিয়েছেন।
পঞ্চম কাউন্সিলের পর বিএনপির মহাসচিবের দায়িত্ব পান খন্দকার দেলোয়ার হোসেন। ২০১১ সালের ১৬ মার্চ তিনি মারা যান। এরপর ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব করা হয় দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে। এখন পর্যন্ত তাঁকে ‘ভারমুক্ত’ করা হয়নি। আসন্ন কাউন্সিলে তাঁকে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব করতে দলের মধ্যে জোরালো দাবি রয়েছে। এতদিন মহাসচিব হিসেবে ফখরুলের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর কথা শোনা না গেলেও গত কদিন ধরে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, তরিকুল ইসলাম, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নাম আলোচনায় নিয়ে আসা হয়েছে। দলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব নিয়েও চলছে নানা লবিং। এ দৌড়ে রয়েছেন বর্তমান যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, মোহাম্মদ শাহজাহান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন। স্থায়ী কমিটির ১৯ সদস্যের মধ্যে খন্দকার দেলোয়ার হোসেন, ড. আর এ গনি ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী মারা গেছেন। এম শামসুল ইসলাম, সারোয়ারী রহমান দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। এ কারণ এবার স্থায়ী কমিটিতে পাঁচ-ছয়জন নতুন মুখ দেখা যেতে পারে। আলোচনা হচ্ছে ঢাকার সাবেক মেয়র ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, আবদুল্লাহ আল নোমান, মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ, সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, ড. ওসমান ফারুক, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর নাম। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এবার বিএনপির নির্বাহী কমিটির এক নম্বর ভাইস চেয়ারম্যান পদটিও গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে এ পদে রয়েছেন বিচারপতি টি এইচ খান। তিনি বেশ অসুস্থ।
এ মুহূর্তে আন্দোলনের চেয়ে ঘর গোছানো জরুরি- বিবেচনায় এগুচ্ছে বিএনপির কাউন্সিল প্রস্তুতি। সরকারের ধারাবাহিক নিপীড়নসহ নানা কারণে দলটির চরম দুঃসময় যাচ্ছে। সারা দেশ থেকে বিএনপির সংগ্রহ করা তথ্যমতে, চার লাখ তিন হাজার ৮৭৮ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে প্রায় ২২ হাজার মামলা রয়েছে। গ্রেফতার ১৭ হাজার ৮৮৫ জন। এ ছাড়া বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে বিএনপির ৪৪০ জন নেতাকর্মী খুন হয়েছেন। আন্দোলনকে ঘিরে ২৬৭ জন নেতাকর্মী গুম হয়েছেন এবং পঙ্গুত্ববরণ করেছেন ৩৩৭ জন। এ বাস্তবতা মোকাবিলার কথা মাথায় রেখেই ঘর মেরামত করতে হচ্ছে বিএনপিকে।
এদিকে, সংসদের বোঝাপড়ায় বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও কাউন্সিল করবে। অবশ্য দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে ভাবনা নেই তেমন। কারণ এ দল মেরামতে কাউন্সিল করতে হয় না। নেতৃত্ব বাছাই বা সিদ্ধান্তের সর্বময় ক্ষমতা চেয়ারম্যানের। তিনি যে কোনো সময় যে কোনো পদায়ন, বরখাস্তসহ যে কোনো সিদ্ধান্ত আরোপ করতে পারেন। নেতাকর্মীদের কেউ কেউ তাচ্ছিল্য করে বলছেন, এপ্রিলে কাউন্সিলের নামে নতুন এপ্রিল ফুল দেখবেন তাঁরা। এ রকম ‘ফুল’ তাঁরা অহরহই হচ্ছেন। কো-চেয়ারম্যান নিয়োগ, মহাসচিব পাল্টানো, সরকার থেকে বেরিয়ে আসার দাবিসহ চলমান নাটকীয়তায়ও ‘বোকা’ বনে থাকতে হচ্ছে তাঁদের। এরশাদ-রওশন দুই পক্ষই আসলে সরকারের পক্ষে থাকার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। প্রধানমন্ত্রীর আস্থায় থাকার চেষ্টায় এরশাদ, রওশন, জি এম কাদের কেউ কারো চেয়ে তত পিছিয়ে নেই। মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসার চেয়ে আরো দু-একটি মন্ত্রিত্ব বাগানোর চেষ্টাই বেশি। কিন্তু নানা নাটকীয়তায় নয়-ছয় বুঝিয়ে নেতাকর্মীদের একটি ঘোরের মধ্যেই রাখা হচ্ছে।
অন্যদিকে, ঘর-দুয়ার ঠিক করার মতো পরিস্থিতিতে নেই জামায়াতে ইসলামী। মগবাজারে কেন্দ্রীয়, পল্টনে মহানগর জামায়াত ও শিবিরের কেন্দ্রীয়সহ সারা দেশে দলের প্রায় সব কার্যালয় পাঁচ-ছয় বছর ধরে বন্ধ। প্রকাশ্যে কোনো তৎপরতা নেই নেতাকর্মীদের। আবদুল কাদের মোল্লার পর কামারুজ্জামান, এরপর মুজাহিদেরও ফাঁসি হয়েছে। দলের নিবন্ধন বাতিলের বিষয়টি উচ্চ আদালতে মীমাংসার অপেক্ষায়। একাধিক মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে দল পরিচালনা করছেন ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ। লক্ষাধিক মামলায় আট লাখ নেতাকর্মী আসামি, গ্রেপ্তার লাখের ওপরে, ২১ সদস্যের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের অর্ধেকের বেশি কারাগারে, সাতজন বিভিন্ন মামলার আসামি হয়ে আত্মগোপনে। বাকি দুজনের একজন ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক দেশান্তরী। অন্যজন ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবু নাছের মোহাম্মদ আবদুজ জাহের দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে দূরে। দলের ঢাকা মহানগর কমিটির সবাই আত্মগোপনে। সব মিলিয়ে রীতিমতো বিপর্যস্ত জামায়াত।
তাদের টিকে থাকার এখন যত চেষ্টা ভার্চুয়াল জগতে। গণমাধ্যমে নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয় অজানা জায়গা থেকে। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুকের মাধ্যমে নিয়মিত নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করছেন নেতাকর্মীরা।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন