আমি মালালা বলছি
গ্রাম
৪.
গ্রাম
আমাদের সংস্কৃতিতে শিশুর জীবনের সপ্তম দিনে আমরা ‘ওমা’ (যার অর্থ সপ্তম) নামে একটি অনুষ্ঠান করি, যেখানে পরিবারের সদস্য, বন্ধু, প্রতিবেশীরা নবজাতকের প্রশংসা করে। আমার বাবা-মা করেননি, কারণ অতিথিদের আপ্যায়ন করার মতো যথেষ্ট ভাত ও খাসির গোশতের ব্যবস্থা করার সামর্থ্য তাঁদের ছিল না এবং আমি ছেলে না হওয়ায় দাদাও তাঁদের কোনো সাহায্য করলেন না। ভাইদের জন্মের পর দাদা অর্থসাহায্য করতে চাইলেন; কিন্তু বাবা রাজি হলেন না, কারণ আমার বেলায় এটা করা হয়নি। কিন্তু আমার দাদা-দাদি, নানা-নানির মাঝে কেবল দাদাই বেঁচে থাকায় আমরা ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। বাবা-মা বলেন, আমি নানা ও দাদা উভয়ের গুণই পেয়েছি—নানার মতো জ্ঞানী ও রসিক এবং দাদার মতো বাকপটু! বৃদ্ধ বয়সে দাদা নরম হয়ে গিয়েছিলেন এবং তাঁর দাড়ি সাদা হয়েছিল। গ্রামে তাঁকে দেখতে যেতে খুব ভালোবাসতাম আমি।
আমাকে দেখলেই তিনি একটি গানের মাধ্যমে অভ্যর্থনা জানাতেন, কারণ তিনি আমার নামের দুঃখময় অর্থটা সম্পর্কে তখনো অবগত ছিলেন এবং সেখানে কিছু আনন্দ ধার দিতে চাইতেন। তিনি গাইতেন, ‘মালালা মাইওয়ান্দ থেকে এসেছে এবং সেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।’
ঈদের ছুটিতে আমরা সব সময়ই গ্রামে বেড়াতে যেতাম। আমাদের সবচেয়ে সুন্দর জামাগুলো পরে ‘ফ্লাইং কোচ’ নামে উজ্জ্বল রঙে রঞ্জিত দরজা এবং ঝনঝনানো শিকলওয়ালা মিনিবাসে চাপতাম, বারকানার উত্তর দিকে গ্রামের বাড়ি শাংলায় যেতাম। বছরে দুবার ঈদ হয়—ঈদুল ফিতর বা ছোট ঈদ এবং ঈদুল আজহা বা বড় ঈদ। এর মাধ্যমে আমরা নবী ইব্রাহীমের (আ.) সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজ পুত্রকে উৎসর্গ করার প্রস্তুতির কথা স্মরণ করি। ভোজের তারিখগুলো ধর্মীয় নেতাদের বিশেষ বোর্ডের মাধ্যমে ঘোষিত হয়, তাঁরা চাঁদ দেখে তারিখ ঘোষণা করেন। রেডিওতে খবরটা শুনেই আমরা রওনা দিতাম।
আগের রাতে উত্তেজনায় আমরা দুই চোখের পাতে এক করতে পারতাম না। বৃষ্টি বা পাহাড়ধসে রাস্তা বন্ধ না হলে এবং ফ্লাইং কোচ ভোরে রওনা দিলে সাধারণত রাস্তায় পাঁচ ঘণ্টা লাগত। পরিবারের জন্য ব্যাগভর্তি উপহার—কারচুপির কাজ করা শাল এবং গোলাপ আকৃতির পেস্তাবাদামযুক্ত মিষ্টি এবং গ্রামে পাওয়া যায় না এমন প্রয়োজনীয় ওষুধ—এসব নিয়ে আমরা মিঙ্গোরা বাসস্টেশনে যেতাম। কিছু লোকন চিনি-আটা এসবের বস্তা নিত এবং বেশির ভাগ মালামাল উঁচু স্তূপাকারে বাসের ছাদে বাঁধা থাকত। ঠাসাঠাসি করে ঢুকে আমরা জানালার পাশের আসনের জন্য কাড়াকাড়ি করতাম—যদিও শার্সিগুলো ধুলায় এমনভাবে আবৃত থাকত যে