সাদা চোখে
চারদিকে ভরসার মহাশূন্যতা
ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাহীনতার তোড়ে উচ্চ মর্যাদার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে আক্রান্ত করা হচ্ছে অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণভাবে। নিম্নমানের এবং যত্রতত্র কথাবার্তায় জাতির এ ভরসার জায়গাগুলোতে মহাশূন্যস্থান তৈরি হতে চলেছে। যে অভিভাবক বা বিশিষ্টজনদের এ নিয়ে দায় বেশি তারাও দুঃখজনকভাবে এ মন্দ চর্চায় মাত্রা ছাড়িয়ে জড়িয়ে গেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে বিচারপতি ও বিচার বিভাগের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে বিরতিহীন আক্রমণ ও ভাষা বিবেকমান যে কাউকেই লজ্জা দিচ্ছে, বিব্রত করছে। তা বিচার বিভাগের মর্যাদাহানির পাশাপাশি রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনার আতঙ্কে ভুগছেন অনেকে। দেশে ন্যায়বিচারের প্রতীক সর্বোচ্চ বিচারালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে মাঠে-ঘাটে নিম্নরুচির আলোচনা সেই শঙ্কাকে জোরালো করে তুলছে।
শ্রদ্ধা-সম্মান, ভরসার বদলে মানুষ রাজনীতিবিদ এবং সংসদ সদস্যদের নিয়ে এ নিয়ে ইয়ার্কি করে। সংসদের বাইরের রাজনীতিকরাও এখন শ্রদ্ধা-ভালোবাসার তলানিতে। এ ছাড়া রাজনীতিকরাই এখন রাজনীতিকদের চরিত্র হননের মুখপাত্রে পরিণত হয়েছেন।
সৌজন্যবোধের ধারেকাছেও থাকা দরকার মনে করছেন না তাঁরা। তাঁদের প্রতিদিনের বক্তৃতা, ভাষণ, বিবৃতির ভাষাগুলোর ৮০ শতাংশই নিচুমানে অন্যের বিষোদগার। কখনো কখনো তা ভাষায় প্রকাশেরও অযোগ্য। একজন আরেকজনকে হেন কুকথা নেই যা না ছুড়ছেন। কখনো কখনো নামছেন একান্ত গোপন স্পর্শকাতর বিষয় উদাম করার প্রতিযোগিতায়ও। বিভিন্ন সেমিনার, টক শোতে তাদের একজন আরেকজনকে তুই-তোকারি, জুতাপেটা, জিহবা টেনেছিঁড়ে ফেলার হুমকির যে নমুনা মানুষ দেখছে, তা ফুটপাতের পান-বিড়ির দোকান বা রিকশা গ্যারেজেও হয় না। ন্যূনতম মানসম্মানের তোয়াক্কা করা মানুষের জন্য এমন রাজনীতিকে এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। এটা দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য অশুভ লক্ষণ।
রাজনীতিকরা নিজেদের বিভক্তির বিষাক্ত ভাইরাস গ্রামগঞ্জেও ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে সফল হয়েছেন। বিভাজন রেখা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। দলিল লেখক থেকে দোকানি পর্যন্ত বিভক্তিতে আসক্ত। জন্ম থেকে মৃত্যু, আকিকা, খাতনা, জন্মদিন, জানাজাসহ যাপিত জীবনের কিছুই আর রাজনীতির বাইরে থাকছে না। মরণেও ক্ষমা নেই। শেষবারের মতো মুখ দেখার সামাজিক সৌজন্যও হারাতে বসেছে।
ভরসার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে আসে পুলিশের নাম। অনেক বিতর্ক, অসন্তোষের পরও আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে মানুষের ভরসার বিশেষ জায়গা পুলিশের ইমেজ তো তলানিতে ঠেকেছে আরো আগেই। পুলিশের চাঁদা, ঘুষের হাত চলে গেছে চা দোকান পর্যন্ত। চাঁদা না দেওয়ায় চা দোকানিকে পুড়িয়ে হত্যা, হিজড়াকে যৌন হয়রানির পর মোবাইল ফোনটিও কেড়ে নেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে যৌন হয়রানি, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাকে পিটিয়ে আধমরা করা, সিটি করপোরেশন কর্মকর্তাকে নির্দয়ভাবে পেটানো, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও তাঁর বান্ধবীকে রাতভর আটকে রেখে ইয়াবা সেবনকারী হিসেবে ফাঁসানোর হুমকি দিয়ে টাকা আদায়ের মতো ঘটনায় ভরসার বদলে পুলিশের অবস্থান এখন আতঙ্কের জায়গায়। বিচ্ছিন্ন ঘটনার নামে তা জায়েজ করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে পুলিশকে আমরা বিভিন্ন অপকর্মের আগাম লাইসেন্সই দিয়ে দিচ্ছি।
