নওগাঁয় কালোবাজারিদের দখলে ভিজিএফ কার্ডের চাল
লাইনে দাঁড়িয়ে আছে ৮-১২ বছরের কয়েকজন শিশু। আগে দাঁড়ানোর জন্য হুড়োহুড়িও করছে তারা। তাদের হাতে বস্তা। কিছু নেওয়ার জন্য তারা দাঁড়িয়েছে। তবে নিজের জন্য না, অপরের চাল নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। একবার নিয়ে যেতে পারলে ১০ টাকা করে পাবে। এমনই ঘটনা দেখা যায়, নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার বিলাসবাড়ী ইউনিয়নে।
সরকার থেকে দেওয়া দরিদ্র মানুষের মাঝে ভিজিএফের চাল বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে উপজেলার বিলাসবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের বিরুদ্ধে। মঙ্গলবার (২৭ জুন) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বদলগাছী উপজেলার বিলাসবাড়ি ইউনিয়নে ২ হাজার ২৮৫ জন কার্ডধারী দরিদ্র মানুষের মাঝে বিনামূল্যে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করার কথা। কিন্তু সেখানে বিতরণ করা হয়েছে ৯ কেজি করে।
সরেজমিনে দেখা যায়, সরকার থেকে দরিদ্রদের জন্য দেওয়া ভিজিএফ এই চালগুলো ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন শিবপুর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে বিতরণ করা হচ্ছে। শিশুরা হাতে করে চালের কার্ড নিয়ে এসে চাল নিয়ে যাচ্ছে। ওই এলাকার কিছু অসাধু ব্যবসায়ী শিশুদের হাতে ১০ টাকার বিনিময়ে একটি করে চালের কার্ড দিচ্ছে। শিশুরা চাল উঠিয়ে নিয়ে এসে অসাধু কালোবাজারি চাল ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। যে যতবার আনছে সে ততবার ১০ টাকা করে পাচ্ছে। ১০ টাকার বিনিময়ে ৯ কেজি চাল পাচ্ছে অসাধু চাল ব্যবসায়ীরা।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, আগের রাতে ও সোমবার (২৬ জুন) সকালে কালোবাজারিদের হাতে থাকা ওই সকল কার্ড ২৫০ থেকে ৩০০ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেছে কার্ডধারীরা।
স্থানীয় উজ্জ্বল মণ্ডল নামে এক ব্যক্তি বলেন, চাল বিতরণের আগের রাতেই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য ও দলীয় নেতা-কর্মীরা কার্ড বিক্রি করে দেন কালোবাজারিদের কাছে।
অবশ্য তার কথার সাথে মিল পাওয়া যায় স্থানীয় ইয়াকুব নামের এক ব্যবসায়ীর। তিনি জানান, আগের দিনেই কার্ডগুলো বিক্রি হয়ে গেছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায়। আমি এখন পর্যন্ত এক বস্তাও কিনতে পারিনি।
১০ বছরের এক শিশু মোরসালিন ৯ বার চাল নিয়ে যাওয়ায় খুশি। আবারও কার্ড নিয়ে চাল নিতে এসেছে। কতো টাকা পেয়েছ? জিজ্ঞেস করতেই বলে উঠল-‘একবারে দিবে’। এরকম প্রায় অর্ধ শতাধিক শিশু চাল উঠানোর জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। তারা কেউ দুবার, কেউ তিনবার চাল নিয়ে যেতে পেরেছে। এমনকি লাইনে দাঁড়ানোর জন হুড়োহুড়ি পর্যন্ত করতে দেখা যায় তাদের। কারণ যতবার নিয়ে যেতে পারবে ততবার ১০ টাকা করে পাবে তারা। এভাবেই অসাধু ব্যবসায়ীরা এইসব শিশুদের ব্যবহার করছে।
তাকে কে পাঠিয়েছে জানতে চাইলে এক শিশু জানায়, শামীম হোসেন নামের ব্যবসায়ী পাঠিয়েছে।