তা দিয়ে কিছু দেখাও মুশকিল। সোয়াতের বাসের গায়ে উজ্জ্বল গোলাপি এবং হলুদ ফুল, নিয়নের মতো কমলা বাঘ আর তুষারাবৃত পাহাড় আঁকা থাকে। এফ-১৬ ফাইটার জেট বা পারমাণবিক মিসাইল আঁকা কোনোটা পেলে আমার ভাইরা খুশি হতো, যদিও বাবা বলতেন যে রাজনীতিবিদরা পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য এত অর্থ ব্যয় না করলে সেই অর্থ আমরা স্কুলের কাজে লাগাতে পারতাম।
দন্তচিকিৎসকদের দাঁত-দেখানো লাল মুখের চিহ্ন পেরিয়েই আমরা বাজার পার হয়ে আসতাম, দানার মতো চোখওয়ালা লাল ঠোঁটযুক্ত সাদা মুরগিভর্তি কাঠের খাঁচায় ঠাসা ঠেলাগাড়ি, জানালা দিয়ে দেখা যাওয়া বিয়ের সোনার চুড়ি সাজিয়ে রাখা অলংকারের দোকান দেখতাম। মিঙ্গোরার উত্তর দিক দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে যে দোকানগুলো দেখতাম, সেগুলো ছিল একটা আরেকটার ওপর হেলে পড়া কুঁড়েঘর, তাদের সামনে ছিল খারাপ রাস্তার ফলে নষ্ট হওয়া এবং মেরামত করা গাড়ির টায়ারের স্তূপ। এরপর শেষ ওয়ালির নির্মিত বড় রাস্তায় চলে আসতাম, যার বাঁয়ে সোয়াত নদী এবং ডানে পান্নার খনিসমৃদ্ধ উঁচু খাড়া পাহাড়। নদীর ওপারে ছিল বড় বড় কাচের জানালাযুক্ত পর্যটকদের রেস্তোরাঁ, যেখানে আমরা কখনো যাইনি। রাস্তায় ধুলোমাখা চেহারার বাচ্চাদের দেখতাম আমরা, যারা বড় বড় ঘাসের আঁটির বোঝায় নুয়ে পড়েছে। দেখতাম, এদিক-ওদিক চরে বেড়ানো ঝোলা চামড়ার ছাগলের পাল ও রাখালদের।
যতই যেতে থাকলাম, দৃশ্যপট পাল্টে সতেজ সুবাসযুক্ত ঘন সবুজ ধানক্ষেত, খুবানি ও ডুমুরের বাগানে পৌঁছাল। মাঝেমধ্যে মর্মরের ছোট স্থাপনা বসানো জলাশয়ে রাসায়নিক দ্রব্য নিঃসরণের কারণে সৃষ্ট ময়লা দেখতাম, যা বাবাকে রাগিয়ে দিত। তিনি সব সময় বলতেন, ‘দেখ, এসব অপরাধী আমাদের সুন্দর উপত্যকাটিকে কীভাবে দূষিত করে ফেলছে।’ রাস্তাটি নদী পেরিয়ে ঢালু সরু উঁচু গিরিপথ দিয়ে উঁচুতে উঠতে থাকত, আমাদের কানে পটপট শব্দ হতো। কিছু কিছু চূড়ায় ছিল প্রথম ওয়ালির নির্মিত দুর্গের ধ্বংসাবশেষ, যেখানে শকুনি চক্কর দিত। বাসটি যথাসাধ্য পরিশ্রম করে এগিয়ে যেতে থাকত এবং ঢালু জায়গা আর অপর প্রান্ত দেখা যায় না এমন বাঁকে ট্রাক যখন আমাদের অতিক্রম করতে থাকত, আমাদের চালক তাদের অভিশাপ দিতে থাকত। ভাইয়েরা এটা খুব পছন্দ করত এবং পর্বতের পাশে থাকা যানবাহনের ধ্বংসাবশেষ দেখিয়ে আমাকে আর মাকে বিদ্রূপ করত।
