দুর্নীতি-কেলেঙ্কারিসহ আইপিএলে আলোচিত যত ঘটনা
২০০৮ সালে আবির্ভাবের বছর থেকেই আইপিএল যতটা জনপ্রিয়তা পেয়েছে, ততটাই একের পর এক বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়েছে জনপ্রিয় এই টুর্নামেন্টকে ঘিরে। প্রচুর টাকার হাতছানি, উদ্দাম নাচ-গান, চিয়ার লিডারদের দাপাদাপিসহ একাধিক বিতর্ক রয়েছে আইপিএলের নামের পাশে। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক আইপিএলের বিতর্কিত যত ঘটনা।
১. স্পট ফিক্সিংয়ের জন্য নির্বাসিত ৩ ভারতীয় ক্রিকেটার
২০১৩ সালে রাজস্থান রয়্যালসের তিন ক্রিকেটার শ্রীশান্ত, অঙ্কিত চৌহান ও অজিত চান্ডিলাকে দিল্লি পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। তিনজনের বিরুদ্ধে ম্যাচ গড়াপেটার গুরুতর অভিযোগ উঠেছিল। দীর্ঘ আট বছর নির্বাসনে থাকার পর শ্রীশান্তের নির্বাসন তুলে নেওয়া হয়। কেরলের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলছেন এই ডানহাতি পেসার।
২. চেন্নাই সুপার কিংস ও রাজস্থান রয়্যালসকে দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা
২০১৩ সালের ম্যাচ ফিক্সিং বিতর্কের পর নতুন করে তদন্ত করে বিসিসিআই। সেখানেই উঠে আসে বিসিসিআই সভাপতি এন শ্রীনিবাসনের জামাই গুরুনাথ মেইয়াপ্পন চেন্নাই সুপার কিংসের ম্যাচে বেটিং করেছেন। এ দিকে রাজস্থান রয়্যালসের অন্যতম মালিক রাজ কুন্দ্রাও বেটিংয়ে দোষী সাব্যস্ত হন। এই ঘটনার জেরে চেন্নাই ও রাজস্থান রয়্যালসকে দুই বছরের জন্য নির্বাসিত করেছিল বোর্ড। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে ফের আইপিএল খেলার সুযোগ পায় চেন্নাই ও রাজস্থান।
৩. কলকাতা নাইট রাইডার্স থেকে সৌরভ গাঙ্গুলিকে ছাঁটাই
সময়টা ২০০৮ থেকে ২০১১। কলকাতা নাইট রাইডার্সের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। তবে ২০০৮ সালে তৎকালীন কোচ জন বুকাননের ‘মাল্টিপল ক্যাপ্টেন্স থিওরি’র জন্য মহারাজের সঙ্গে তাঁর বিরোধিতা প্রকাশ্যে এসেছিল। এর পরের বছর সৌরভ দলের পূর্ণ দায়িত্ব পেলেও পারফরম্যান্সের উন্নতি হয়নি। ফলে ২০১২ সালের নিলামে বেহালার বাঁহাতি অবিক্রিত রয়ে যান। এরপরেই গোটা কলকাতাজুড়ে ‘নো দাদা নো কেকেআর’ স্লোগান উঠেছিল।
৪. ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে শাহরুখ খানের নিষেধাজ্ঞা
২০১২ সালের ১৬ মে কলকাতা নাইট রাইডার্স ও মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের ম্যাচ শেষ হওয়ার পরে ওয়াংখেড়ের মাঠে নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন শাহরুখ খান। অভিযোগ ছিল, ম্যাচ শেষের পরে মদ্যপ শাহরুখ অশ্লীল আচরণ করেন। যদিও শাহরুখের বক্তব্য ছিল, মাঠে থাকা তাঁর বাচ্চা ও বন্ধুদের সঙ্গে সঠিক আচরণ করেননি নিরাপত্তারক্ষীরা। সেটা ঠেকাতেই তিনি মাঠে ঢোকেন। এর ফলে পাঁচবছর শাহরুখের ওয়াংখেড়েতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
৫. বিরাট কোহলি ও গৌতম গম্ভীর ঝামেলা
সময়টা ২০১৩। বেঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে আইপিএলের জমজমাটপূর্ণ ম্যাচে মুখোমুখি হয় কেকেআর বনাম আরসিবি। ম্যাচের দশ নম্বর ওভারে আউট হয়ে ড্রেসিংরুমে ফেরার বদলে সেদিন বিরাট কোহলি এগিয়ে গিয়েছিলেন এক্সট্রা কভারের দিকে। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেকেআরের অধিনায়ক গৌতম গম্ভীর। বিরাট কিছু একটা বলতেই গম্ভীর তেড়ে যান তার দিকে। একপর্যায়ে দুজন মারমুখি হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে অন্য ক্রিকেটারদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত করা হয়।
৬. মহেন্দ্র সিং ধোনি ও আম্পায়ারের মধ্যে ঝামেলা
২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল রাজস্থান রয়্যালসের বিপক্ষে শেষ ওভারে চেন্নাই সুপার কিংসের জয়ের জন্য দরকার ছিল ১৮ রান। শেষ ওভারের প্রথম বলে রবীন্দ্র জাদেজার কাছে ছক্কা খেয়েছিলেন বেন স্টোকস। তবে তৃতীয় বলেই কামব্যাক করেন ইংলিশ অলরাউন্ডার। নিখুঁত ইয়র্কারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন ধোনির স্ট্যাম্প। সেই সময় চেন্নাইয়ের জেতার জন্য তিন বলে আট রান দরকার ছিল। মিচেল স্যান্টনারকে করা ওভারের চতুর্থ বল ছিল ফুলটস। আম্পায়ার নো বল দিলেও, দ্রুত তাঁর সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন। আর এরপরেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পরিবেশ। জাদেজা প্রতিবাদ জানানোর সময় দেখা যায় ধোনিও মাঠে ঢুকে এসেছেন। মেজাজ হারিয়ে একেবারে হাত-পা নেড়ে দুই আম্পায়ারের সঙ্গে জুড়ে দেন তর্ক। এমন ঘটনার জন্য বন্ধ ছিল ম্যাচ। বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়কের ভিন্ন রুপ দেখে চমকে উঠেছিল ক্রিকেট বিশ্ব।
৭.ঋষভ পন্থ ও আম্পায়ারের মধ্যে ঝামেলা
গত বছর ২২ এপ্রিল ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয়েছিল দিল্লি ক্যাপিটালস ও রাজস্থান রয়্যাল। হাই স্কোরিং ম্যাচের শেষ ওভারেই যত বিতর্ক। ওবেদ ম্যাককয়ের এক ফুলটস বল আম্পায়ার নো বল না দেওয়ায় একেবারে ক্ষেপে লাল হয়ে যান ঋষভ পন্থসহ দিল্লির অন্যান্য ক্রিকেটাররা। রাজস্থানের বিরুদ্ধে শেষ ওভারে দিল্লির জয়ের জন্য ৩৬ রান দরকার ছিল। ওভারের প্রথম তিন বলে নাগাড়ে তিনটি ছক্কা হাঁকান রোভম্য়ান পাওয়েল। তবে তৃতীয় বলটি ফুলটসে পাওয়েলে কোমরের উপরের ছিল বলে দিল্লির তরফে দাবি জানানো হলেও, আম্পায়ার তা নো বল দেননি। এক সময় তো ক্ষোভে খেলা ফেলে রেখে ক্রিকেটারদের মাঠ থেকে উঠে আসার আহ্বান জানান পন্থ। তবে শেষমেশ লাভের লাভ কিছুই হয়নি। ১৫ রানে ম্যাচ হেরে যায় দিল্লি এবং বলটিকেও নো বল ঘোষণা করা হয়। আম্পায়ারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ ও মাঠ থেকে দল তুলে দেওয়ার জন্য ঋষভ, শার্দুল ঠাকুর ও সহকারী কোচ প্রবীণ আমরেকে শাস্তির মুখে পড়তে হয়।
