ট্রানজিটে কীভাবে বেশি লাভবান হতে পারে বাংলাদেশ?
বাংলাদেশ থেকে পণ্য পরিবহণের স্থায়ী ট্রানজিট পেয়েছে ভারত৷ দেশটি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহণ করতে পারবে৷ ২০২০ সালের জুলাই থেকে এ পর্যন্ত বিশেষ অনুমোদনে বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করে ভারত কয়েকটি চালান উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলোতে পাঠিয়েছে৷ তাতে দেখা যায়, গত বছর মাশুল পেয়েছে সব মিলিয়ে আনুমানিক দুই লাখ টাকা৷ কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, এটার সঠিক কোনো হিসাব নিরূপণ করা হয়নি৷ তা হলে বোঝা যেতো ট্রানজিট দিয়ে বছরে বাংলাদেশ কত টাকা আয় করতে পারবে৷ তাছাড়া বিষয়টি নির্ভর করছে চাহিদা ও জোগানের ওপর৷ মাশুল নির্ধারণ করতে হবে দুই দেশের লাভের কথা চিন্তা করে৷ কেউ যেন এককভাবে লাভবান না হয়৷ বন্দর অব্যবহৃত রেখে লাভ নেই৷
বাংলাদেশ কী পাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড স্থায়ী ট্রানজিটের আদেশে পণ্য পরিবহণে মাশুল নির্ধারণ করে দিয়েছে৷ প্রতি চালানের প্রসেসিং ফি ৩০ টাকা, প্রতি টনের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট ফি ২০ টাকা, নিরাপত্তা ফি ১০০ টাকা, কনটেইনার স্ক্যানিং ফি ২৫৪ টাকা এবং অন্যান্য প্রশাসনিক ফি ১০০ টাকা৷ এর বাইরে কনটেইনার বা গাড়ির জন্য কিলোমিটারপ্রতি এসকর্ট (পাহারা) ফি ৮৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে৷ আগে প্রতি চালানে এসকর্ট ফি ছিল ৫০ টাকা৷ এছাড়া ইলেকট্রিক লক ও সিল ফি নামের আরেকটি খাত রয়েছে৷
কনটেইনারে ইলেকট্রিক লক ও সিল ব্যবস্থা কার্যকর হওয়ার আগে এসকর্ট ফি আদায় করা হবে৷ ইলেকট্রিক সিল বাস্তবায়ন হলে তখন এসকর্ট ফি দিতে হবে না৷ সড়কের মাশুল এর বাইরেও সড়কপথে পণ্য পরিবহণের জন্য সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত মাশুল দিতে হবে৷ প্রতি টন পণ্যে প্রতি কিলোমিটারে মাশুল এক টাকা ৮৫ পয়সা৷ মোট আটটি রুটের মাশুল নির্ধারণ করা হয় ২০২১ সালে৷ এই রুটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূরত্ব মোংলা বন্দর-গোপালগঞ্জ-মাওয়া-ঢাকা-নরসিংদী-আশুগঞ্জ-সিলেট-তামাবিল রুটের৷
এই রুটে ৪৩৫ কিলোমিটার দূরত্বের জন্য টোলসহ মাঝারি পণ্য পরিবহণ ক্ষমতার ট্রাকের আদায়যোগ্য মাশুল নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ হাজার ১৯৫ টাকা৷ আর সবচেয়ে কম দূরত্ব চট্টগ্রাম বন্দর-ফেনী-কুমিল্লা-বিবিরবাজার রুটের ১৪৩ কিলোমিটার৷ এই রুটে সড়কপথের মাশুল তিন হাজার ৯৮৮ টাকা৷ আর সব ধরনের মাশুলের ওপর নির্ধারিত হারে ভ্যাট দিতে হবে৷ বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, বন্দর, কাস্টম, সিঅ্যান্ডএফ, পরিবহণসহ সবমিলিয়ে ২০ ফুট দীর্ঘ একটি কনটেইনারে বাংলাদেশের আয় হতে পারে ৭০০ থেকে ৮০০ ডলার৷ ২০২০ সালে প্রথম জাহাজে চারটি কনটেইনারে ১০৩ টন পণ্য আসে৷ সব মিলিয়ে বাংলাদেশ পেয়েছে প্রায় ৫৯ হাজার টাকা৷ ভারতের কী সুবিধা উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যে পণ্য নিতে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতের অর্থ ও সময় সাশ্রয় হবে৷ সময় ও দূরত্বেও লাভবান হবে তারা৷
ট্যারিফ কমিশনের কোর কমিটি ট্রানজিট হলে কোনো রুট দিয়ে পণ্য নিলে কার কত অর্থ সাশ্রয় হবে সে ব্যাপারে তাদের রিপোর্টে এ নিয়ে ধারণা পাওয়া যায়৷ বাংলাদেশকে মাশুল দেওয়ার পরও তামাবিল-চট্টগ্রামে ১২ শতাংশ, আখাউড়া-চট্টগ্রামে ৭০ শতাংশ, আখাউড়া-বেনাপোলে ৪৮ শতাংশ, সুতারকান্দি-বেনাপোলে ৩৩ শতাংশ, সুতারকান্দি-চট্টগ্রামে ৫৩ শতাংশ, বাংলাবান্ধা-মোংলা ২৯ শতাংশ, বুড়িমারী-মোংলা ১২ শতাংশ, শাহবাজপুর-চট্টগ্রাম ৬৭ শতাংশ, আখাউড়া-দর্শনা ৭০ শতাংশ, রায়মঙ্গল-আশুগঞ্জে প্রায় ৫০ শতাংশ এবং শাহবাজপুর-দর্শনা রুটে ট্রানজিট সুবিধা পেলে ভারতের সাশ্রয় হবে ৫৭ শতাংশ খরচ৷ ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার সঙ্গে কলকাতার দূরত্ব এক হাজার ৬৮০ কিলোমিটার৷ আর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আগরতলার দূরত্ব মাত্র ২৪৮ কিলোমিটার৷ মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ের সঙ্গে কোলকাতার দূরত্ব এক হাজার ১৫০ কিলোমিটার হলেও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এ দূরত্ব ৫৭০ কিলোমিটার৷ মিজোরামের রাজধানী আইজলের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ৬৫৫ কিলোমিটার আর কলকাতার দূরত্ব এক হাজার ৫৫০ কিলোমিটার৷ নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমার সঙ্গে বন্দরের দূরত্ব ৮৮০ কিলোমিটার হলেও কলকাতার দূরত্ব এক হাজার ৪৫০ কিলোমিটার৷ কলকাতা থেকে অন্যান্য রাজ্যের দূরত্বও চট্টগ্রামের তুলনায় গড়ে তিন গুণের বেশি৷
উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যে পণ্য পরিবহণে ভারত সরকারের সময় ও অর্থ দুটিই বেশি যাচ্ছে৷ বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সাত রাজ্যে পণ্য পরিবহণ শুরু হওয়ায় এখন আগের চেয়ে ভারতের খরচ কমে যাবে৷ নেপাল-ভুটানে ফ্রি ট্রানজিটের কত দূর? ২০২২ সালে সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় বাংলাদেশকে তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানির জন্য বিনা মাশুলে ভারত ট্রানজিট সুবিধার প্রস্তাব দেয়৷ এটা কার্যকর হলে নেপাল ও ভুটানে পণ্য রপ্তানিতে সুবিধা পাবে বাংলাদেশ৷ তবে এর আগেই মাশুল দিয়ে ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে নেপালে সার রপ্তানিতে ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে ভারত৷ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার রহনপুর ও ভারতের সিঙ্গাবাদ রেলপথ দিয়ে এই ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া হয়েছে৷ তবে এখনো সার্বিক ট্রানজিট ও ফ্রি ট্রানজিট সুবিধা পাওয়া যায়নি৷ নেপাল ও ভুটানে বাংলাদেশের পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে৷ নেপালে বাংলাদেশের প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, ওয়ালটন, আসবাবপত্রের প্রতিষ্ঠান হাতিলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পণ্য রপ্তানি করে৷ পণ্যের তালিকায় আছে মোটরসাইকেল, ফ্রিজ, টেলিভিশন, আসবাব, খাদ্যজাত পণ্য ইত্যাদি৷ ভুটানে যায় জুস, ড্রিংক, পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্য৷
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ‘‘এখনো ট্রানজিট সুবিধা নেপাল-ভুটানে পাওয়া যাচ্ছে না৷ পাওয়া গেলে আমাদের সময় এবং খরচ অনেক বেঁচে যেত৷ আর নেপালে আমরা উচ্চ শুল্কের শিকার হচ্ছি৷ ভারতীয় পণ্যের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ শুল্ক দিতে হয় বাংলাদেশি পণ্যের৷’’
ওয়ালটনের বিপণন পরিচালক হুমায়ুন কবিরও বলেন, ‘‘ট্রানজিট সুবিধা পেলে আমাদের পণ্য রপ্তানি খরচ অনেক কমে যেতো৷’’
২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে এক হাজার ৬৭ কোটি নেপালি রুপির সমপরিমাণ পণ্য রপ্তানি হয়েছে দেশটিতে৷ অন্যদিকে নেপাল থেকে বাংলাদেশে এসেছে ৬৭ কোটি রুপির পণ্য৷
সিরডাপের পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মো. হেলাল উদ্দিন মনে করেন, ‘‘ট্রানজিট বিশ্বের অনেক দেশেই আছে৷ আমাদের রাজনৈতিক বিতর্ক এড়িয়ে এর সুবিধা আমরা কীভাবে নেবো সেই দিকে মনোযোগ দিতে হবে৷ ভারত তো লাভবান হবে৷ সেভেন সিস্টারে তার পণ্য পরিবহণ খরচ অনেক কমে যাবে৷ এখন আমাদের দেখতে হবে৷ সে যতটা লাভবান হবে তার কত অংশ বাংলাদেশ নিতে পারে৷ বাংলাদেশের কাঠামোগত উন্নয়ন, সড়কসহ আরও অনেক খরচ আছে, সেগুলো হিসাব করে মাশুলের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷ বিষয়টি হতে হবে উভয় পক্ষের লাভজনক।’’
অধ্যাপক মো. হেলাল উদ্দিনের মতে, ‘‘আমরা তো এখনো কোনো জরিপ করিনি যে, ভারত বছরে কত পণ্য পরিবহণ করবে তা বুঝবো৷ সেটা করা উচিত৷ মোট কথা, আমাদের খরচের সঙ্গে লাভের সমন্বয় করতে হবে৷ এটা যেন এক পক্ষের লাভের বিষয় না হয়৷ আর আমাদের বার্গেইনিং ক্যাপাসিটির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে৷’
আর পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘কে বেশি লাভ পেলো সেই বিতর্ক না করে আমাদের ব্যবসাটা মাথায় রাখতে হবে৷ এরপর মাতারবাড়ি আসছে৷ বন্দর বসিয়ে রেখে লাভ নাই৷ আমাকে ব্যবসা করতে হবে৷ আর সেটা করতে হলে বন্দরের ওপর ভারতের নির্ভরশীলতা বাড়াতে হবে৷ তখন আমরা বেশি আয় করতে পারবে৷ এই বন্দর শুধু ভারত কেন, অন্যদেশও ব্যবহার করবে৷ তাই বন্দরকে আধুনিক ও সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন করতে হবে৷ আর সব সময় আমাদের আয়ের খাতগুলো আমাদের বুঝে নিতে হবে৷ বন্দরের ব্যবহার যত বাড়বে, আমাদের আয় তত বাড়বে৷ আমরা তখন বেশি মাশুল নিতে পারব৷”
বাংলাদেশ মাশুল কম নিচ্ছে কি না জানতে চাইলে ড. আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, ‘‘এটা তো ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের মতো৷ আমরা আমাদের বন্দরের চাহিদা বাড়াতে পারলে মাশুল বাড়াতে পারব৷ দুই দেশই যেন লাভবান হয়, সেটা বিবেচনা করে সব ধরনের মাশুল নির্ধারণ করতে হবে৷”
তারা মনে করেন, এই ট্রানজিটে পরিবহণ থেকে আয়ের একটা বড় সুযোগ আছে৷ ভারত থেকে যাতে বাংলাদেশি জাহাজে পণ্য আনা যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে৷ আর বন্দরের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে শুল্ক বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে৷