শেষ পর্যন্ত আমরা স্কাইটার্নে পৌঁছাতাম, যেটা ছিল শাংলা টপে পৌঁছানোর রাস্তা। শাংলা টপ ছিল এক গিরিপথ, যাতে উঠলে মনে হয় পৃথিবীর চূড়ায় উঠে গেছি। আশপাশের পাথুরে চূড়া থেকে আমরা অনেক উপরে থাকতাম। দূরে আমাদের স্কি রিসোর্ট মালাম জাব্বার তুষার দেখা যেত। রাস্তার ধারে ছিল চঞ্চলা ঝর্ণা আর জলপ্রপাত, আমরা যখন চা খাওয়ার জন্য বিরতিতে যেতাম, বাতাসটা সিডার ও পাইনগাছের সুগন্ধে ভরপুর ও পরিষ্কার থাকত। লোভাতুরভাবে সেই বাতাস আমরা ফুসফুসে চালান করতাম। শাংলা হলো ছোট্ট একটু আকাশ আর বাকি সব পাহাড়, পাহাড়, পাহাড়। এরপর রাস্তাটা কিছুক্ষণের জন্য পেছনে বাঁক নেয়, পরে ঘুরবান নদীর পাশ দিয়ে একটি পাথুরে রাস্তায় এসে শেষ হয়ে যায়। নদীটা পার হওয়ার একমাত্র উপায় দড়ির সেতু অথবা কপিকল ব্যবস্থা, যেখানে একটি ধাতব বাক্সে বসে মানুষ ঝুলে ঝুলে নদী পার হয়। বিদেশিরা এদের আত্মঘাতী সেতু বলে কিন্তু আমরা এদের খুব ভালোবাসি।
সোয়াতের মানচিত্র দেখলে বুঝতে পারা যায়, এটি অনেক ছোট উপত্যকা সংযুক্ত একটি লম্বা উপত্যকা, খানিকটা গাছের ডালের মতো, যাকে আমরা বলি ‘দারায়’। পূর্বদিকে অর্ধেক রাস্তা গেলেই আমাদের গ্রামে পৌঁছানো যায়। এটি কানা দারা-তে অবস্থিত, যেটা খাড়া পর্বত দ্বারা আবদ্ধ এবং এতই সরু যে সেখানে ক্রিকেট খেলারও জায়গা ছিল না। গ্রামটার নাম শাহপুর, কিন্তু আসলে সেটা ছিল তিনটা গ্রামের মালা, যেগুলো উপত্যকার সর্বনিম্নে অবস্থিত—সবচেয়ে বড়, শাহপুর; বারকানা, যেখানে বাবা বেড়ে উঠেছেন; এবং কারশাত, যেখানে মা থাকতেন। দুই মাথায়ই বড় পাহাড় ছিল—তর ঘার বা কালো পর্বত ছিল দক্ষিণে, সাদা পর্বত ছিল উত্তরে।
বারকানায় আমরা সাধারণত দাদার বাড়িতে থাকতাম, যেখানে বাবা বেড়ে উঠেছেন। এলাকার বেশির ভাগ বাড়ির মতো এর ছিল মাটি ও পাথর নির্মিত মসৃণ ছাদ। আমি মায়ের দিকের জ্ঞাতি ভাইবোনদের সঙ্গে কারশাতে থাকতেই পছন্দ করতাম, কারণ সেখানে বাথরুমসহ কংক্রিটের বাড়ি ছিল এবং খেলা করার মতো অনেকেই ছিল। মা আর আমি নিচতলার মহিলাদের কোয়ার্টারে থাকতাম। বাচ্চাদের দেখাশোনা করে, ওপরতলার হুজরায় পুরুষদের জন্য খাবার তৈরি করেই মহিলাদের দিন কাটত। আমি আমার জ্ঞাতিবোন আনিসা ও সুম্বুলের সঙ্গে এক কক্ষে ঘুমাতাম। সেই কক্ষে ছিল মসজিদের আকৃতির একটি ঘড়ি, ওয়াল কেবিনেটে একটি রাইফেল এবং কয়েক প্যাকেট চুলের ডাই।
গ্রামে দিন শুরু হয় অনেক তাড়াতাড়ি। ঘুম পছন্দ করা আমিও মোরগের ডাক ও পুরুষদের জন্য নাশতা তৈরি করতে থাকা মহিলাদের বাসনকোসনের শব্দে উঠে পড়তাম। সকালে সূর্য তরঘার পর্বতের চূড়ায় আভা ছড়ায়; যখন পাঁচবেলা প্রার্থনার প্রথমটি, অর্থাৎ ফজর পড়ার জন্য উঠি, তখন দেখি সাদা পর্বত বা স্পিন ঘারের চূড়ায় সূর্যের প্রথম কিরণ কপালে সোনার ‘জুমার টিকা’ (টিকলি) পরা শুভ্র রমণীর মতো হয়ে আছে।