৮. হরভজন-শ্রীশান্ত চড় বিতর্ক
২০০৮ সালে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের তৃতীয় ম্যাচের শেষে ক্রিকেটাররা হাত মেলানোর সময়ে হরভজন সিং চড় মেরে বসেন শ্রীশান্তকে। ভিডিও ফুটেজ অনুযায়ী শ্রীশান্ত কোনোরকম প্ররোচনাও দেননি। হরভজন তাঁর জাতীয় দলের সতীর্থ শ্রীশান্তকে চড় মেরে বাকিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলে যান। সেই ঘটনার পরে হরভজনকে বাকি আইপিএলের জন্য বাদ দেওয়া হয়। এই ব্যানের বিরুদ্ধে কোনওরকম আবেদনও জানাননি হরভজন। বলা যেতে পারে আইপিএল-এর উদ্বোধনী বছরের সবচেয়ে বড় বিতর্কিত ঘটনা ছিল এটিই।
৯. বহিষ্কৃত ললিত মোদি
আইপিএলের উদ্যোক্তা ও কমিশনার ললিত মোদীকে ২০১০ সালে আইপিএল কমিশনারের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত শুরু হয়। এরপরে ২০১৩ সালে ললিতকে বিসিসিআই থেকে বহিষ্কার করা হয়। এমনকি সেই ঘটনার পর থেকে আর দেশেও ফিরে আসেননি ললিত মোদি।
১০. চিয়ারলিডারদের সঙ্গে খেলোয়াড়দের অসভ্য আচরণ
খেলোয়াড়দের পাশাপাশি আইপিএলের মঞ্চে বিতর্ক ডেকে এনেছেন চিয়ারলিডারেরাও। ২০১১ সালের আইপিএলে ২২ বছর বয়সি দক্ষিণ আফ্রিকান চিয়ারলিডার গ্যাব্রিয়েলা পাসকুয়ালোতো খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ করে খবরের শিরোনামে উঠে আসেন। গ্যাব্রিয়েলার অভিযোগ ছিল, আইপিএলের ক্রিকেটারেরা চিয়ারলিডারদের সঙ্গে অসভ্য আচরণ করেন। সুযোগ পেলেই চিয়ারলিডারদের যৌন হেনস্তা করা হয়। এই অভিযোগের পর তুমুল বিতর্ক হয়। শেষমেষ গ্যাব্রিয়েলাকে আইপিএল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
১১. যৌন হেনস্তার অভিযোগে ক্রিকেটার গ্রেপ্তার
২০১২ সালে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর ক্রিকেটার লিউক পমার্সব্যাচ যৌন হেনস্তার অভিযোগে মুম্বাই পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। লিউক এক মহিলা জানান, লিউক তাঁকে মদ্যপানের প্রস্তাব দেন। তা নাকচ করলে মহিলার পিছু নিয়ে একটি ঘরে নিয়ে তাঁকে হেনস্তা করা। এই বিতর্কের পর ভারত ছাড়তে বাধ্য হন লিউক।
১২. মাদক কেলেঙ্কারি
২০১২ সালে মুম্বাইয়ের এক বিলাসবহুল হোটেলে হানা দিয়ে একশো গ্রাম কোকেনসহ বিভিন্ন মাদক উদ্ধার করেছিল পুলিশ। ধরা পড়েছিলেন পুনে ওয়ারিয়ার্সের জার্সিতে খেলা দুই ক্রিকেটার রাহুল শর্মা ও ওয়েন পার্নেল। সেই ঘটনায় প্রায় শতাধিকের বেশি যুবক-যুবতীকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেই ঘটনার পর দুই ক্রিকেটারের ক্যারিয়ার অনেকটাই থমকে যায়।