পাহারাদার থেকে পঞ্চায়েত সর্দার
হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার রশিদপুর ও ফয়জাবাদ চা বাগানের কোল ঘেঁষে নিভৃত এক গ্রাম সুন্দ্রাটিকি। গ্রামের বেশির ভাগ লোকই শ্রমজীবী। কাজ করেন চা বাগান, লেবু বাগানে। অন্যান্য টুকটাক কাজও করেন কেউ কেউ। অবস্থাপন্ন কিছু পরিবারও রয়েছে এ গ্রামে। আলাদা কোনো বিশেষত্ব না থাকায় আশপাশের কয়েক গ্রাম ছাড়া সুন্দ্রাটিকির তেমন পরিচিতি ছিল না। তবে নৃশংস এক ঘটনায় দেশজুড়ে পরিচিত হয়ে উঠেছে নিভৃত এ গ্রাম। গ্রামের একটি বালির স্তূপ থেকে চার শিশুর লাশ উদ্ধারের পর রাতারাতি গ্রামটি পরিচিত হয়ে পড়ে। এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে গ্রামটি। আলোচনায় এসেছে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত একটি পরিবার ও পরিবারের প্রধান ‘বাগাল পঞ্চায়েত’-এর সর্দার আবদুল আলী বাগাল।
কে এই আব্দুল আলী বাগাল
সুন্দ্রাটিকি গ্রামের মৃত আব্দুল জব্বারের ছেলে আবদুল আলী বাগাল। জীবিকা নির্বাহের তাগিদে অনেক বছর আগে তিনি ফয়জাবাদ চা বাগানে পাহারাদারের কাজ নেন, স্থানীয়ভাবে কাজটি পরিচিতি ‘বাগাল’ নামে পরিচিত। দীর্ঘদিন বাগালের কাজ করায় তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে যায় বাগাল শব্দটি। এ পেশায় যুক্ত থাকার সুবাদে এরই মধ্যে তিনি কৌশলে চা বাগানের বেশ কিছু ভূমি দখল করে ফল বাগান প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া চা বাগানের গাছ পাচারে তাঁর সম্পৃক্ততার অভিযোগ আছে। শুধু তাই নয়, অনেক ঘটন-অঘটনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আব্দুল আলী বাগালের নাম।
প্রায় ২৫ বছর আগে সুন্দ্রাটিকি গ্রামে খুন হয়েছিলেন আবদুল জলিল নামের এক ব্যক্তি। তখন অভিযোগের আঙুল উঠেছিল আব্দুল আলীর দিকেও। এর পাঁচ বছর পর আরো একটি হত্যার ঘটনা ঘটে সুন্দ্রাটিকি গ্রামে। রশিদপুর চা বাগানের নাচঘরের পাশ থেকে উদ্ধার হয় ভাদেশ্বর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মত্তাছির মিয়ার ভাই মোশাহিদ মিয়ার লাশ। এ ঘটনায়ও জড়িত থাকার অভিযোগ উঠে আবদুল আলীর বিরুদ্ধে। অবশ্য দুটি খুনের ঘটনাতেই আপস -রফার মাধ্যমে বেঁচে যান তিনি। এ দুটো মামলা থেকে বেঁচে গেলেও কারাগারের ফটক দিয়ে ঠিকই তাকে মাথা নিচু করে ঢুকতে হয়েছিল। প্রায় ২২ বছর আগে ফয়জাবাদ হিলসে শ্রীমঙ্গলের বাসিন্দা জনৈক শিপার মিয়ার একটি ফল বাগান জোরপূর্বক দখল করতে চেয়েছিলেন। এ ঘটনায় তাঁকে কিছুদিন হাজতবাস করতে হয়েছে।
আবদুল আলী বাগালের প্রথম স্ত্রী হালিমা বেগম বাগান দখলের ঘটনায় তাঁর স্বামীর কিছুদিন কারাবাসের কথা স্বীকার করলেও ঘটনাটিকে সাজানো বলে দাবি করেন। হালিমা বেগমের ভাষ্য, তাঁর স্বামী আপাদমস্তক ভালো মানুষ। ‘হক কথা’ বলেন, তাই তাঁকে অনেকে পছন্দ করেন না।
আবদুল আলী বিয়ে করেছেন দুই বার। সাত ছেলেমেয়ের বাবা তিনি। প্রথম স্ত্রী হালিমা বেগমের ঘরেই সব সন্তানের জন্ম। দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরা বেগম নিঃসন্তান। সন্তানদের মধ্যে পাঁচজনই ছেলে এঁরা হলেন- বিলাল মিয়া, জয়নাল মিয়া, ফেরদৌস মিয়া, জুয়েল মিয়া ও রুবেল মিয়া। দুই মেয়ে খেলা বানু ও নাসিমা বেগম। এদের মধ্যে গ্রেপ্তার জুয়েল ও রুবেল আদালতের কাছে হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। আবদুল আলী এ মুহূর্তে ১০ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত দুর্গাপূজায় প্রতীমা বিসর্জনের আগের দিন আবদুল আলী বাগালের এক ছেলে কিছু বখাটেসহ রশিদপুর চা বাগানে পূজানুষ্ঠানে যায়। সেখানে তাদের হাতে যৌন হয়রানির শিকার হন এক নারী চা শ্রমিক। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিসর্জনের পরের দিন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ভাঙচুর চালানো হয় চা শ্রমিকদের বাড়িঘরে।