প্রায়ই বৃষ্টি এসে সবকিছু ধুয়ে পরিষ্কার করে দিয়ে যেত, মানুষের মুলা ও আখরোট ফলানোর স্থান, পাহাড়ে সবুজ স্তরে মেঘগুলো প্রায় স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে বসে থাকত। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকত মৌচাক। আখরোটের সঙ্গে আমি ঘন মধু খেতে ভালোবাসতাম। কারশাতের শেষ মাথায় নদীতে ছিল জলমহিষ। কাঠের বিশাল এক চাকা শেডের নিচে দাঁড়িয়ে বিশাল বিশাল পাথরের কল দিয়ে গম আর ভুট্টা পিষে আটা বানানোর জন্য পানি আর শক্তি সরবরাহ করত। কমবয়সী ছেলেরা সেই আটা বস্তায় ভরত। পাশে আরেকটি ছোট শেডে ছিল এলোমেলো তার বেরিয়ে থাকা একটি প্যামেল। সরকারের পক্ষ থেকে এ গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল না। তাই গ্রামবাসীই এসব অস্থায়ী জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ পেত।
দিন যত বাড়ত, সূর্য ততই উঁচুতে উঠত, সাদা পাহাড় আরো বেশি সোনালি আলোতে ডুবতে থাকত। এভাবে সন্ধ্যা হলে এটি ছায়াবৃত হয়ে আসত, কারণ সূর্য কালো পাহাড়ের ওপর চলে যেত। আমরা পাহাড়ের ছায়ার মাধ্যমে প্রার্থনার সময় নির্ধারণ করতাম। সূর্যের আলো একটি নির্দিষ্ট পাথরের ওপর পড়লে আমরা বিকেল বা আসরের নামাজ পড়তাম, স্পিন ঘারের সাদা চূড়াকে তখন সকালের চেয়েও বেশি সুন্দর লাগত। সাদা পাহাড়টা সব জায়গা থেকেই দেখা যেত এবং বাবা বলেন, এটা ছিল আমাদের শান্তির প্রতীক—উপত্যকার শেষ প্রান্তে একটি সাদা পাহাড়। ছোট থাকতে বাবা ভাবতেন, এই ছোট্ট উপত্যকাই পুরো পৃথিবী এবং পাহাড়গুলোর আকাশচুম্বী চূড়ার ওপাশে যায় তবে সে পড়ে যাবে।
শহরে জন্ম হলেও বাবার মতোই আমার আছে প্রকৃতিপ্রেম। উর্বর মাটি, সবুজ লতাপাতা, শস্য, মহিষ এবং হেঁটে যাওয়ার সময় আশপাশে ডানা ঝাপটাতে থাকা হলুদ প্রজাপতিগুলোকে আমি ভালোবাসতাম। গ্রামটি ছিল অত্যন্ত দরিদ্র, কিন্তু আমরা এলে আমাদের একান্নবর্তী পরিবার বড় ভোজের আয়োজন করত। বাটিভর্তি মুরগির মাংস, ভাত, বাড়ির পাশে লাগানো পালং শাক এবং মসলাযুক্ত খাসির মাংস রাঁধত মহিলারা। এরপর আসত প্লেটভরা কচকচে আপেল, হলুদ কেকের টুকরা ও কেতলিভর্তি দুধ-চা। বাচ্চাদের কারোই কোনো খেলনা বা বই ছিল না। ছেলেরা গলিতে ক্রিকেট খেলত, যার বলটাও ছিল ইলাস্টিক ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা প্লাস্টিকের ব্যাগের তৈরি।
গ্রামটি ছিল অবহেলিত এক থান। পানি বয়ে আনা হতো ঝর্ণা থেকে। কিছু কংক্রিটের বাড়ি ছিল, যে বাড়ির ছেলে বা বাবারা খনিতে কাজ করতে দক্ষিণে বা উপসাগরের দিকে গেছে এবং সেখান থেকে টাকা পাঠাত। আমাদের চার কোটি পশতুনের এক কোটিই মাতৃভূমির বাইরে থাকি। বাবার কাছে এটা দুঃখের বিষয় যে পরিবারের নতুন জীবনযাত্রাকে সচল রাখার জন্য কাজ করতে হবে এবং এ জন্য আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। অনেক পরিবারেই কোনো পুরুষ মানুষ ছিল না—তারা সাধারণত বছরে একবার আসত এবং নয় মাস পর সেই পরিবারে সন্তানের জন্ম হতো।
