মেট্রোরেল
আধুনিক যাতায়াতে স্বপ্নের ছোঁয়া
প্রথমবারের মতো মেট্রোরেলের সামীপ্য পাচ্ছে প্রাণের বাংলাদেশ। রাজধানীর ক্রমবর্ধমান গতিজড়তা কাটতে চলেছে অনেকখানি। প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে সুন্দর যাতায়াতে ফিরছে নগরবাসীর সুদিন।
দূষণ ও যানজটে নাকাল ঢাকাবাসীর জন্য যেন এক পশলা বৃষ্টির স্বস্তি হয়ে এল আনকোড়া এই যোগাযোগ ব্যবস্থা। গতির সংকটে থাকা রাজধানী ঢাকার জন্য নিশ্চিতই দারুণ সুসংবাদ এটি।
জনগণ সময়মতো তাদের কর্মস্থল, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছতে চায়। ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে পড়া সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন মানুষের স্বাধীন যাতায়াতের বড় বাঁধা।
মহাসড়কে পর্যাপ্ত গণপরিবহন না চলার কারণে বিপুলসংখ্যক ব্যক্তিগত গাড়িতে ভরে ওঠেছে। কর্মসংস্থানের অভাবে পড়ে লাখো মানুষ এখন রিকশা অটো চালাচ্ছে। তার ওপর মেয়াদোত্তীর্ণ লক্করঝক্কর গাড়িও চলছে বেশুমার। ফুটপাত এখন সওদাগরদের লোভের ভাগাড়। সবমিলিয়ে কার্যত ঢাকার সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা এখন ভয়াল আতঙ্কের নাম। ৪/৫ ঘন্টা সময় হাতে নিয়ে বের হলেও টাইমমতো গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো নিয়ে শঙ্কা কাটে না। এমন বাস্তবতায় নগর যোগাযোগে মেট্রোরেল হতে চলেছে সবার জন্য বড় আশীর্বাদ।
ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল আজ থেকে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করল। শুরুতে বিরতিহীনভাবে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চললেও সহসাই আমরা হয়ত হাইরাইজ ভবনের ফাঁক গলে দিনব্যাপী দৃষ্টিনন্দন এই মেট্রোরেল চলতে দেখব। যাত্রীর চাওয়া মাফিক স্টেশনে স্টেশনে থামতেও দেখব। এখন উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চলবে মেট্রোরেল। পৌনে ১২ কিলোমিটার এই পথ পাড়ি দিতে মেট্রোরেলের সময় লাগবে মাত্র ১০ মিনিট ১০ সেকেন্ড। বহুমাত্রিক জটের নগরীতে বাস কিংবা অন্য যানবাহনের চেয়ে এটিই হতে চলেছে স্বস্তিকর দ্রুত যাতায়াত। উত্তরার দিয়াবাড়ির বাসিন্দাদের এখন বেজায় আনন্দ। দিয়াবাড়ির ডিপোতেই থাকছে মেট্রোরেলের অপারেশন কন্ট্রোল সেন্টার(ওসিসি)।
সাধারণত রেলপথ মানেই পাথরের পাটাতনে লৌহপথ। কিন্তু মেট্রোরেলের লাইনে কোনো পাথর নেই। এমনকি মেট্রোরেলের লাইনে সাধারণ রেললাইনে মতো কিছুটা পরপর কোনো জোড়াও নেই। পুরোপুরি বিদ্যুতে চলায় বায়ুদূষণ বা কার্বন নিঃসরণ বলেও কিছু নেই। লাইনের আশেপাশে থাকা শহুরে বাসিন্দারা শব্দদূষণও টের পাবেন না। রেলযাত্রায় অভ্যস্থ নিয়মিত যাত্রীরা কেবল সাধারণ রেলের কু ঝিক ঝিক ঝিক শব্দ আর ডানে বামে হেলদোলটা মিস করতে পারেন।
মেট্রোরেলের ভাড়া পরিশোধেও রাখা হয়েছে আধুনিকতার ছোঁয়া। যাত্রীদের জন্য ১০ বছর মেয়াদি স্থায়ী কার্ড থাকবে। এই কার্ড কিনতে লাগবে ২০০ টাকা। এরপর প্রয়োজনমতো টাকা দিয়ে রিচার্জ করা সাপেক্ষে কার্ডটি প্রয়োজনমতো ব্যবহার করা যাবে।
সড়কপথে যাত্রীদের বিপাকে ফেলে যাচ্ছেতাইভাবে ভাড়া আদায় করে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। নিরাপদ ও ঝক্কিমুক্ত গণপরিবহন সংকটের কালে মেট্রোরেলের কার্ডসিস্টেম অতি অবশ্যই সুখবর। তবে ভাড়াটা যেন সাধারণের সাধ্য ও নাগালের মধ্যে থাকে এমনটাই সবার দাবি।
কোভিড-১৯ ও ইউক্রেন যুদ্ধ বাস্তবতায় নানামুখী বৈশ্বিক সংকট থাকা সত্ত্বেও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকায় আরো ছয়টি মেট্রোরেলের লাইন নির্মাণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। সেসব লাইনে মেট্রোরেলের স্থাপনা ও যাত্রীদের নিরাপত্তায় বিশেষ পুলিশ (এমআরটি পুলিশ) নিয়োগের আইনও করা হয়েছে ইতোমধ্যে।
দুর্নীতিমুক্ত ও কঠোর মান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে নিশ্চিতভাবেই দেশের জনগণ লাভবান হবে। যোগাযোগ সেবার মাধ্যমে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সক্ষমতাও বাড়বে।
সুখী ও সমৃদ্ধশালী জাতি গঠনে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সুশিক্ষার ব্যবস্থা করবার পাশাপাশি আধুনিকতম যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সময়ের দাবি। সেই দাবি পূরণে কোনো কল্যাণকামী সরকার বা কল্যাণ রাষ্ট্রের আধিকারিকরা যদি সহৃদয় ব্রতী হয় তবে আমরা তাদের সাধুবাদ জানাই।
ডিসেম্বর মহান স্বাধীনতার বিজয়ের মাস। বিজয়ের এই সুন্দরতম মাসে আধুনিক যাতায়াতের স্বপ্ন ছোঁয়াটা নগরবাসী সবার জন্যই দারুণ মঙ্গলবার্তা। মঙ্গলের এই আবাহন আমাদের নূতন বর্ষকে আরো প্রাণবন্ত করুক। দুর্বিপাক কেটে স্বস্তি ফিরুক।
লেখক: সাংবাদিক