আমি মালালা বলছি
কেন আমি কানের দুল পরি না
৫
কেন আমি কানের দুল পরি না এবং কেন পশতুনরা ধন্যবাদ দেয় না
সাত বছর বয়সেই আমি ক্লাসের শীর্ষে থাকতাম। শিক্ষার্থীদের সমস্যায় আমি তাদের সাহায্য করতাম। আমার সহপাঠীরা বলত, ‘মালালা খুব প্রতিভাবান মেয়ে।’ আমি সবকিছুতেই অংশ নিতাম—ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট, ছবি আঁকা, এমনকি গানও, যদিও আমি খুব ভালো গাইতাম না। একদিন মালকা-ই-নূর নামের একটি নতুন মেয়ে যখন ক্লাসে ভর্তি হলো, আমি তাকে প্রায় পাত্তাই দিলাম না। তার নামের অর্থ ‘আলোর রানী’ এবং সে পাকিস্তানের প্রথম নারী সেনাপ্রধান হতে চাইত। তার মা অন্য একটি স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন এবং এটি লক্ষণীয় ছিল কারণ, আমাদের কারো মা-ই চাকরি করতেন না। প্রথম প্রথম সে ক্লাসে চুপচাপ থাকত। আমার সঙ্গে আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী মনিবার প্রতিযোগিতা চলত। মনিবার হাতের লেখা এবং উপস্থাপনের ঢং সুন্দর ছিল, যা পরীক্ষকরা পছন্দ করতেন; কিন্তু আমি ভালোভাবেই জিততাম। তাই বার্ষিক পরীক্ষায় মালকা-ই-নূর যখন প্রথম স্থান অধিকার করল, আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। বাসায় এসে আমি অনেক কেঁদেছি। মা আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন।
এমন সময়েই মনিবার সঙ্গে আমরা যে পাড়ায় থাকতাম, সে পাড়া থেকে এমন একটা পাড়ায় আমরা চলে গেলাম, যে পাড়ায় আমার কোনো বন্ধু ছিল না। নতুন পাড়ায় আমার চেয়ে বয়সে কিছুটা ছোট একটা মেয়ে ছিল, ওর নাম সাফিনা। আমরা একসঙ্গে খেলতে শুরু করলাম। সে ছিল মা-বাবার অতিরিক্ত প্রশ্রয়প্রাপ্ত একটা মেয়ে। তার প্রচুর পুতুল ছিল এবং জুতার বাক্স ভর্তি অলংকার ছিল। কিন্তু বাবার কিনে দেওয়া গোলাপি প্লাস্টিকের খেলনা মোবাইল ফোনটা ছাড়া আমার আর কোনো খেলনা ছিল না এবং সে ওটার প্রতি নজর দিল। বাবা সারাক্ষণ মোবাইলে কথা বলতেন এবং আমি আমার মোবাইলে মানুষকে কল করার অভিনয় করতে ভালোবাসতাম। একদিন ওটা হারিয়ে গেল।
কয়েক দিন পর হুবহু আমার ফোনটার মতো একটা ফোন আমি সাফিনার কাছে দেখলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওটা তুমি কোথায় পেয়েছ?’ সে বলল, ‘এটা আমি বাজার থেকে কিনেছি।’
এখন আমি বুঝি সে হয়তো সত্যই বলছিল; কিন্তু তখন আমি ভাবলাম, ‘সে আমার সঙ্গে যা করেছে, আমিও তার সঙ্গে তা-ই করব। আমি ওর বাসায় পড়ালেখা করতে যেতাম, তাই যখন যেতাম তখনই পকেটে করে ওর খেলনা, কানের দুল বা গলার হার নিয়ে আসতাম। কাজটা সহজ ছিল। চুরি করাটা প্রথম প্রথম রোমাঞ্চকর লেগেছিল, কিন্তু এই রোমাঞ্চ বেশিদিন থাকেনি। শিগগিরই চুরি করাটা আমার কাছে বাধ্যতামূলক হয়ে উঠল। আমি থামতে পারতাম না।
এক বিকেলে অন্যান্য দিনের মতোই স্কুল থেকে ফিরে আমি নাশতার আশায় রান্নাঘরে ছুটলাম। মাকে ডাক দিলাম, ‘ও ভাবি! ক্ষিধেয় পেট চোঁ চোঁ করছে!’ সবকিছু নিস্তব্ধ। মা মেঝেতে বসে উজ্জ্বল রঙের হলুদ ও জিরা বাটছিলেন, বাতাস সুগন্ধে মৌ মৌ করছিল। তিনি বাটতেই থাকলেন, আমার চোখের দিকে তাকালেন না। আমি কী দোষ করেছি? খুব দুঃখ পেয়ে আমি আমার ঘরে ঢুকলাম। কাবার্ড খুলে দেখলাম, আমার চুরি করা জিনিস একটাও নেই। আমি ধরা পড়ে গেছি।
আমার দূরসম্পর্কের বোন রীনা আমার ঘরে ঢুকল। ‘তাঁরা জানতেন তুমি চুরি করছ,’ সে বলল। ‘তাঁরা শুধু তোমার সংশোধন হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, কিন্তু তুমি চালিয়েই গেছ।’
পেটের ভেতর ভয়ানক এক ডুবে যাওয়ার অনুভূতি টের পেলাম। মাথা নিচু করে আবার মায়ের কাছে গেলাম। ‘তুমি ভুল করেছ, মালালা,’ তিনি বললেন। ‘তুমি কি আমাদের এমন লজ্জা আনার চেষ্টা করছ যে আমাদের এসব জিনিস কিনে দেওয়ার সামর্থ্য নেই?’
