সুপারফুড খ্যাত চিয়া সিডের চাষ হচ্ছে পঞ্চগড়ে
পঞ্চগড়ে বাণিজ্যিকভিত্তিতে চাষ শুরু হয়েছে সুপারফুড হিসেবে খ্যাত চিয়া সিড। গত বছর কয়েকজন কৃষক এখানে পরীক্ষামূলকভাবে এর চাষ করেছিলেন। কম খরচে ভালো ফলন এবং ভালো দাম পাওয়ায় এবার বাণিজ্যিকভিত্তিতে এর চাষাবাদ শুরু করেছেন। বাম্পার ফলন হয়েছে এবার।
চাষাবাদ খরচ কম এবং বাজার মূল্য বেশি থাকায় কৃষকদের মাঝে চিয়া চাষে আগ্রহ বেড়েছে। এটি দেখতে সাদা ও কালো রঙের তিলের মতো ছোট দানার মতো। এক বিঘা জমিতে দুই থেকে ৩০০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। ৯০ থেকে ১০০ দিনের মধ্যে এই ফসল তোলা যায়। অন্যান্য ফসলের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি লাভ হয় বলে প্রতি বছরই বাড়ছে চিয়া চাষের পরিধি। এবারও চিয়ার বাম্পার ফলন হয়েছে। নতুন অর্থকরী এই ফসলের চাষাবাদে ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
স্থানীয় পর্যায়ে, দেশের বিভিন্ন শপে ও অনলাইনে প্রতি কেজি চিয়া সিড এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করে থাকে। আমদানি নির্ভর এই বিদেশি ফসলের দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব বলে মনে করছেন কৃষকসহ সংশ্লিষ্টরা।
জেলার সদর উপজেলার গরিনাবাড়ী ইউনিয়নের চারখোরা গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত ওয়ারেন্ট অফিসার আমিনার রহমান আমিন, আব্দুস সাত্তার, নিরেশ চন্দ্র এবং তেঁতুলিয়া উপজেলার কাজীপাড়া এলাকার কাজী মিজানুর রহমানসহ কয়েকজন সৌখিন কৃষক পরীক্ষামূলকভাবে বিদেশি উচ্চ মূল্যের অর্থকরী ফসল চিয়া সিডের চাষ করেছিলেন। অল্প জমিতে কম খরচে এর চাষ করে সফলও হন তারা। অন্য যেকোনো ফসলের চেয়ে খরচ ও রোগবালাই কম এবং লাভ বেশি পেয়েছেন।
এবার পঞ্চগড়ে প্রায় ২০ বিঘা জমিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চিয়া সিডের চাষ করেছেন তারা। জমি তৈরি, বীজ বপন, সার, সেচ ও নিড়ানি থেকে ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত প্রতি বিঘা জমিতে পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। বিরূপ আবহাওয়া না হওয়ায় প্রতি বিঘা জমি থেকে ১০০ থেকে ১২০ কেজি চিয়া সিড উৎপাদন করতে সক্ষম হন।
জেলার সদর উপজেলার গরিনাবাড়ী ইউনিয়নের চারখোরা গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য কৃষক আমিনার রহমান আমিন বলেন, ‘তিন বছর আগে ডা. জাহাঙ্গীর কবিরের এক প্রতিবেদনে চিয়া সিডের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জানতে পেরে চিয়া খাওয়া শুরু করি। গত বছর দেড় বিঘা জমিতে চিয়ার পরীক্ষামূলক চাষ করেছিলাম। খুব ভালো ফলন হয়েছিল। এবার আমি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ৯ বিঘা জমিতে চিয়ার চাষ করেছি। এবারও এর বাম্পার ফলন হয়েছে। আমার চাষাবাদ দেখে অনেকেই এর চাষ করছেন।’ আগামীতে এর চাষাবাদ আরও বাড়বে বলে তিনি আশা করছেন।
আমিন আরও বলেন, ‘বিদেশ থেকে যেন এর আমদানি করতে না হয় এজন্য আমি চাই এর চাষাবাদ দেশে আরও বাড়ুক। কারও যদি বীজ লাগে আমি বীজ সরবরাহ করব। গোটা বাংলাদেশে এর প্রসার লাভ করুক। আমি চাই কৃষকরা এর চাষ করে লাভবান হোক এবং যারা চিয়া খাবে তাদেরও পুষ্টি চাহিদা মিটুক।’
