২০২৩ সালে বিশ্বের শীর্ষ ১০ শক্তিশালী মুদ্রা
বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড এবং অর্থনৈতিক লেনদেনে সাবলীলতার দরুণ মুদ্রা বিশ্ব অর্থনীতির একটি অপরিহার্য উপাদান। স্বভাবতই সবগুলো মুদ্রা মূল্যমান এক পাল্লায় পরিমাপ করা হয় না। এমনকি কিছু কিছু মুদ্রা অন্যগুলোকে ছাড়িয়ে আশ্চর্যজনক উচ্চতায় উঠে আসে। এই আকাশচুম্বী তারতম্যের কারণ কী! বর্তমান বিশ্বের সব থেকে দামি ১০টি মুদ্রার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পাশাপাশি চলুন পটভূমিটাও জেনে নেওয়া যাক।
বৈদেশিক মুদ্রার মান নির্ধারণ হয় কীভাবে?
বৈদেশিক মুদ্রার মূল্যমান মূলত নির্ধারিত হয় দুটি প্রধান উপায়ে: ফ্লোটিং রেট ও ফিক্সড রেট।
ফ্লোটিং রেট
এই রেটটি নির্ধারিত হয় মুক্ত বাজারে সরবরাহ ও চাহিদার বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। যখন একটি মুদ্রার চাহিদা বেশি হয়, তখন এর মূল্য বাড়ে। আর চাহিদা কমার সঙ্গে সঙ্গে তার দামটা পড়তে থাকে। বিভিন্ন প্রযুক্তিগত এবং মৌলিক কারণ একটি ন্যায্য বিনিময় হার সম্পর্কে মানুষের ধারণাকে প্রভাবিত করে। আর সেই অনুযায়ী পরিবর্তন হতে থাকে চাহিদা ও সরবরাহ।
উদাহরণস্বরূপ, ইউরোপীয়দের মধ্যে মার্কিন ডলারের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে ইউরোর তুলনায় মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে যায়। এর পেছনে নটবর হিসেবে কাজ করে সুদের হারের পরিবর্তন, বেকারত্বের হার, মুদ্রাস্ফীতি ও ভূ-রাজনৈতিক ঘটনাগুলো।
ফিক্সড রেট
বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হিসেবে একটি দেশের সরকার নিজেদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট হার নির্ধারণ করে দেয়। এই হার বজায় রাখার জন্য সরকার সেই বিদেশি মুদ্রার বিপরীতে নিজস্ব মুদ্রা ক্রয় ও বিক্রয় করে। স্বল্পমেয়াদে ফ্লোটিং রেটের গতিবিধিকে ঘিরে দানা বাধতে থাকে অনুমান ও গুজব। কখনো সত্যিকার অর্থেই রেটের বিপর্যয় ঘটে, যার সূত্র ধরে পরিবর্তিত হতে থাকে দৈনন্দিন সরবরাহ ও চাহিদা। স্বল্পমেয়াদের এই অস্থিরতার চরম অবস্থায় সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো হস্তক্ষেপ করে।
অর্থাৎ একটি মুদ্রার দাম অত্যধিক বেশি বা কম হয়ে গেলে সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর এই হস্তক্ষেপ ঘটে। অন্যথায় এই অস্থিতিশীলতাটি দেশের অর্থনীতি, বাণিজ্য ও ঋণ পরিশোধের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সর্বোপরি, মুদ্রার ফ্লোটিং রেটকে তুলনামূলকভাবে অনুকূল অবস্থায় নিয়ে আসার জন্য ফিক্সড রেটের ব্যবস্থাগুলো প্রয়োগ করা হয়।
২০২৩ সালে পৃথিবীর শীর্ষ ১০ মূল্যবান মুদ্রা
কুয়েতি দিনার
বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দামি মুদ্রা হলো কুয়েতি দিনার (কেডব্লিউডি), যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রায় যার বিনিময় হার ৩ দশমিক ২৭ মার্কিন ডলার। কুয়েতের ভৌগলিক অবস্থান সৌদি আরব এবং ইরাকের মাঝে হওয়ায় দেশটিকে তেল রপ্তানিকারক হিসেবে বিশ্বব্যাপী শীর্ষস্থানীয় পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। ১৯৬০-এর দশকে প্রবর্তিত মুদ্রা দিনার সর্বপ্রথম ব্রিটিশ পাউন্ডের বিপরীতে ফিক্সড রেট করা হয়েছিল। এই কৌশলগত পদক্ষেপটি কুয়েতকে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং একক মুদ্রামুখী ঝুঁকিগুলো হ্রাস করতে সাহায্য করে। বর্তমানে বাংলাদেশে ১ কুয়েতি দিনারের দাম ৩৫৩ দশমিক ৭০ টাকা।