৩১ অক্টোবর স্কুলের ছাত্রীদের যৌন হয়রানির ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফয়জাবাদ হাইস্কুলে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার নেতৃত্বে ছিল আবদুল আলী বাগালের ছেলে ও ওই স্কুলের ছাত্র রুবেল মিয়া। রুবেল ও তার বন্ধুরা মিলে প্রায়ই ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করত। এমন অভিযোগে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের শাসন করলে রুবেল ও তার সঙ্গীরা স্কুলে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটায়।
সুন্দ্রাটিকি গ্রামের বাসিন্দা ইদ্রিস আলীর অভিযোগ, বছরখানেক আগে তাঁর বাড়িতে সংঘটিত ডাকাতির ঘটনায় সম্পৃক্ত ছিল আবদুল আলীর ছেলে বিলাল মিয়া ও তাঁর ভাতিজারা। এ ঘটনায় ইদ্রিস আলী তাঁদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন।
সহযোগী থেকে পঞ্চায়েত প্রধান : সুন্দ্রাটিকি গ্রামে আবদুল আলী একটি পঞ্চায়েতের প্রধান হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি এ পরিচয় কৌশলে হাতিয়ে নেন। তিনি এক সময় ছিলেন গ্রাম পঞ্চায়েত আবদুর রউফের সহযোগী। আবদুর রউফ মারা গেলে গ্রামের রীতি অনুযায়ী ওই পঞ্চায়েতের প্রধান হন তাঁর ছেলে আবদুল মঈন সুমন। কিন্তু চতুর, বাকপটু এবং কৌশলী আবদুল আলী বাগাল কৌশলে সুমনকে সরিয়ে এ দায়িত্ব দখল করে নেন। এ নিয়ে এখনো ওই পঞ্চায়েতের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। প্রায় চার হাজার জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত সুন্দ্রাটিকি গ্রামে আরো সাতটি পঞ্চায়েত রয়েছে। এসব পঞ্চায়েতের নেতারা হলেন- সুন্দ্রাটিকি সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আবদুল খালিক তালুকদার, মধু মিয়া, নূর আলী ওরফে নূরাই মিয়া, আব্দুল মঈন সুমন, ফরিদ মিয়া, সেলিম আহমেদ, টেনু মিয়া, আব্দুল হাই, উস্তার মিয়া ও আকল মিয়া।
উল্টো পথে চলেন আব্দুল আলী বাগাল
নানা বিষয়ে সুন্দ্রাটিকি গ্রাম পঞ্চায়েতের মুরুব্বিরা ঐকমত্যে পৌঁছালেও আবদুল আলী বাগাল একাই থেকে যান ভিন্ন মত ও পথে। ফলে গ্রামের নানা বিরোধ পঞ্চায়েতে শেষ হয়েও হয় না। অনেক বিষয়ই ফের জিইয়ে উঠে। সুন্দ্রাটিকি গ্রাম পঞ্চায়েতের হেফাজতে কয়েক একর সরকারি পতিত ভূমি রয়েছে, যা গোচারণ ভূমি, খেলার মাঠ ও কবরস্থান হিসেবে যুগের পর যুগ ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে। সংশ্লিষ্টদের দাবি, ওই ভূমি তারা সরকারের নিয়ম মেনে লিজ নিয়েছে। সম্প্রতি ভূমি থেকে প্রায় ৬০ শতাংশ ভূমি ১৩ লাখের কিছু বেশি টাকা মূল্যে বিক্রি করা হয়। এই টাকা দিয়ে গত বছরের শেষের দিকে স্থানীয় খেলার মাঠে শিরনির আয়োজন করা হয়। ৯টি গরু ও ১০টি খাসি জবাই করে উক্ত শিরনিতে সুন্দ্রাটিকি গ্রামবাসী ছাড়াও আশপাশের বেশ কয়েক গ্রামের লোকজন ভূরিভোজন করে। এতে প্রায় চার হাজার লোককে আপ্যায়ন করা হয়েছিল বলে গ্রামবাসীর দাবি। এই ভূরিভোজে খরচের হিসাব-নিকাশ নিয়ে অন্য মুরুব্বিদের মাথাব্যথা না থাকলেও আবদুল আলী বাগালের সন্দেহ-অবিশ্বাস ছিল। এ নিয়ে গ্রাম পঞ্চায়েতে তিনি দেন-দরবার চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ নিয়ে ওই পঞ্চায়েতপ্রধান সেলিম আহমেদের সঙ্গে আব্দুল আলীর কথা কাটাকাটি হয় এবং তীব্র বিরোধ সৃষ্টি হয়।
অপরদিকে, বাড়ির সীমানায় একটি বড়ই গাছের ডাল কাটা নিয়ে তালুকদার পঞ্চায়েতের ওয়াহিদ মিয়া ও তার লোকজনের সঙ্গে আবদুল আলী বাগালের ঝগড়া হয়। নিহত চার শিশুর পরিবারের সদস্যরা ওয়াহিদ মিয়ার পক্ষের লোক। এ বিরোধকে কেন্দ্র করেই চার শিশু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।