আমার দাদার বাড়ির মতোই মাটি-লেপা বাতার চালবিশিষ্ট বাড়ি পাহাড়ের ওপরে-নিচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, বন্যা হলে সেগুলো ধসে পড়ত। কোনো হাসপাতাল না থাকায় বাচ্চারা শীতকালে ঠান্ডায় জমে মারা যেত। শুধু শাহপুরে একটা ক্লিনিক ছিল এবং আশপাশের গ্রামের কেউ অসুস্থ হলে আত্মীয়রা তাদের একটি কাঠের ফ্রেমে করে সেখানে নিয়ে যেত—যাকে আমরা ঠাট্টা করে বলতাম শংলা অ্যাম্বুলেন্স। গুরুতর সমস্যা হয় পরিচিত কোনো গাড়িওয়ালা কোনো মানুষ থাকার মতো ভাগ্যবান না হলে, তখন বাসে করে মিঙ্গোরা যেতে হয়।
সাধারণত নির্বাচনের সময় রাজনীতিবিদরা একবারই আসতেন। রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, পরিষ্কার পানি ও স্কুল সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিতেন। স্থানীয় প্রভাবশালী লোক, যাদের আমরা মজুদদার বলি, তাদের কাছে রাজনীতিবিদরা অর্থ ও জেনারেটর দিয়ে যেতেন। মজুদদাররা আমাদের ভোট দেওয়ার ব্যাপারে নির্দেশ দিত। এসব অবশ্যই পুরুষদের জন্য; আমাদের এলাকার মহিলারা ভোট দেয় না। এরপর যাঁরা জাতীয় সংসদ, পেশাওয়ার বা প্রাদেশিক সংসদে নির্বাচিত হতেন, তাঁরা ইসলামাবাদে চলে যেতেন এবং আর ফিরতেন না, আর তাঁদের প্রতিশ্রুতিরও কোনো খবর থাকত না।
আমার জ্ঞাতি ভাইবোনেরা আমার শহুরে চালচলন নিয়ে ঠাট্টা করত। আমি খালি পায়ে থাকতে পছন্দ করতাম না। বই পড়তাম, আমার কথার টান আলাদা ছিল, আমি মিঙ্গোরার আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করতাম। আমার জামাকাপড় হতো দোকান থেকে কেনা, তাদের মতো ঘরে তৈরি নয়। আমার আত্মীয়রা জিজ্ঞেস করত, ‘তুমি কি আমাদের জন্য একটু মাংস রান্না করবে?’ আমি বলতাম, ‘না, মুরগি নির্দোষ। ওকে আমাদের হত্যা করা উচিত না।’ তারা ভাবত, শহর থেকে এসেছি বলে আমি আধুনিক। তারা বোঝেনি, ইসলামাবাদ এমনকি পেশাওয়ারের লোকও আমাকে মান্ধাতার আমলের মানুষ মনে করে।
মাঝেমধ্যে পারিবারিক ভ্রমণে আমরা পর্বতের ওপর বা নিচে নদীতে যেতাম। নদীটা ছিল অনেক বড় ও গভীর এবং গ্রীষ্মকালে বরফ গলে গেলে দ্রুত পার হওয়া যেত। লম্বা লাঠির মাথায় ঝুলে থাকা সুতায় গুটির মতো কেঁচো বেঁধে ছেলেরা মাছ ধরত। মাছকে আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে কেউ কেউ শিস দিত। মাছগুলো আসলে সুস্বাদু ছিল না। মুখগুলো ছিল খসখসে ও শৃঙ্গময়। তাদের আমরা বলতাম ‘চাক্ওয়ার্তি’। মাঝেমধ্যে ভাত ও শরবত নিয়ে মেয়েরা নদীর ধারে বনভোজন করতে যেত। আমাদের প্রিয় খেলা ছিল ‘বিয়ে দেওয়া’। আমরা দুটো দল একটি পরিবার এবং দুই পরিবারই একটি মেয়ের বাগদান সম্পন্ন করবে। আমি আধুনিক ও মিঙ্গোরাবাসী হওয়ায় সবাই আমাকে চাইত। তানযিলা ছিল সবচেয়ে সুন্দরী এবং আমরা তাকে প্রায়ই অন্য পক্ষের কাছে দিতাম, যাতে তাকে বউ করে ঘরে আনতে পারি।
নকল বিয়ের অবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল অলংকার। আমরা কানের দুল, চুড়ি, গলার হার দিয়ে বউকে সাজাতাম আর বলিউডের গান গেয়ে গেয়ে কাজ সারতাম। এর পর মায়েদের কাছ থেকে আনা প্রসাধন দিয়ে ওর চেহারা সাজিয়ে দিতাম, হাত ফর্সা করার জন্য গরম চুন-সোডা মেশানো পানিতে হাত ডোবাতাম এবং নখে মেহেদি দিয়ে লাল রং করতাম। তৈরি হওয়ার পর নববধূ কাঁদতে থাকত এবং আমরা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতাম। বলতাম, ‘বিয়ে জীবনেরই অংশ। শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে, যাতে তাঁরা তোমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন। স্বামীর যত্ন নেবে এবং সুখী থাকবে।’
বড় ভোজের আয়োজন করে খুব কমই বিয়ে হতো, যা কয়েক দিন ধরে চলত এবং পরিবারটি দেউলিয়া বা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ত। কনেরা অপরূপ সুন্দর কাপড় পোর্ট এবং উভয়পক্ষের দেওয়া সোনার হার ও চুড়িতে আবৃত হয়ে থাকত। আমি পড়েছি বেনজির ভুট্টো দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য নিজের বিয়েতে কাচের চুড়ি পরেছেন, কিন্তু কনেকে সাজানোর চলটা রয়েই গেছে। মাঝেমধ্যে জোড়াকাঠের কফিন আনা হতো। মৃত ব্যক্তির স্ত্রী বা মায়ের বাসায় মহিলারা জড়ো হতো এবং বীভৎস এক কান্নার রোল উপত্যকাজুড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরত। আমি শিউরে উঠতাম।
রাতে গ্রামটা ভীষণ অন্ধকার থাকত, পাহাড়ের ওপরের বাড়িগুলোয় কেবল তেলের কুপি মিটমিট করত। বয়স্ক মহিলারা কেউ শিক্ষিত ছিলেন না; কিন্তু সবাই গল্প বলতেন আর দুই চরণবিশিষ্ট পশতু কবিতা ‘টাপে’ আবৃত্তি করতে পারতেন। আমার দাদি এগুলো খুব ভালো পারতেন। এগুলো সাধারণত প্রেম আর পশতুন জাতিসত্তা নিয়েই হতো। তিনি বলতেন, ‘কোনো পশতুনই নিজ ইচ্ছায় মাতৃভূমি ত্যাগ করে না/হয় সে দারিদ্র্যের কারণে যায় আর না হয় তার কারণ হয় প্রেম।’ ফুপুরা আমাদের ভূতের গল্প শোনাতেন, যেমন ২০টি আঙুলওয়ালা লোক শালগোয়াতে। তাঁরা ভয় দেখাতেন যে লোকটা আমাদের বিছানায় ঘুমায়। ভয়ে আমরা কাঁদতে থাকতাম, যদিও পশতু ভাষায় ‘আঙুল’ আর ‘পায়ের আঙুল’ একই শব্দ দ্বারা বোঝানো হয় এবং সেদিক থেকে আমরা সবাই ২০টি আঙুলের অধিকারী। কিন্তু আমরা সেটা বুঝতাম না। আমাদের গোসল করানোর জন্য ফুপুরা শাশাকা নামের এক ভয়ংকর মহিলার কথা শোনাত। গোসল না করলে বা চুল পরিষ্কার না করলে সে আমাদের তাড়া করবে এবং তার কর্দমাক্ত হাত ও দুর্গন্ধযুক্ত নিশ্বাসের মাধ্যমে ইঁদুরের পশমের মতো পোকামাকড়ভর্তি চুলওয়ালা এক নোংরা মহিলায় রূপান্তর করবে আমাদের। সে আমাদের মেরেও ফেলতে পারে। শীতে মা-বাবারা যখন চাইতেন, তাঁদের সন্তানরা ঘরের বাইরে না যাক, যখন তাঁরা বাঘ বা সিংহের গল্প শোনাতেন, যার প্রথম পদচিহ্ন তুষারের ওপরেই পরে। কেবল বাঘ বা সিংহের পদচিহ্ন দেখা গেলেই আমরা বাইরে যাওয়ার অনুমতি পেতাম।
যতই বড় হতে থাকলাম গ্রামটাকে ততই বিরক্তিকর মনে হতে লাগল।
একটি ধনী পরিবারের হুজরায় গ্রামের একমাত্র টিভি ছিল এবং কারোই কম্পিউটার ছিল না। অন্দরের বাইরে গেলেই মহিলারা চেহারা ঢেকে নিত এবং নিকটাত্মীয় নয় এমন পুরুষের সঙ্গে দেখা করতে বা কথা বলতে পারত না। আমি কৈশোরে পদার্পণ করার পরও আধুনিক পোশাক পরতাম, এমনকি চেহারাও ঢাকতাম না। আমার এক জ্ঞাতিভাই রেগে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘সে কেন আবৃত নয়?’ বাবা জবাব দিয়েছিলেন, ‘সে আমার মেয়ে। নিজের চরকায় তেল দাও।’ কিন্তু পরিবারের কেউ কেউ ভাবত, লোকজন আমাদের নিয়ে কানাঘুষা করবে এবং বলবে যে আমরা ‘পশতুন আদবকায়দা’ ঠিকমতো মানছি না।
পশতুন হিসেবে আমি খুবই গর্বিত, কিন্তু মাঝেমধ্যে মনে হয় আমাদের নিয়ম-নীতিতেও অনেক প্রশ্ন তোলার বিষয় আছে, বিশেষত যেখানে নারীদের প্রতি আচরণের ব্যাপার জড়িত। শাহিদা নামের তিন কন্যার জননী এক মহিলা আমাদের বাসায় কাজ করত, সে বলেছিল ১০ বছর আগে তার বাবা তাকে এক বৃদ্ধের কাছে বিয়ের নামে আড়ালে বিক্রি করে দেয়, যার একজন স্ত্রী ছিল; কিন্তু তা সত্ত্বেও সে কমবয়সী আরেকজন স্ত্রী চায়। মেয়েরা চলে গেছে মানেই তার বিয়ে হয়ে গেছে, তা নয়। সীমা নামের পনেরো বছর বয়সী এক সুন্দরী মেয়ে ছিল। সবাই জানত সে এক ছেলেকে ভালোবাসে এবং ছেলেটি যখন রাস্তা দিয়ে যেত, সীমা তখন সব মেয়ের ঈর্ষার বস্তু—তার দীর্ঘ আঁখিপক্ষের নিচ দিয়ে তাকে দেখত। আমাদের সমাজে কোনো মেয়ে কোনো ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করলে মেয়ের পরিবারের জন্য সেটা লজ্জাজনক, যদিও ছেলেদের জন্য সবই ঠিক আছে। আমরা শুনেছিলাম, সীমা আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু পরে জানা গেল, তার নিজের পরিবারই তাকে বিষ খাইয়েছে।
‘সোয়ারা’ নামের একটি নিয়ম আছে আমাদের, যাতে একটি দ্বন্দ্ব মিটমাট করতে এক গোত্রের একটি মেয়েকে অন্য গোত্রের কাছে দিয়ে দেওয়া যায়। আনুষ্ঠানিকভাবে এটা নিষিদ্ধ হলেও এর চল এখনো আছে। আমাদের গ্রামে সোরাইয়া নামের এক বিধবা তার পরিবারের সঙ্গে দ্বন্দ্ব থাকা আরেকটি গোত্রের এক বিপত্নীক লোককে বিয়ে করেছিল। বিধবার পরিবারের অনুমতি ছাড়া কেউ বিধবা নারীকে বিয়ে করতে পারে না। সোরাইয়ার পরিবার তাদের এই মিলনের খবর শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। বিপত্নীক লোকটির পরিবারকে তারা ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে লাগল, যতক্ষণ পর্যন্ত না মীমাংসার জন্য মুরব্বিরা ‘জিরগা’ বসালেন। জিরগায় সিদ্ধান্ত হলো, শাস্তি হিসেবে বিপত্নীক লোকটির পরিবারের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটিকে অন্যপক্ষের সবচেয়ে নিষ্কর্মা লোকটির সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে। ছেলেটা ছিল আমড়া কাঠের ঢেঁকি এবং এতই গরিব যে সব খরচ মেয়ের বাবাকেই বহন করতে হয়েছিল। যে দ্বন্দ্বে মেয়েটির কোনো সম্পৃক্ততাই ছিল না, সে দ্বন্দ্ব মিটমাট করতে কেন একটি নিরপরাধ মেয়ের জীবন ধ্বংস করতে হবে?
যখন বাবাকে আমি এসব ব্যাপারে অভিযোগ করলাম, বাবা বললেন যে আফগানিস্তানের নারীদের জীবন আরো কঠিন। আমার জন্মের আগে একচোখা এক মোল্লার দল ‘তালেবান’ সারা দেশের সব বালিকা বিদ্যালয় পুড়িয়ে দিচ্ছিল। পুরুষদের তারা হারিকেন বাতির মতো লম্বা দাড়ি রাখতে বাধ্য করত এবং মহিলাদের বোরখা পরতে বাধ্য করত। বোরখা পরে হাঁটা হলো বিশাল এক কাপড়ের কর্কের ভেতরে থেকে হাঁটার মতো, যাতে শুধু দেখার জন্য চোখের দিকে একটু জায়গা আছে এবং গরমের দিনে তা প্রায় চুলার ভেতর থাকার মতো অনুভূতি সৃষ্টি করে। অন্তত আমার কোনো বোরখা ছিল না। বাবা বললেন, তালেবান মহিলাদের জোরে হাসা, সাদা জুতা পরাও নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল, কারণ সাদা নাকি ‘পুরুষদের রং’। নখপালিশ লাগানোর শাস্তি হিসেবে মহিলাদের মারা হতো, আটকে রাখা হতো। বাবা এসব বলার সময় আমি কেঁপে উঠতাম।
‘আনা কারেনিনা’ এবং জেন অস্টেনের উপন্যাস পড়ে আমি বাবার কথা বিশ্বাস করা শুরু করেছিলাম: ‘মালালা পাখির মতো মুক্ত।’ আফগানিস্তানের নৃশংসতার কথা শুনলে সোয়াতবাসী হিসেবে আমি গর্বিতই হতাম। বলতাম, ‘এখানে মেয়েরা স্কুলে যেতে পারে।’ কিন্তু তালাবান আশপাশেই ছিল এবং তারা আমাদের মতোই পশতুন। আমার কাছে উপত্যকাটি ছিল এক রোদেলা স্থান, পর্বতের পেছনে জড়ো হতে থাকা মেঘগুলো আমি দেখতে পেতাম না। বাবা বলতেন, ‘তোমার স্বাধীনতা আমি রক্ষা করব, মালালা। তোমার স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাও।’
(চলবে)