নওগাঁয় বেড়েছে ঠান্ডাজনিত রোগ, বেশি ভুগছে শিশুরা
দেড় বছরের শিশু সাদিয়াকে নিয়ে নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার বিলাশবাড়ী গ্রাম থেকে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট নওগাঁ আধুনিক হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের সামনে করিডরের মেঝেতে বিছানো শয্যায় বসেছিলেন মা মৌসুমী খাতুন। একটু পর পর মেয়ের নাক মুছে দিচ্ছিলেন। মৌসুমী খাতুন বলেন, ‘তিন-চার দিন ধরে ছাওয়ালটার সর্দি লাগিছে। সর্দির চোটত গতকালকা থ্যাকে বুকের দুধও খ্যাতে পারোছে না। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ডাক্তার বলল, হামার মেয়ের নিউমোনিয়া হছে। ছাওয়ালক সুস্থ্ করার জন্য হাসপাতালত ভর্তি করাছি।’
মৌসুমীর মতো অনেকে অভিভাবকই নওগাঁ সদর হাসপাতালে শিশুকে নিয়ে ভিড় করছেন। আট মাসের শিশু জোবায়েরের পুরো শরীরে গরম কাপড় জড়ানো। জরুরি বিভাগের চিকিৎসকের পরামর্শের পর জোবায়েরকে হাসপাতালে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তার বাবা-মা।
জোবায়ের বাবা শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘চার-পাঁচ দিন ধরে ছেলে অসুস্থ। জ্বর-কাশি কিছুতেই কমছে না। সর্দির কারণে বুকের দুধও ঠিক মতো খেতে পারছে না। জরুরি বিভাগে চিকিৎসককে দেখানোর পর চিকিৎসক বলেছেন, আমার ছেলের নিউমোনিয়া হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শে ছেলে হাসপাতালে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা নওগাঁয় শীতে স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডাজনিত নানা রোগে শিশু ও বৃদ্ধদের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বেড়েছে। জেলার হাসপাতালগুলোতে নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কিওলাইটিস, অ্যাজমা, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দ্বিগুনের বেশি। এর মধ্যে বেশিরভাগই শিশু।
গতকাল শুক্রবার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট নওগাঁ সদর হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, শয্যা সংখ্যা ১২টি হলেও দুপুর ১২টা পর্যন্ত ওই ওয়ার্ডে শিশু ভর্তি ছিল ৮৫ জন। শয্যা সংকটের কারণে একই বেডে দুইজন-তিনজন করে শিশু রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আবার অনেকে বেড না পেয়ে ওয়ার্ডের মেঝে এবং হাসপাতালের করিডরে মেঝেতে শিশুকে রেখে চিকিৎসা করাচ্ছেন।
নওগাঁ সদর হাসপাতালে গত সাত দিনে নিউমোনিয়ায় ভর্তি হয়েছে ৬৮ জন শিশু। আর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে এই সাত দিনে ভর্তি হয়েছে ১৭৫ জন শিশু। অর্থাৎ প্রতি দিন ৩৪ জনের বেশি শিশু রোগী নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হচ্ছে।
শিশু ওয়ার্ডের সিনিয়র স্টাফ নার্স রোজিনা আক্তার বলেন, ‘অন্যান্য সময়ে শিশু ওয়ার্ডে ৩০ থেকে ৩৫ জন করে শিশু ভর্তি থাকে। সেখানে গত ১৫-২০ দিন ধরে প্রতিদিন কমপক্ষে ৬০ জন শিশু ভর্তি থাকছে। ফলে চিকিৎসকদের পাশাপাশি এত রোগীর চাপ সামলাতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।’
নওগাঁ সদর উপজেলার হাঁপানিয়া এলাকার বাসিন্দা শেফালী আক্তার দুই দিন ধরে হাসপাতালের মেঝেতে শয্যা নিয়ে সাড়ে তিন বছর বয়সী মেয়ে জেসমিনকে নিউমোনিয়া চিকিৎসা করাচ্ছেন। শেফালী বলেন, ‘কোনো সিট খালি নাই। হাসপাতালে প্রতিদিন এত অসুস্থ বাচ্চা আসছে ভাবা যায় না। শ্বাসকষ্টের শিশু রোগী বেশি হওয়ার কারণে গ্যাস (অক্সিজেন) দেওয়ার জন্য লাইন ধরে থাকা লাগতেছে।’
নওগাঁ সদর হাসপাতালের শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ রতন কুমার সিংহ বলেন, ‘শীতের সময় শিশুদের ব্রঙ্কিওলাইটিস, নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ার প্রকোপ বেশি দেখা যায়। সাধারণত হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ২৫-৩০ জন রোগী ভর্তি থাকে। কিন্তু ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে সেই সংখ্যা দ্বিগুন হয়ে যায়। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে ঠান্ডাজনিত রোগ হলেই বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। এ সময়টাতে শিশুদের গরম ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো অব্যাহত রাখতে হবে। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে ঘরের বাইরে বের হবেন না। মায়েদেরও ঠান্ডা লাগানো যাবে না।’
শুধু নওগাঁ সদর হাসপাতালেই নয়, জেলার ১০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে।
নওগাঁর সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত সপ্তাহে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে জেলার ১০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৭০ শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আর ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৪৪৮ জন। আক্রান্ত রোগীদের বেশির ভাগই শিশু।
নওগাঁর সিভিল সার্জন আবু হেনা মো. রায়হানুজ্জামান বলেন, ‘এক সপ্তাহে নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৫০০ অধিক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়াকে ঠিক অস্বাভাবিক না বললেও অন্যান্য সময়ের তুলনায় এই সংখ্যা বেশি। তবে এটা এখনও প্রার্দুভাব পর্যায়ে যায়নি। পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ ও রোগীদের জন্য কম্বল রয়েছে।’
নওগাঁর বদলগাছী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ অফিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসের প্রথম ১৩ দিনে নওগাঁয় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কখনও ১০ ডিগ্রির ওপরে যায়নি। গতকাল সকাল ৯টায় জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত বৃহস্পতিবার নওগাঁয় এই মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৬ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।