কর্মমুখী প্রশিক্ষণ দিয়ে দুস্থ ও বেকার নারীদের স্বাবলম্বী করছে সাবার
কর্মমুখী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উৎপাদনশীল কাজের সুযোগ দিয়ে দুস্থ ও বেকার নারীদের স্বাবলম্বী করছে সাবার (Sabr)। দুস্থ ও কর্মহীন নারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করে যার যার বাসায় বসেই বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজ করিয়ে থাকে সাবার। যাতে দুস্থ নারীরা কাজের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে সম্মানের সাথে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। সেই সাথে তারা নারী-পুরুষের বেতন বৈষম্য কমিয়ে আনতেও সচেষ্ট। সাবারের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দরিদ্র ও অসহায় নারীদের কর্মসংস্থান। পাশাপাশি টেকসই কাপড় যা আমাদের প্রাকৃতিক দূষণ রোধ করে এবং আমাদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারে, তা নিয়ে সাবার কাজ করে চলেছে।
বিশ্বজুড়ে করোনার অভিঘাত ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে অনেক উৎপাদনশীল ছোট ছোট পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। এতে অনেক শ্রমজীবী নারী বেকার হয়ে পড়েন। তাছাড়া আমাদের সমাজের চারপাশে এখনও অনেক দুস্থ নারী মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের কথা চিন্তা করে এ বছরের শুরু থেকে প্রথমে ৯ জন দুস্থ নারীকে অর্থের বিনিময়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে সাবার।
সাবারের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশের দুস্থ ও নির্যাতিত নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে টেকসই কেমিক্যালমুক্ত কাপড় দিয়ে তৈরি মেয়েদের বিভিন্ন পোশাক, যেমন- সালোয়ার-কামিজ, শাড়ি, কোর্ট, টপস, স্কার্ফ ইত্যাদিতে হাতের কাজ করে বিদেশে বিশেষ করে আমেরিকার ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা। আর এই বিক্রিত পণ্য থেকে লাভের সকল টাকা এই দুস্থ নারীদের পারিশ্রমিক হিসেবে বণ্টন করা।
শুরুতে তাদের প্রতিদিন প্রশিক্ষণ নিতে আসার জন্য ৫০০ টাকা করে দেওয়া হয়। এতে করে তাদের সংসারে কিছুটা স্বচ্ছলতা ফিরে আসে। সেই ৯ জন প্রশিক্ষিত নারী বর্তমানে প্রোডাকশনের কাজ করেন। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন আরও ১০ জন; যাদের মধ্যে রয়েছে শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। অনেকেই এই কাজে আসার আগে অর্ধাহারে অনাহারে অনেক কষ্ট করে দিন পার করতেন।
উপকারভোগীরা জানান, তাদের সময়োপযোগী প্রশিক্ষণের ফলে কাজের যেমন গতি বাড়ে তেমনি তাদের তৈরি পণ্যের গুণগত মানও বৃদ্ধি পায়। ফলে তাদের মজুরিও দ্বিগুণ বাড়ে। এখন তারা অনেকটা স্বচ্ছন্দে জীবনযাপন করতে পারছেন। কারণ এই পেশার অন্য যে কারো চাইতে তাদের বেতন এখন বেশি।
এখানে কাজের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে উপকারভোগী নুরজাহান আক্তার পান্না বলেন, আমি এখানে বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজ করি, যা সুঁই-সুতা দিয়ে করতে হয়। আমার সংসারে আমি আমার প্রতিবন্ধী মেয়ে, ছেলে ও স্বামীকে নিয়ে থাকি। আমার প্রতিবন্ধী মেয়ে আগে স্কুলে পড়তো না। কিন্তু এখানে কাজ করার পরে আমি আমার মেয়েকে একটি প্রতিবন্ধী স্কুলে পড়াতে পারছি। আমার সংসার আগের থেকে অনেক ভালোভাবে চলে।
আরেক শ্রমজীবী নারী আমেনা আলম বলেন, আমি বিভিন্ন ধরনের শাড়ি, স্যালোয়ার কামিজে হাতে কাজ করি। এখানেই ট্রেনিং নিয়ে যে কাজ শিখেছি, এখন সেই কাজের টাকা দিয়ে আমার সংসার চলছে।
প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশের কান্ট্রি কোঅর্ডিনেটর ও ম্যানেজার ওয়াফি ইসলাম বলেন, আমি গত ছয় মাস ধরে এখানে কাজ করছি। আমি সাবেরা চৌধুরীর সাথে কাজ করে আনন্দিত। কারণ তার দেশের প্রতি ভালোবাসা তার সাথে আমার কাজের অনুপ্রেরণা যোগায়। তিনি বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া দুস্থ মহিলাদের নিয়ে টেকসই কাপড় দিয়ে পোশাক তৈরি করেন; যা প্রকৃতি ও পরিবেশবান্ধব।
প্রতিষ্ঠানটির সুপারভাইজার নাদিরা সুলতানা পারভীন বলেন, আমি হাতের কাজ করি ৪৬ বছর ধরে। এখানে গত ছয় মাস ধরে কাজ করছি। আমি এখানে দুস্থ মেয়েদের কাজ শেখাই। এর আগে আমি অনেক কোম্পানিতে কাজ করেছি। কিন্তু সাবেরা চৌধুরীর সাথে কাজ করে আমি অনেক আনন্দিত। কারণ উনি আমাদের ন্যায্য বেতন দেন যা বাংলাদেশের বেতন স্কেলের থেকে দ্বিগুণ। আমরা তার থেকে এই টাকা নিয়ে আমাদের সংসার চালাই এবং আগের থেকে আমাদের সংসার এখন অনেক ভালোভাবে চলছে।
প্রতিষ্ঠানটির স্বপ্নদ্রষ্টা মিসেস সাবেরা চৌধুরী আমেরিকায় শিক্ষকতা করেন। তার বেতনের সিংহভাগ বাংলাদেশের এই দুঃস্থ মহিলাদের পেছনে ব্যয় করেন। এই উদ্যোগ প্রসঙ্গে সাবেরা চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের দুস্থ ও খেটে খাওয়া মহিলা, যারা এই প্রতিষ্ঠানটির সাথে যুক্ত, তারা নিজ বাসায় নিজের পরিবারের কাজ সামলে একটি নিরাপদ পরিবেশে থেকে গুণগত মানসম্পন্ন ও পরিবেশবান্ধব কাপড় দিয়ে নানা প্রকার পোশাক তৈরি করে তাদের পরিবারকে স্বচ্ছল রাখতে পারছেন, এটাই হচ্ছে আমাদের সাফল্যের জায়গা।
সাবেরা চৌধুরী আরও বলেন, পরিবেশ দূষণরোধে টেকসই কাপড় তৈরিতে সাবার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বাংলাদেশের আদি বুনন যেমন রাজশাহীর রেশম সিল্ক, তাঁতের তৈরি কাপড়, জামদানি ইত্যাদি কাপড় দিয়ে সাবার পোশাক তৈরি করছে; যাতে করে বাংলাদেশের আদি বুনন শিল্প রক্ষা পায় এবং বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় থাকে। এরকমভাবে যদি সবাই এগিয়ে আসে, তাহলে সমাজে বেকার ও দুস্থ নারীরা স্বাবলম্বী হবে। এতে উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রসার ঘটবে।