‘এটা সত্য নয়!’ আমি মিথ্যা বলার চেষ্টা করলাম। ‘আমি ওগুলো নিইনি।’ কিন্তু মা জানতেন, আমি নিয়েছি। আমি প্রতিবাদ করে বললাম, ‘সাফিনাই শুরু করেছিল। আবার কিনে দেওয়া ফোনটা সে-ই চুরি করেছে।’
মা অটল। তিনি বললেন, ‘সাফিনা তোমার চেয়ে ছোট এবং তাকে তোমার ভালো কিছু শেখানো উচিত ছিল। তোমার একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করা উচিত ছিল।’
আমি কাঁদতে শুরু করলাম এবং বারবার দুঃখ প্রকাশ করতে থাকলাম। ‘আবাকে বলো না,’ আমি মিনতি করলাম। বাবা আমার প্রতি হতাশ হলে, এটা আমি সহ্য করতে পারব না। মা-বাবার চোখে অযোগ্য হয়ে পড়ার অনুভূতিটা খুবই ভয়াবহ।
এটাই প্রথম নয়। ছোট থাকতে আমি মায়ের সঙ্গে বাজারে গিয়ে ঠেলাগাড়িতে কাঠবাদামের একটি স্তূপ লক্ষ করলাম। দেখে খুবই সুস্বাদু মনে হচ্ছিল এবং একমুঠো ছিনিয়ে নেওয়ার লোভ আমি সামলাতে পারলাম না। মা আমাকে বকা দিলেন এবং ঠেলাগাড়ির মালিকের কাছে দুঃখ প্রকাশ করলেন। কিন্তু সে ক্রোধান্বিত ছিল এবং শান্ত হলো না। আমাদের তখনো অল্প কিছু অর্থ বাকি ছিল এবং কতটুকু আছে, তা দেখার জন্য মা পার্স খুললেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি ১০ রুপিতে আমার কাছে এগুলো বিক্রি করবেন?’ সে জবাব দিল, ‘না। কাঠবাদাম খুবই দামি।’
মা খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে বাবাকে জানালেন। বাবা তক্ষুনি গিয়ে লোকটার পুরো কাঠবাদামের লট কিনে একটি কাচের পাত্রে রেখে দিলেন।
‘কাঠবাদাম ভালো,’ বাবা আমাকে বললেন। ‘ঘুমানোর আগে দুধ দিয়ে কাঠবাদাম খেলে বুদ্ধি বাড়ে।’ কিন্তু আমি জানতাম, তাঁর খুব বেশি টাকা-পয়সা ছিল না এবং কাঠবাদামের পাত্রটা আমার কুকর্মের স্মারক। আমি নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করলাম, এমন কিছু আর কখনো করব না। কিন্তু আমি আবার একই রকম কাজ করে বসেছি। মা আমাকে সাফিনা ও ওর মা-বাবার কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে নিয়ে গেলেন। কাজটা খুব কঠিন ছিল। সাফিনা আমার ফোনটা নিয়ে কিছুই বলেনি, যেটা আমার কাছে ন্যায্য মনে হলো না, কিন্তু আমিও আর কথাটা তুললাম না।
যদিও আমার খারাপ লেগেছিল, ওই ঘটনা শেষ হয়েছে বলে আমি স্বস্তিও পেয়েছিলাম। ওই দিন থেকে আমি কখনো মিথ্যা বলিনি বা চুরি করিনি। একটা মিথ্যাও না, একটা পয়সাও না, এমনকি বাবা যেসব পয়সা ঘরে ফেলে যান এবং নাশতা খাওয়ার জন্য যেসব পয়সা আমাদের নেওয়ার অনুমতি ছিল, সেগুলোও না। আমি অলংকার পরাও বন্ধ করে দিলাম, কারণ আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করতাম, ‘এই সস্তা অলংকারগুলোই কি আমাকে প্রলুব্ধ করছে? এই তুচ্ছ ধাতব অলংকারের জন্য কেন আমি আমার চরিত্র নষ্ট করব?’ কিন্তু আমার মধ্যে এখনো অপরাধবোধ আছে এবং আজো আমি প্রার্থনার সময় সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি।