ক্ষমতার রাজ্যে কর্তৃত্ব ও সুবিধা হাসিলের দাওয়াই হিসেবে পুলিশসহ সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে আইনজীবী, ডাক্তার, সাংবাদিক, শিক্ষকসহ শিক্ষা-মেধা নির্ভর পেশাজীবীরাও বিভিন্ন গোত্র, দল-উপদলে আরো ক্ষমতাবান হওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত। বলতে গেলে কোনো পেশাই আর পেশাদারিত্বে নেই। পেশাজীবীদের এভাবে পরজীবী হয়ে পড়া মানুষের ভরসাকে চুরমার করে দিচ্ছে। পেশাগত কাজে তারা তত আন্তরিক নন, যত আন্তরিক রাজনৈতিক কর্মসূচিকে সফল করতে। দফতরের কাজ ফেলে রেখে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ব্যানার নিয়ে চলে যাচ্ছেন রাজনৈতিক মিছিলে। রাজনৈতিক নেতাদের সুদৃষ্টি এবং আশীর্বাদের এই নিম্নমানের কাঙালিপনার কাছে মানুষ ভরসা খুঁজবে কোন আক্কেলে? প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ক্লাসের সর্বসেরা শিক্ষার্থী ছাড়া কারো ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখার সাহস হয় না। সেই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের দলবাজি একেবারে ওপেন সিক্রেট। রোগীও জানে কোন ডাক্তার কোন দলের চোঙ্গা ফোকায়। বিভিন্ন হাসপাতালগুলোতে ঢুকলে কিছু ডাক্তার-নার্সের বিভিন্ন সাইজের ব্যানার, পোস্টার, শুভেচ্ছাপত্র দেখে বোঝার উপায় নেই এটি হাসপাতাল না ট্রেড ইউনিয়ন অফিস।
মহান পেশা হিসেবে সমাজে সমাদৃত শিক্ষকরাও নেই ভরসার জায়গায়। মুক্তচিন্তা চর্চার জায়গা বিশ্ববিদ্যালয়ও পড়ে গেছে নষ্ট রাজনীতির ঘেরাটোপে। ছাত্র নামধারীদের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিতে সমর্থন-সহায়তা জোগানোর পেছনে শিক্ষকদের সংশ্লিষ্টতা মাঝেমধ্যেই প্রকাশ পাচ্ছে। শিক্ষকদের রাজনীতি করার অধিকার থাকলেও শিক্ষণীয় চিন্তা বিকাশে তা কতটা কাজে লাগাতে পারছেন সেই নমুনা তো দেখাই যাচ্ছে। জনসম্মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অপদস্থ করার পরও সমব্যথী হয়ে কেউ তাঁদের পাশে দাঁড়ালেন না। কোথাও কোথাও তাদের গায়ে হাতও উঠেছে।
জাতির বিবেক সাংবাদিকরাও নানা দল-উপদলে ছিন্নভিন্ন। মর্যাদার সঙ্গে পেশাগত অবস্থানও প্রশ্নবিদ্ধ। বুদ্ধিজীবী মহলের কারো কারো আয়নায় মুখ দেখলে মাথা আঁচড়ানোর অবস্থা নেই। তাদের আমলনামার টুকটাক মাঝেমধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে। বিবেকবুদ্ধি, চিন্তা, স্বাধীনতা চর্চার চেয়ে তোষামোদ, দলবাজি, জোটবাজির কাছে আত্মসমর্পণ করে তারা নিজেরাও নিজেদের প্রকারান্তরে অবজ্ঞা-অসম্মানের শেষ সীমায় নিয়ে যাচ্ছেন।
রাজনীতিবিদ, সংসদ, বিচারালয়, নির্বাহী বিভাগ, পুলিশ, সাংবাদিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীসহ দায়িত্ববানদের কাছে ভরসার আশা ক্ষীণ হয়ে গেলে মানুষের আশার বাতিঘরটি কোথায়? হয় ক্ষমতার প্রতাপের কাছে আত্মসমর্পণ, নয় ভাগ্যের হাতে নিজকে সঁপে দেওয়া। এর মাঝে বা সবশেষ কথাটি হচ্ছে আল্লাহ ভরসা।
মনোবিজ্ঞানীরা ভরসা বা পারস্পরিক শ্রদ্ধা-বিশ্বাস হারানোর কারণ হিসেবে মাত্রাহীন হতাশা, রাগ, ঈর্ষাকে দায়ী করে থাকেন। আর বাচালতা, ভণ্ডামি, মিথ্যাচারকে চিহ্নিত করেন রোগ হিসেবে। আমরা আমাদের সম্ভান্ত এবং উচ্চ মর্যাদার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে মোটেই রোগী ভাবতে রাজি নই। এরপরও অনিবার্য সত্য হচ্ছে- ঔচিত্যবোধ, নীতি-নৈতিকতার বিচ্যুতিতে আস্থা-বিশ্বাস, ভরসার স্থল নষ্ট হয়ে গেলে ধস ঠেকানো যায় না। তখন অন্ধ সাজার চেষ্টা করা যায়, কিন্তু প্রলয় থামানো যায় না।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন