বঙ্গবন্ধু স্বল্পতম সময়ে জাতিকে শাসনতন্ত্র উপহার দিয়েছিলেন : আওয়ামী লীগ
গণপরিষদ নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অবিচল ছিলেন। তাই তিনি স্বল্পতম সময়ে মাত্র ৭ মাসে জাতিকে শাসনতন্ত্র উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান তা ২৫ বছরেও পারেনি। ভারত শাসনতন্ত্র প্রণয়নে নিয়েছিল তিন বছর। যুক্তরাষ্ট্রের লেগেছিল ৫ বছর ৯ মাস।
জাতীয় সংসদের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে কার্যপ্রণালী বিধির ১৪৭ ধারায় ৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা আনীত এক প্রস্তাবের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা আজ শনিবার (৮ এপ্রিল) একথা বলেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সংসদের পথচলা বার বার হোঁচট খেয়েছে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সংসদ বাতিল করা হয়েছিল এবং সংসদীয় গণতন্ত্র বাতিল করে তখন সামরিকতন্ত্র চালু করা হয়েছিল। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে সংসদ নির্বাচনের পর প্রকৃতপক্ষে মার্শাল ডেমোক্রেসি চালু করেছিল। ওই নির্বাচনের পর যে ব্যক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিল, যে ব্যক্তি পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের ডেপুটি লিডার হিসেবে জাতিসংঘে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করে বক্তব্য রেখেছে-‘তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কোনো গণহত্যা হচ্ছে না, ভারতীয় চররা, ভারতের দোসররা কিছু গণ্ডগোল করছে মাত্র’। এই ব্যক্তিকে সংসদ নেতা বানানো হয়েছিল।’
তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে ১৯৮৮ সালে প্রধান দলগুলোবিহীন একটি নির্বাচন করে তখন আ স ম রবকে গৃহপালিত বিরোধী দলীয় নেতা বানিয়ে সংসদকে হাস্যকর স্থানে পরিণত করা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি বেগম খালেদা জিয়া ভোটার বিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি কর্ণেল রশীদকে বিরোধী দলীয় নেতা বানিয়ে সংসদকে কলঙ্কিত করেছিল। এই সংসদে বিভিন্ন সময় বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্যরা অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল ও অসংসদীয় ভাষা ব্যবহার করেছে। যেভাবে সংসদের মাইক, খাতাপত্র, বইপত্র ছুঁড়েছে, এতেও সংসদের মানমর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে।’
তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী বলেন, ‘সবচেয়ে দুঃখজনক হলো ২০০৭ সালে এই সংসদের স্পিকারের বাসভবন, চিফ হুইপের বাসভবনকে কারাগারে রূপান্তর করা হয়েছে এবং এই সংসদে জননেত্রী শেখ হাসিনা যিনি প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা, বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁর বিচারের জন্য এখানে আদালত বসানো হয়েছিল। একই সাথে বেগম খালেদা জিয়া যিনি প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতার দায়িত্ব পালন করেছেন, তার বিচারের জন্যও এখানে আদালত বসানো হয়েছিল। এভাবে এই সংসদ চত্ত্বরকে, সংসদকে কলঙ্কিত করা হয়েছিল। এটি স্পষ্টত সংসদকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য। সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গলী প্রদর্শন করার জন্য, গণতন্ত্রকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য ২০০৭ সালে ঢাকা শহরে এতো জায়গা থাকা সত্বেও এখানে আদালত বসানো হয়েছিল এবং এখানে কারাগার বানানো হয়েছিল। সেই কাজটি যারা করেছিলেন, তারা দায়িত্ব এড়াতে পারে না। সংসদের ৫০ বছর পূর্তিতে বলতে চাই- যারা এই কাজটি করেছিলেন, তাদের বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন কিনা, সেটি ভেবে দেখা প্রয়োজন।’
ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘সংসদীয় গণতন্ত্র এবং উন্নয়ন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। গণতন্ত্রের পথচলা যদি মসৃণ না হয়, উন্নয়ন কখনো হয় না। গণতন্ত্রের নামে কসমেটিক সার্জারি হয়। যখন সংসদীয় গণতন্ত্র ছিল না, মার্শাল ডেমোক্রেসী ছিল, কখন কসমেটিক সার্জারির মতো উন্নয়ন হয়েছিল। প্রকৃত উন্নয়ন তখন হয়নি। গত তিনটি সংসদে নিরবচ্ছিন্নভাবে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু থাকার এবং সংসদে জবাবদিহিতা থাকার প্রেক্ষিতে দেশে উন্নয়ন অগ্রগতি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতির প্রশংসা করা হচ্ছে।’
তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৯১ সালে নির্বাচনের পর যখন রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা ছিল, তখন বঙ্গবন্ধু কন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য দাবি উপস্থাপন করেছিলেন। সেই দাবি নিয়ে অনেক টালবাহানা হয়েছিল। বিএনপি এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সংসদ নেতা বেগম খালেদা জিয়া এতে রাজি ছিলেন না। অনেক টালবাহানার পর শেখ হাসিনার সহযোগিতার মাধ্যমে তৎকালীন বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের ভোট দানের মাধ্যমে আমরা আবার সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে এসেছিলাম।’
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘আমরা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তুলবো, তবে যারা ৭১, ৭৫ এবং ২০০৪ সালে হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ছিল তাদেরকে প্রতিহত করতে হবে।’
গণপরিষদের সাবেক সদস্য ও ময়মনসিংহ-৬ আসনের সদস্য মো. মোসলেম উদ্দিন বলেন, ‘গণপরিষদ নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অবিচল ছিলেন। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে তিনি স্বল্পতম সময়ের মধ্যে দেশের জন্য একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন। মাত্র ৭ মাসে তিনি জাতিকে শাসনতন্ত্র উপহার দিয়েছিলেন। পাকিস্তান তা ২৫ বছরেও পারেনি, ভারত তাদের শাসনতন্ত্র প্রণয়নে নিয়েছিল ৩ বছর।’
মোসলেম উদ্দিন বলেন, ‘জাতির পিতার দ্বিতীয় স্বপ্ন বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর অভিষ্ট লক্ষে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমরা বিশ্বাস করি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রূপকল্প-২০৪১ অর্জনের দিকে বিশ্বের বিস্ময় বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।’
গণপরিষদের সাবেক সদস্য ও নওগাঁ-৪ আসনের সদস্য মুহা. ইমাজ উদ্দিন প্রামানিক বলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। জাতির পিতা ছিলেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অবিচল। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রয়েছে। বিশ্বের কোনো দেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা নেই। কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেননি।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার অর্জনের জন্য ২৩ বছর বাংলার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।’
বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা। তিনি ওই সময়ে উপলব্দি করেছিলেন কৃষি ও শিল্প খাতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন করতে হবে। তাঁর সময়োচিত সিদ্ধান্তে তিতাস, হবিগঞ্জ, কৈলাসটিলা, বাখরাবাদ ও রশিদপুর-এ পাঁচ গ্যাসক্ষেত্র ক্রয়ে ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট চুক্তি সই হয়। বঙ্গবন্ধু গ্যাসক্ষেত্রগুলো রাষ্ট্রীয়করণ করেন। এখনও দেশীয় কোম্পানির সরবরাহকৃত গ্যাসের ৮২ শতাংশ যোগান দিচ্ছে বঙ্গবন্ধুর কেনা এ ৫টি গ্যাসক্ষেত্র।’
জাসদের হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের শাসনতন্ত্র ও সার্বভোম সংসদের প্রতিষ্ঠাতা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান দেশের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে শাসনতন্ত্রকে কাটছাট করে এই সার্বভৌম সংসদকে অকার্যকর করে। বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের শাসনতন্ত্র ও গণতন্ত্রকে পুনপ্রতিষ্ঠা করে সার্বভৌম সংসদের মর্যাদা ফিরিয়ে আনেন।’
ওয়ার্কার্স পার্টির সদস্য রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এর পথচলা মসৃণ ছিল না। বারবার এই সংসদ আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, সংসদকে অকার্যক্রর ও ঠুটো জগন্নাথে পরিণত করা হয়েছে। ৭৫ পরবর্তী সময়ে খন্দকার মোশতাক এই সংসদকে দিয়ে নিজের ক্ষমতা বৈধ করার অপচেষ্টা করেছে। জিয়া কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে এই সংসদকে কলঙ্কিত করেছে। এভাবে বিভিন্ন সময়ে দেশের শাসনতন্ত্র ও সার্বভৌম সংসদকে ক্ষত-বিক্ষত করার চেষ্টা হয়েছে।’
সংসদ সদস্যরা বলেন, গণতন্ত্র রক্ষা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার সবসময় কাজ করে গেছেন। এই গণতন্ত্রকে নসাৎ করতে স্বাধীনতা বিরোধী চক্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
তারা বলেন, জাতির পিতা ও তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা সারা জীবন গণতন্ত্র ও সার্বভৌম সংসদ প্রতিষ্ঠার লক্ষে আন্দোলন করে গেছেন। আর বিএনপি বারবার এই সংসদকে কলঙ্কিত করেছে। তারা কুখ্যাত স্বাধীনতা বিরোধী আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে সংসদের স্পিকার, বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্ণেল রশিদকে বিরোধী দলের নেতা এবং যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে মন্ত্রী বানিয়ে এই জাতীয় সংসদকে অপবিত্র করেছে।
শাজাহান খান, মো. আব্দুস শহীদ, আ স ম ফিরোজ, আবুল কালাম আজাদ, সিমিন হোসেন রিমি, মো. সাইফুজ্জামান, নাহিম রাজ্জাক, সৈয়দা জাকিয়া নুর, তানভীর শাকিল জয়, বেগম হাবিবা রহমান খান, জাতীয় পার্টির সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, বেগম রওশন আরা মান্নান ও মশিউর রহমান রাঙ্গা আলোচনায় অংশ নেন।