বাবা-মা একে অপরকে সবকিছু বলেন এবং আবা দ্রুতই বুঝে ফেললেন কেন আমি মন খারাপ করে ছিলাম। তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারলাম, তাঁর শিক্ষা আমি ব্যর্থ করে দিয়েছি। স্কুলে আমি প্রথম হওয়ার ট্রফি পেলে তিনি যেমনটা গর্বিত হতেন, আমি তাঁকে আমার কারণে তেমনই গর্বিত করতে চাইতাম। অথবা সেদিনের মতো, যেদিন কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষিকা বাবাকে বললেন যে আমি উর্দু ক্লাসে তাড়াতাড়ি ভাষাটা শেখার জন্য সহপাঠীদের উদ্দেশে ব্ল্যাকবোর্ডে ‘শুধু উর্দুতে কথা বলো’ লিখেছিলাম।
বড় বীরেরা ছোটবেলায় কী ভুল করতেন, তা বলে বলে বাবা আমাকে সান্ত্বনা দিতেন। তিনি বললেন, মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, ‘যদি ভুল করার স্বাধীনতা না থাকে, তাহলে স্বাধীনতার কোনো মূল্য নেই।’ স্কুলে আমরা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে নিয়ে কাহিনী পড়তাম। ছোটবেলায় করাচিতে তিনি রাস্তার আলোতে পড়তেন, কারণ বাড়িতে আলো ছিল না। তিনি অন্য ছেলেদের ধুলার মধ্যে মার্বেল খেলা বন্ধ করে ক্রিকেট খেলতে বলতেন, যাতে তাদের জামা আর হাত ময়লা না হয়। অফিসের বাইরে বাবা আব্রাহাম লিংকনের ছেলের শিক্ষকের কাছে লেখা লিংকনের চিঠির একটি কপি পশতুতে অনুবাদ করে বাঁধাই করে রেখেছিলেন। সুপরামর্শে ভর্তি চিঠিটা খুবই সুন্দর ছিল। সেখানে ছিল, ‘যদি আপনি পারেন তাহলে তাকে বইয়ের বিস্ময় শেখান... কিন্তু আকাশের পাখি, সূর্যের আলোয় উড়ে চলা মৌমাছি আর সবুজ পাহাড়পার্শ্বে ফুটে থাকা ফুলের চিরন্তন রহস্যের সন্ধান করার জন্য কিছুটা একান্ত সময় ওকে দেবেন। ওকে শেখাবেন, প্রতারণা বা অসৎপন্থা অবলম্বন করার চেয়ে হেরে যাওয়া অনেক বেশি সম্মানজনক।’
আমার ধারণা, সকলেই জীবনে একবার না একবার ভুল করে। সেটা থেকে কে কী শিখেছে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রতি করা অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিশোধ নিই, কিন্তু এর শেষ কোথায়? এ জন্যই পশতুনওয়ালি প্রথাটা নিয়ে আমার দ্বিমত আছে। একটি পরিবারের লোক যদি অন্য কারো দ্বারা আহত বা নিহত হয়, ‘নাং’ বা সম্মান পুনরুদ্ধার করার করার জন্য প্রতিশোধ বাধ্যতামূলক। আক্রমণকারীর পরিবারের কোনো পুরুষ সদস্যকে হত্যা করার মাধ্যমে প্রতিশোধ নেওয়া যায়। এর পর ওই পরিবার প্রতিশোধ নেবে। এভাবে চলতেই থাকবে। এখানে সময়ের কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। আমাদের একটা প্রবাদ আছে, ‘২০ বছর পর পশতুন লোকটি প্রতিশোধ নিল এবং আরেকজন বলল কাজটা খুব দ্রুত হয়ে গেছে।’
আমাদের অনেক প্রবাদবাক্য আছে। একটা হলো ‘পশতুন পাথর পানিতে ক্ষয়ে যায় না’, যার অর্থ আমরা ভুলেও যাই না আবার ক্ষমাও করি না। তাই আমরা খুব কমই ‘মানানা’ বা ধন্যবাদ বলি, কারণ আমরা বিশ্বাস করি, একজন পশতু কখনো কোনো ভালো কাজের কথা ভোলে না এবং খারাপ কাজের প্রতিশোধ নেওয়ার মতোই ভালো কাজের প্রতিদান দিতে সে বাধ্য থাকে। দয়া কেবল দয়া দিয়েই শোধ করা যায়, ‘ধন্যবাদ’-এর মতো মুখের কথা দিয়ে নয়।
(চলবে)