চলমান অর্থনৈতিক সংকটে মুদ্রানীতির গ্রহণযোগ্যতা
ঢাকায় করোনার সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছিল ২০২০ সালে। করোনার সংক্রমণের আগে কারওয়ান বাজারের একজন ব্যবসায়ী প্রাত্যাহিক জীবনের ব্যয় নির্বাহ করে আরো কিছু অর্থ সঞ্চয় করতে পারতেন। কিন্তু করোনার সংক্রমণ রোধে সরকারের দেওয়া টানা লকডাউনে কারণে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবার পরও আগের মতো আশানুরুপ ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি অর্থনীতি। ফলে একদিকে অনেকের পেশা পরিবর্তন করতে হয়েছে। অন্যদিকে কারওয়ান বাজারের একজন ব্যবসায়ীর মতো অনেকেই ঋণের বোঝা নিয়ে ফুটপাতে স্থানান্তরিত হতে হয়েছে।
আবার দেশে করোনা সংক্রমণের ভাটা পড়তে না পড়তে বর্হি:বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, দেশে দেশে অস্থির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থা সবমিলিয়ে অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাও বেসামাল। একদিকে যেমন নিত্য পণ্যের লাগামহীন দাম অন্যদিকে খাদ্য পণ্যের বাইরে প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোও এখন মিলছে না আগের দামে । তেল, গ্যাস বাসা ভাড়া সব খানেই যেন বাড়তি দাম সাধারণ মানুষগুলোর করুন অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর জেকেঁ বসেছে। উন্নতির স্বপ্নে বিভোর থাকা উদ্যোক্তারাও এখন কোনো রকম ব্যবসা টিকে থাকলেই হবে, এমন ভাবনায় দিন কাটাচ্ছেন।
এ অবস্থায়, ক-দিন পরেই, চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় ভাগ অথ্যাৎ আগামী ছয় মাস বাজারে ঠিক কতোটা অর্থের সরবরাহ থাকা উচিত, সাধারণ মানুষের জীবন যাপনের খরচ কতোটুকু লাগামের মধ্যে রাখা যায় কিংবা সরকার বা বেসরকারি খাত কতোটুকু ঋণ পাবে সেসব সূচকগুলোর লক্ষ্যমাত্রা নিধার্রণ করে ঘোষণা দিতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যা অর্থনীতির ভাষায় মুদ্রানীতি বলে অভিহিত করা হয় ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছিলেন, দেশের এই অভ্যন্তরীণ ও বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘বাস্তবধর্মী মুদ্রানীতি’ ঘোষণা করতে চান তারা । আর এ জন্য এরই মধ্যে সব পক্ষের মতামত নেওয়া শুরু হয়েছে। অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, কিংবা সরকারপক্ষীয়, সব পক্ষ-ই যে মতামত দিক না কেমন এই বাস্তবধর্মী মুদ্রানীতি ঠিক কেমন হবে এটিই এখন প্রশ্ন ? কিংবা এটি ঠিক কতোটা রাজস্ব নীতি কাঠামোর সাথে মেলবন্ধন ঘটিয়ে অর্থনীতিকে বিশেষত সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেবে সেটি ভাববার বিষয়। বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য এরই মধ্যে আভাস দিচ্ছে, রিজার্ভ মানি ও ব্যাপক মুদ্রার জোগান প্রথম ছয় মাসের জন্য নির্ধারিত সিলিংয়ের অনেক নিচে রয়েছে।
এর অর্থ বর্তমানে বাজারে যে পরিমাণ টাকার প্রবাহ থাকার কথা, তার তুলনায় কম আছে। ফলে বিদ্যমান সিলিংয়ের ভেতরেই বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। নতুন মুদ্রানীতিতে বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়ানোর সেই পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে। আবার অর্থনীতিতে চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ বেশ বাড়ছে। আবার এই সময়ে বৈদেশিক সম্পদের পরিমাণ কমার পাশাপাশি চড়া মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধিতেও ভাটা চলছে। এতে ব্যাংক খাতে চলছে তারল্য সংকট। এই সংকট মোকাবিলায় নতুন মুদ্রানীতিতে বাজারে টাকার প্রবাহ আরও বাড়ানো ও বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আনার ওপর জোর দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের।