চিয়া বীজের বাজারে অনেক চাহিদা আছে। গত বছর আমি প্রতি কেজি এক হাজার টাকারও বেশি দামে বিক্রি করেছি। আমার কাছে অনেকেই বীজ চেয়েছেন আবার অনলাইনেও আমার কাছে অনেকে চিয়া কিনছেন।’
একই এলাকার কৃষক আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘কৃষক আমিন ভাইকে দেখে আমি চিয়া বীজ চাষ করেছি। আমি মাত্র ৩৩ শতক জমিতে এর চাষ করেছি। খুব ভালো ফলন হয়েছে। শিলা বৃষ্টি হওয়ায় ১০০ কেজির মত চিয়া বীজ উৎপাদন হয়েছে। বৃষ্টির কারণে অনেক ফল ঝরে পড়েছে নাহলে আরও বেশি ফলন পেতাম। ভালো মুনাফা পাব বলে আশা করছি। আগামীতে ১০০ শতক জমিতে এর চাষ করার ইচ্ছা আছে। চিয়া চাষে খরচ খুব একটা নেই প্রতি বিঘায় আট থেকে ১০ হাজার টাকা মাত্র খরচ হচ্ছে। তবে, অন্যান্য যে কোনো ফসলের চেয়ে এটি বেশ লাভজনক।’
জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার কাজীপাড়া এলাকার কৃষক কাজী মিজানুর রহমান মিজান বলেন, ‘আমি একজন আখ চাষি ছিলাম। সুগার মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমি বিকল্প হিসেবে পরীক্ষামূলকভাবে স্বল্প জমিতে এর চাষ করেছি। বাম্পার ফলন ও দাম ভালো পাওয়ায় এবার দেড় একর জমিতে চিয়া চাষ করেছি। ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। অনেকেই আমার কাছে চিয়া বীজ চেয়েছেন। আমি অনেককে বীজ দিতে চেয়েছি। আমার উৎপাদিত চিয়া বীজ শতভাগ অর্গানিক। আগামীতে আমি আরও বেশি জমিতে এর চাষ করব।’
মিজান আরও বলেন, ‘প্রতি একরে ১০ থেকে ১২ মন চিয়া বীজ উৎপাদন হয়েছিল। জমি তৈরি করে সেচ দিলেই এর উৎপাদন করা সম্ভব।’ এটি চাষ করলে কৃষকরা বেশ লাভবান হবেন বলেও জানান তিনি।
নতুন এই চাষাবাদে কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কাটা মাড়াইসহ নানা কাজে ১০ থেকে ১৫ জন নারী কাজ করে আসছেন। বাড়ির কাজের পাশাপাশি এখানে শ্রম দিয়ে নারী-পুরুষ শ্রমিকরা সংসারে বাড়তি টাকা আয় করতে পারছেন।
স্থানীয়রাসহ বিভিন্ন এলাকার কৃষকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ চিয়া বীজের চাষাবাদ দেখতে মাঠে আসছেন। চিয়া একটি উচ্চমূল্যের ফসল। এই ফসল চাষ যে কোনো কৃষক আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
জেলার সদর উপজেলার গরিনাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন দিপু বলেন, ‘সবচেয়ে বড় চিয়া বাগান আমার ইউনিয়নে। এজন্য আমি গর্বিত। এটি একটি লাভজনক ফসল বলে কৃষকদের কাছে শুনেছি। আমি মনে করি, চা যেমন আমাদের জেলাকে এগিয়ে নিয়েছে, তেমনি চিয়া আমাদের জেলাকে আরও এগিয়ে নেবে। এটি চাষ করে ভবিষ্যতে কৃষক উপকৃত হবে।’
তেঁতুলিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, “চিয়া বীজের বৈজ্ঞানিক নাম ‘সালভিয়া হিসপানিকা’। এটি মূলত মেক্সিকোসহ ইউরোপের দেশগুলোতে চাষ হয়। চিয়াতে প্রচুর পরিমাণে অমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, কোয়েরসেটিন, কেম্পফেরল, ক্লোরোজেনিক, ক্যাফিক অ্যাসিড নামক অ্যান্টি অডিক্সপেন্ট, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, ক্যালসিয়াম এবং দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয় আঁশ জাতীয় খাদ্য হওয়ায় এটি পুষ্টি নিরাপত্তাসহ মানবদেহের জন্য যথেষ্ট উপকারী। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল এবং এ জেলার মাটি ও আবহাওয়া চিয়া চাষের উপযোগী। চিয়া সিডের চাহিদা থাকায় কৃষকরা ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন। কৃষি বিভাগ কৃষকদের সব ধরনের সহযোগিতা করছেন।’
কৃষি কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আরও জানান, ‘খোরপোষ কৃষিতে নয়, আমরা বাণিজ্যিক কৃষিতে রয়েছি। বাণিজ্যিক কৃষিতে কৃষকদের লাভবান করতে হবে। সেক্ষেত্রে চিয়া খুবই প্রমিজিং একটি ফসল। প্রতিটি সুপার শপে চিয়া বীজ পাওয়া যায়। এটি কৃষকের জন্য অনেক লাভজনক। এটি চাষে কৃষকরা যেন আগ্রহী হন, এ বিষয়ে আমরা কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি। আমরা বীজ সংরক্ষণের কথা বলেছি। যেন যে কেউ এখান থেকে বীজ নিয়ে বপন করতে পারে।’
জাহাঙ্গীর আলম আরও বলেন, ‘এক বিঘা জমিতে প্রায় তিন মণ চিয়া উৎপাদন হচ্ছে। কৃষকরা এটি চাষ করলে লাভবান হবেন। চিয়াতে দুধের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি ক্যালসিয়াম, কলার চেয়ে দ্বিগুণ, পালং শাকের চেয়ে তিনগুণ ও ব্রকলির চেয়ে সাতগুণ পুষ্টি রয়েছে। এ কারণে এটিকে আমরা অবলিলায় সুপারফুড বলতে পারি। এ ফসলটি বাংলাদেশে রেভ্যুলিউশন ঘটাবে বলে আমরা মনে করছি।’
পঞ্চগড় জেলা বীজ প্রত্যয়ন কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. আব্দুল মতিন বলেন, ‘পঞ্চগড়ের আবহাওয়ায় চিয়া বীজ খুব ভালো হচ্ছে। কৃষক আমিন গত বছর এক বিঘা জমিতে চিয়া চাষ করে এক লাখ টাকা আয় করেছেন। এ বছর তিনি প্রায় ১০ বিঘা জমিতে চিয়া বীজ চাষ করেছেন। বিঘা প্রতি খরচ মাত্র আট থেকে ১০ হাজার টাকা। বিঘা প্রতি আয় ৮০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা। নতুন এই অর্থকরী ফসল চিয়া কৃষকদের জন্য কল্যাণ বয়ে এনেছে। আশা করি, আগামীতে আরও অনেক চাষি এই চিয়া চাষ করে উপকৃত হবে। পাশাপাশি চিয়া মানবদেহে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ম্যাঙ্গানিজের চাহিদা পূরণ করে ও ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল (এলডিএল) হ্রাস করে।’
মো. আব্দুল মতিন বলেন, ‘চিয়া মানবদেহে কর্মক্ষমতা ও রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানো, রক্তে সুগার স্বাভাবিক রাখা, হাড়ের ক্ষয় রোধ করে। এটি চাষাবাদ বৃদ্ধি করতে পারলে আমাদেরকে আর বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে না।’
এই কর্মকর্তা আরও জানান, এক বিঘা ধান এক বিঘা গম থেকে বড়জোর ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা আয় করবে। সেক্ষেত্রে এক বিঘা জমিতে চিয়া চাষ করলে পাঁচ বিঘা ধানের সমান টাকা আয় করতে পারবে। বাণিজ্যিকভিত্তিতে চিয়া বীজের চাষাবাদ বাড়াতে পারলে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব বলে মনে করছেন তিনি।