বাহরাইন দিনার
বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় শক্তিশালী মুদ্রা হিসেবে রয়েছে বাহরাইন দিনার (বিএইচডি), যার বিনিময় হার ২ দশমিক ৬৫ মার্কিন ডলার। পারস্য উপসাগরের একটি দ্বীপরাষ্ট্র হিসেবে দেশটি তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য তেল ও গ্যাস রপ্তানির উপর অনেকাংশে নির্ভর করে। এই দিনারের প্রবর্তন হয় ১৯৬৫ সালে এবং সরাসরি মার্কিন ডলারের বিপরীতে এর ফিক্সড রেট ধার্য করা হয়। তখন থেকেই এটি একটি স্থিতিশীল মুদ্রার মান নিশ্চিত করে বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের সুবিধা দিয়ে আসছে। ১ বাহরাইন দিনারের বর্তমান বাংলাদেশি মূল্য ২৮৭ দশমিক ২১ টাকা।
ওমানি রিয়াল
২ দশমিক ৬০ মার্কিন ডলার মূল্যমানের ওমানি রিয়াল (ওএমআর) বিশ্বব্যাপী তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যয়বহুল মুদ্রার অবস্থান ধরে রেখেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইয়েমেনের মধ্যে অবস্থিত ওমান একটি স্বনামধন্য তেল ও গ্যাস রপ্তানিকারক। ওমানি রিয়াল ১৯৭০-এর দশকে চালু করা হয়েছিল এবং বাহরাইনের মতোই মার্কিন ডলারের বিপরীতে এর রেট ফিক্সড করা হয়। সেই থেকে এই মুদ্রাটি সব রকম নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করে আন্তর্জাতিক লেনদেন সহজতর করে আসছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ওমানি রিয়ালের হার চলছে ২৮১ দশমিক ২৩ টাকা।
জর্দানিয়ান দিনার
বিশ্বব্যাপী শক্তিশালী মুদ্রাগুলোর তালিকায় চতুর্থ স্থানে থাকা মুদ্রাটির নাম জর্দানিয়ান দিনার (জেওডি), যার মূল্য ১ দশমিক ৪১ মার্কিন ডলার। স্থলবেষ্টিত হওয়া সত্ত্বেও তেল ও গ্যাস ছাড়াও বৈচিত্র্যময় সম্পদে ভরপুর জর্ডান। তবে এর অর্থনৈতিক অগ্রগতি কিছুটা ধীরগতির এবং ক্রমবর্ধমান ঋণ সহ বেশ কিছু অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতার মুখে রয়েছে দেশটি। মার্কিন ডলারের বিপরীতে ১৯৫০ সালে প্রবর্তিত এই দিনারের রেট ফিক্সড করা হয়। তাই প্রথম দশকগুলোতে দেশটি আর্থিক স্থিতিশীলতার অভিজ্ঞতা লাভ করে। এখন ১ জর্ডানিয়ান দিনারের দাম ১৫২ দশমিক ৬৫ বাংলাদেশি টাকা।
ব্রিটিশ পাউন্ড
যৌথভাবে পঞ্চম স্থানে থাকলেও সামগ্রিক দিক থেকে কিছুটা এগিয়ে ১ দশমিক ৩১ মার্কিন ডলার রেটের ব্রিটিশ পাউন্ড (জিবিপি)। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, জিডিপি (মোট দেশীয় পণ্য) এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্য। ১৪০০-এর দশকে পাউন্ডের প্রচলনটা হয়েছিল একটি মুক্ত ভাসমান মুদ্রা হিসেবে। অর্থাৎ মুক্ত বাজারই ছিল এর মূল্য নির্ধারক। মুদ্রার এই প্রকৃতি যুক্তরাজ্যকে অর্থনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে মানিয়ে চলতে এবং একটি স্বতন্ত্র আর্থিক নীতি অনুসরণ করার শক্তি জুগিয়েছিল। বাংলাদেশি টাকায় এই জনপ্রিয় মুদ্রার বর্তমান মূল্য ১৪২ দশমিক ০৮ টাকা।
জিব্রাল্টার পাউন্ড
১ দশমিক ৩০ মার্কিন ডলার বিনিময় হার নিয়ে ব্রিটিশ পাউন্ডের সঙ্গে একই স্থানে রয়েছে জিব্রাল্টার পাউন্ড (জিআইপি)। জিব্রাল্টার স্পেনের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত একটি ব্রিটিশ অঞ্চল, যার মুদ্রার প্রচলন হয়েছিল ১৯২০-এর দশকে। সরাসরি ব্রিটিশ পাউন্ডের সমান হওয়ায় মুদ্রাটি এই অঞ্চলের মধ্যে একটি স্থিতিশীল এবং সহজে বিনিময়-যোগ্যতা নিশ্চিত করেছিল। বাংলাদেশে এই পাউন্ডের দাম বর্তমানে ১৩৯ দশমিক ৪৩ টাকা।
কেম্যান আইল্যান্ড ডলার
সবচেয়ে ব্যয়বহুল মুদ্রার তালিকায় সপ্তম স্থানটিতে রয়েছে ১.২১ মার্কিন ডলার দামের এই মুদ্রাটি (কেওয়াইডি)। উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোর আন্তর্জাতিক ব্যবসা এবং বিনিয়োগের জন্য একটি আর্থিক কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে কেম্যান দ্বীপপুঞ্জ। ১৯৭০-এর দশকে প্রবর্তিত এই মুদ্রার ফিক্সড রেট নির্ধারিত হয় মার্কিন ডলারের বিপরীতে। বাংলাদেশি টাকায় এর বর্তমান মূল্য ১৩০ দশমিক ৫৭ টাকা।
সুইস ফ্রাঙ্ক
বিশ্বের অষ্টম দামি মুদ্রাটি হচ্ছে সুইস ফ্রাঙ্ক (সিএইচএফ) এবং এর বিনিময় হার ১ দশমিক ১৭ মার্কিন ডলার। সুইজারল্যান্ড ও লিচেনস্টাইন তাদের সরকারি আইনি দরপত্র হিসেবে ব্যবহার করে এই মুদ্রা। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বিখ্যাত সুইজারল্যান্ডকে বিনিয়োগকারীদের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৮৫০ সালে প্রবর্তিত সুইস ফ্রাঙ্ক ইউরোর বিপরীতে ফিক্সড রেটে ধার্য করা হয়েছিল। পরবর্তীতে এটি মুক্ত ভাসমান মুদ্রায় রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে এর বিনিময় হার চলছে ১২৬ দশমিক ১৮ টাকা।
ইউরো
বিশ্ব জুড়ে জনপ্রিয় এই মুদ্রাটি (ইইউআর) এখন বিশ্বের নবম শক্তিশালী মুদ্রা। ইউরোর বর্তমান মূল্য ১ দশমিক ১২ মার্কিন ডলার। ইউরোজোন গঠিত ২৭টি দেশের ২০টিরই সরকারি মুদ্রা এই ইউরো। ২০০২ সালে ধাতব মুদ্রা আকারে প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে এটি অর্থনৈতিক একীকরণের সুবিধা দিয়ে আসছে। পাশাপাশি উৎসাহিত করে আসছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যকার সাবলীল বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে। বাংলাদেশে এর বর্তমান বিনিময় হার ১২১ দশমিক ৫২ টাকা।
মার্কিন ডলার
বিশ্ব জুড়ে শীর্ষ ১০টি ব্যয়বহুল মুদ্রার তালিকায় সর্বশেষ অবস্থানটি মার্কিন ডলারের (ইউএসডি)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নির্দিষ্ট মার্কিন অঞ্চল এবং ইকুয়েডর ও জিম্বাবুয়ের মতো অন্যান্য সার্বভৌম দেশগুলোতে এটি আইনি দরপত্র হিসাবে কাজ করে। বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে মার্কিন ডলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে একটি বিশিষ্ট অবস্থান ধারণ করে। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করা মুদ্রাটি হচ্ছে এটি।
এছাড়া বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর প্রাথমিক রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে কাজ করে এই ডলার। তেল, স্বর্ণ ও তামাসহ বিভিন্ন পণ্যের মূল্য নির্ধারণের মানদণ্ড এই মুদ্রা। মার্কিন ডলারের বর্তমান মূল্যমান ১০৮ দশমিক ২৭ বাংলাদেশি টাকা।