যদিও এর আগে একাধিকবার তথ্য উপাত্ত দিয়েই বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছিল ব্যাংক খাতে কোনো তারল্য সংকট নেই বরং বাড়তি দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি আছে। এ সময়ে আমানতের কোনো ভাটা পড়েনি উল্টো বেড়েছে গ্রাহকদের ব্যাংকে টাকা রাখার পরিমাণ।
এদিকে, চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাজারে রিজার্ভ মুদ্রা বাড়ানোর বছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ শতাংশ। এর বিপরীতে অক্টোবর পর্যন্ত রিজার্ভ মুদ্রা বেড়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এর কারণ হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে , এবার বৈদেশিক মুদ্রার অন্তঃপ্রবাহ কম হওয়ায় রিজার্ভ মানির প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে। আর বৈদেশিক মুদ্রার অন্তঃপ্রবাহ কমার কারণ হচ্ছে প্রবাসী আয় রফতানি আর বৈদেশিক ঋণ ছাড়ে ধীরগতি। এ ছাড়া রপ্তানি আয় প্রবৃদ্ধি হলেও তা অন্যান্য বছরের তুলনায় ততটা আশাব্যঞ্জক না । রিজার্ভ মুদ্রার পাশাপাশি ব্যাপক মুদ্রার লক্ষ্যমাত্রাও নিচেই রয়েছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে গত অক্টোবর পর্যন্ত বার্ষিক ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। এদিকে, চলতি মুদ্রানীতিতে জুন পর্যন্ত রিজার্ভ ও ব্যাপক মুদ্রার প্রবৃদ্ধি ধরা আছে যথাক্রমে ৯ শতাংশ ও ১২ দশমিক ১ শতাংশ। নতুন মুদ্রানীতিতে এই সিলিংয়ের মধ্যেই রিজার্ভ ও ব্যাপক মুদ্রার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হবে, যাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেখে বাজারে প্রয়োজনীয় টাকার জোগান বাড়ানো সম্ভব হয়।
চলতি অর্থবছরে যে মুদ্রানীতি চলমান অবস্থায় আঠে তার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণের গতি বেশ আগেই পূরণ হয়েছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাত প্রায় ১৪ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে যেখানে লক্ষ্যমাত্রা-ই ছিলো ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩২ দশমিক ৩ শতাংশ। এর বিপরীতে অক্টোবর পর্যন্ত বেড়েছে ৩২ দশমিক ১১ শতাংশ।
এ অবস্থায় , আসছে যে মুদ্রা নীতি তাতে বাজারে টাকার জোগান আরও বাড়ানো হলে মূল্যস্ফীতিতে আরও চাপ তৈরি হতে পারে । এতে সাধারণ মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে। বরং বৈদেশিক মুদ্রার যোগান বাড়াতে প্রবাসী আয় আর রফতানি কিভাবে বাড়ানো যায় সেজন্য এখন বাস্তবসম্মত কৌশল খোজাঁ উচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের। প্রবাসী আয় বাড়াতে গতানুগতি উদ্যোগগুলোর পাশাপাশি যেসব দেশে ব্যাংকিং শাখা নেই অথচ বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশীরা কাজ করেন ( মোজাম্বিক, দক্ষিণ আফ্রিকা ) সেসব দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সমন্বয় করে প্রবাসী আয় দেশে আনা যায় আবার বাংলাদেশী দূতাবাস গুলোও রেমিট্যান্স আহরণে তাদের কার্যক্রম যেন বাড়াতে পারে সে উদ্যোগ নিতে হবে বিশেষত করে হুন্ডি বন্ধে। রফতানি বাড়াতে পোশাক খাতের বাইরে চামড়া প্লাষ্টিকসহ অন্যান্য খাতকে এগিয়ে নিতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
চলতি মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রা যায়-ই থাকুক না কেন , মনে রাখতে হবে এই মুদ্রানীতি যখন ঘোষণা করেছিলো বাংলাদেশ ব্যাংক তখন বিশ্ব ও দেশীয় অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন ছিলো । এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের মূল চ্যালেঞ্জ হবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। তার পর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঠিক রাখা এবং বৈদেশিক মুদ্রার বাজারের অস্থিরতা দূর করা। এর সঙ্গে রয়েছে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ। এই বিষয়গুলো শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের নয়, সরকারের অন্য অনেক প্রতিষ্ঠান নীতি ও পদক্ষেপের সঙ্গে জড়িত। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি এবং এর সার্বিক নীতিমালা দিয়ে সমস্যাগুলোর সমাধান করা সম্ভব নয়। এজন্য দরকার হলো একটি সমন্বিত পদক্ষেপ এবং সেটি দ্রুত গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক খাত নিয়্ন্ত্রণে অর্থ মন্ত্রণালয় ও সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, যেকোনো নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেই, বিশেষ করে মনিটারি ট্রান্সমিশন মেকানিজমটি সংশ্লিষ্টদের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কর্মদক্ষতার ওপর নির্ভর করে। এ ক্ষেত্রেও সামষ্টিক অর্থনীতির স্তর থেকে শুরু করে মধ্য স্তরে যারা আছে, যেমন বাজার, ব্যাংক, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা হিসেবে বিডা ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো এবং সবশেষে স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় তৈরি না হলে পরিস্থিতি এখন সামাল দেওয়া কঠিন।
আবার মুদ্রানীতির সঙ্গে রাজস্বনীতির একটি গভীর সংযোগ তৈরি করতে হবে। রাজস্বনীতির বেহাল দশায় বাজেট ঘাটতি হয়, সরকারের রাজস্ব আহরণ কাঙ্খিত হারে না হওয়ায় কোনো ক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে বরাদ্দ কমে যায়, কোথাও আবার প্রণোদনা দিতে হয়। ফলে এটাকে মুদ্রানীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে হবে। আবার মুদ্রানীতি যদি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তা হলে এর মাধ্যমে বাজারে অর্থের সরবরাহ কমাতে সার্বিক চাহিদা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হয়। কিন্তু এর বিপরীতে যদি বড় বড় প্রকল্প দাঁড় করানো হয়, সরকারিভাবে বড় আকারের আমদানি অব্যাহত থাকে এবং সরকারি খাতে বড় আকারে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন হয়, তা হলে তা মুদ্রানীতির জন্য বিপরীতমুখী পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হয়।
তবে এ কথাও মনে রাখা দরকার, আসলে মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক করে না, তেমনি মুদ্রানীতির মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন বা প্রয়োগ করার স্বাধীনতাও এ সংস্থার এখন আর ততটা নেই। এর আগে আমরা দেখেছি, ঋণের সুদহার ঠিক করা হয়েছে ব্যবসায়ীদের চাপে, তাঁদের খুশি করতে। মুদ্রানীতির আলোকে কিন্তু নয়-ছয় শতাংশ সুদহার বাংলাদেশ ব্যাংক ঠিক করেনি। ফলে তা বাড়ানোর এখতিয়ারও কার্যত তাদের নেই। এটি এখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
তারপরও মুদ্রানীতির সফল বাস্তবায়নের কথা যখন বলা হচ্ছে তখন কেবল আর্থিক সূচকগুলোর উন্নতি করন নয় পাশাপাশি সার্বিকভাবে গুরুত্ব দিতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার কার্যক্রমের ওপর, যাতে ব্যাংক ও আথিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাঠামোগতভাবে শক্তিশালী করা যায়। সংস্কার বলতে আইনগতভাবে ব্যাপক পরিবর্তন নয় তবে আইনের ক্ষেত্রে কিছু ধারা অবশ্যই পরিবর্তন প্রয়োজন। ব্যাংকের পরিচালনায় পরিবার তন্ত্র বন্ধ, ঋণের প্রভিশনিং ও পুনঃতফসিলীকরণ করার মতো কিছু নীতিতে হাত দিতে হবে। কারণ এগুলো উল্টো ফল দিচ্ছে। আমানতকারীদের আস্থা ফেরাতে ব্যাংক খাতে আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার পাশাপাশি কোনো একটি শক্তিশালী নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করা যায় কি না সেটি ভাবতে হবে । না হলে মুদ্রানীতির মতো পদক্ষেপগুলো প্রয়োজনীয়তা হারাবে বাস্তবতার কাছে।
লেখক : সাংবাদিক, একাত্তর টেলিভিশন