চাল ব্যবসায়ী শামীম হোসেন ও গৌড় চন্দ্রসহ চারজন একসাথে চাল কিনছে। তারা বলেন, এখানে মিনিমাম ২০ জনের মতো চাল কিনছে। আমরা চার জন মিলে কিনছি দুটো পয়সা কামাইয়ের জন্য। ভাই আপনার সমস্যা হচ্ছে। এখানে সবাই কিনছে, সবাই বিক্রি করছে। আপনি থাকলে ওরা চাল নিয়ে আসতে ভয় পাচ্ছে।
বল্লামপুর গ্রামের সুফিয়াসহ দুইজন অসহায় নারী জানান, যাদের ঘরে চাল আছে তাদেরকেই চাল দিয়েছে। ‘আমাদের ঘরে চাল নেই আমরা চাল পাই না। আমরা কার্ডের চাল নিতে এসেছি। যাদের কার্ড আছে তাদের দেওয়া শেষ হলে আমরা চাল নিবো।’ চেয়ারম্যানের কাছে গেলে তিনি যেটুকু পারেন চাল দিবেন বলে তাদের আশা।
তবে স্থানীয় অনেকে জানালেন, এই কার্ডগুলোর অনেক ভাগ হয়। চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য ও দলীয়ভাবে।
ইউনিয়নের এনামুল নামের স্থানীয় এক বাসিন্দাসহ অনেকে জানান, ১০ কেজি করে চাল দেওয়ার কথা থাকলেও পরিমাণে ১ থেকে দেড় কেজি চাল কম দেওয়া হয়। কম দেওয়ার প্রমাণও পাওয়া গেছে। অবশিষ্ট চাল যাদের কার্ড নেই তাদের মাঝে ঠিকভাবে বিতরণ করা হয় কি না, সেটাও দেখার বিষয়।
৪০ বছরের এক যুবক চাল নিতে যাচ্ছে। তার হাতে আছে দুটো কার্ড। আরেক ভ্যানচালকের হাতে দেখা যায় ১৪টি কার্ড। এভাবেই এই ইউনিয়নে গরীবের চাল যাচ্ছে কালোবাজারিদের হাতে।
বিলাসবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান মুঠোফোনে বলেন, আমার ইউনিয়নে মোট ২ হাজার ২৮৫ জনকে এই কার্ড দেওয়া হয়েছে। এর বাইরেও আরও কিছু দরিদ্র মানুষকে চাল দেওয়া হয়ে থাকে। চাল যদি অবশিষ্ট থাকে সেক্ষেত্রে তাদেরকে দেওয়া যায়।
শিশুরা ১০ টাকার বিনিময়ে কার্ড নিয়ে গিয়ে চাল উঠাচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই বিষয়টি আমার জানা ছিল না।
চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান, আমি নিজ হাতে সর্বোচ্চ দুইশ কার্ড বিতরণ করতে পেরেছি। আমি যদি সকল কার্ড নিজে বিতরণ করতে পারতাম, তাহলে মনে হয় ব্যবসায়ীরা চাল কেনার এই সুযোগ পেত না। আমার পক্ষে নিজে গিয়ে ২ হাজার ২৮৫ জন মানুষের মাঝে কার্ড বিতরণ করা সম্ভব না। এর মধ্যে অর্ধেক কার্ড আমি চোখে দেখতে পারি না। বাকি কার্ড ইউপি সদস্যসহ অন্যরা মিলে বিতরণ করেছে। যাদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে তাদের মধ্যে হয়তো বা কিছু লোক টাকার বিনিময়ে কার্ডগুলো ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করেছে। তবে শিশুদের দিয়ে এই কাজ করানো ঠিক না। আমি পরবর্তীতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।
তবে, তিনি স্বীকার করেন চাল দেওয়া হচ্ছে ৯ কেজি করে।
একটি বালতি মেপে নিয়ে সেই বালতি দিয়ে চাল দেওয়া হচ্ছে। তবে, পাশে একটা ডিজিটাল মাপযন্ত্র আছে। তাতে বালতির মাপের চাল ওজন দিলে ৮ কেজি ৯৫০ গ্রাম ওজন দেখা যায়।
শিশুদের ব্যবহার করে কালোবাজারিরা চাল কিনছে এবং ওজনে এক কেজি করে কম দেওয়া হচ্ছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলপনা ইয়াসমিন মুঠোফোনে বলেন, এ বিষয়ে আমি অভিযোগ পেয়েছি। যাদের কার্ড দিয়ে ব্যবসায়ীরা এই চাল উঠাচ্ছে, তাদের নাম দিলে আমি কার্ড বাতিল করবো। এ বিষয় প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ও কার্ডধারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিষয়টি আমি গুরুত্ব সহকারে দেখছি।