লবণসহিষ্ণু উচ্চ ফলনশীল সয়াবিনের দুটি জাত উদ্ভাবন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরকৃবি) বিজ্ঞানীরা সয়াবিনের লবণসহিষ্ণু উচ্চ ফলনশীল দুটি জাত উদ্ভাবন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক ‘বিইউ সয়াবিন-৩ ও বিইউ সয়াবিন-৪’ নামের এ দুটি জাত অতি সম্প্রতি উদ্ভাবন করা হয়।
উদ্ভাবিত এ সয়াবিনে তেল, ভিটামিন এ, বি, সি ও কে, এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে খনিজ পদার্থ থাকে। এতে যথেষ্ট পরিমাণ আইসোফ্ল্যাভিন্স থাকে—যা অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট হিসেবে ক্যান্সারের ঝুঁকি, উচ্চ রক্তচাপ ও এলডিএল কোলেস্টারল কমানোসহ হৃদরোগ, মহিলাদের ‘মেনোপ্যাসাল সিম্পটম’, বিষণ্ণতা বা অবসাদ, টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে শ্লথ করাসহ বহুবিধ রোগের প্রতিশেধক হিসেবে কাজ করে। এতে বিদ্যমান ভিটামিন কে হাঁড় সুরক্ষায় বিশেষ উপযোগী।
বশেমুরকৃবির ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মো. গিয়াসউদ্দীন মিয়া জানান, তাইওয়ানের এশিয়ান ভেজিটেবল রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (এভিআরডিসি/ওয়ার্ল্ড ভেজিটেবল সেন্টার), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এবং দেশের নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর এলাকা থেকে প্রায় দুশ জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করে ২০০৫ সাল থেকেই বিভিন্ন আঙ্গিকে সয়াবিনের উন্নয়নে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে বশেমুরকৃবির কৃষিতত্ত্ব বিভাগ। এ পর্যন্ত সয়াবিন উৎপাদনের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ছয়জন পিএইচডি ও ১৫ জন ছাত্র এমএস ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
জাত দুটি উদ্ভাবন গবেষণা দলের প্রধান প্রফেসর ড. আব্দুল করিম জানান, উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা যেহেতু সয়াবিন উৎপাদনে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা, সেহেতু লবণাক্ত সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করার জন্য বশেমুরকৃবি ও জাপানের কিওটো বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌথভাবে নিবিড় গবেষণা করা হয়। তারই ধারাবাহিক গবেষণায় দেখা গেছে, এভিআরডিসি (AVRDC) থেকে সংগৃহীত AGS313 ও G00028 জার্মপ্লাজম দুটি উচ্চফলনের পাশাপাশি লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা ও খরা সহিষ্ণু।
গবেষণা দলের প্রধান আরও জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে কৃষক পর্যায়ে এর সঠিকতা যাচাই করার জন্য নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও ভোলা জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ত জমিতে জাত দুটির মাঠপর্যায়ে কৃষকদের সম্পৃক্ত করে রবি ও খরিফ উভয় মৌসুমেই চাষ করা হয়। দীর্ঘমেয়াদি এ গবেষণায় আর্থিক সহযোগিতা করেছে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন (কেজিএফ), বশেমুরকৃবি, এবং কৃষকের মাঠ পর্যায়ে গষেণায় বিভিন্ন আঙ্গিকে সহযোগিতা করেছে সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক এশিয়া নামে একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের স্থানীয় কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্ট কৃষক ও গবেষকদের মতামতের ভিত্তিতে AGS313 ও G00028 জার্মপ্লাজম দুটি যথাক্রমে বিইউ সয়াবিন-৩ ও বিইউ সয়াবিন-৪ নামে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ অনুবিভাগে নিবন্ধন করা হয়। বিভিন্ন উপজেলায় জাত দুটির গড় ফলন পাওয়া গেছে ৩.২ মেট্রিক টন। লক্ষণীয়, বড় দানাবিশিষ্ট জাত দুটির উপযোগিতা যাচাইয়ের সময় দেশের বিদ্যমান অন্যান্য জাতগুলো ৫-৮ ডেসি/মি লবণাক্ততায় যেখানে হেক্টর প্রতি ২০০-৪০০ কেজি ফলন দিয়েছে, সেখানে এই জাত দুটির সমপরিমাণ লবণাক্ততায় গড় ফলন ছিল ৮০০-১১০০ কেজি। বিইউ সয়াবিন-৩ ও বিইউ সয়াবিন-৪ জাত দুটির যথাক্রমে ১০০০ বিজের ওজন ২২০ ও ২২৫ গ্রাম যা বাংলাদেশের বিদ্যমান যেকোনো জাতের চেয়ে বেশি, প্রোটিনের পরিমাণ ৪২ ও ৩৯%, তেল ১৯ ও ১৭%, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ১২.৬ ও ১১.৫ এবং ট্রিপসিন ইনহিবিটর ৩০.৩ ও ৪৩.৩৮ টিইউআই/ মিলিগ্রাম।
গবেষণা দলের প্রধান আরও জানান, বাংলাদেশে এখনও পশু ও মাছের খাদ্য হিসেবেই মুলত সয়াবিন ব্যবহৃত হয়। তবে ইদানীং বিভিন্ন স্ন্যাকস, সয়ামিট বল ও সয়ামিল্ক হিসেবে এর ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সয়াবিনকে ‘মিট অব দ্য ফিল্ড’ বা ‘মিট উইথ আউট বোন’ বলা হয়। কারণ সয়াবিনে প্রোটিন বা আমিষের পরিমাণ (৩০-৫৫%), যা অন্যান্য যেকোনো ফসল, যেমন ডাল, তেল কিংবা দানাদার শষ্যের তুলনায় অনেক বেশি।
তা ছাড়া সয়াবিনে ১৮-২০% তেল, ভিটামিন এ, বি, সি ও কে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে খনিজ পদার্থ থাকে। এতে যথেষ্ট পরিমাণ আইসোফ্ল্যাভিন্স থাকে—যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে ক্যান্সারের ঝুঁকি, উচ্চ রক্তচাপ ও এলডিএল কোলেস্টারল কমানোসহ হৃদরোগ, মহিলাদের ‘মেনোপ্যাসাল সিম্পটম’, বিষণ্ণতা বা অবসাদ, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে শ্লথ করাসহ বহুবিধ রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। এতে বিদ্যমান ভিটামিন কে হাঁড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় বিশেষ উপযোগী। কাজেই বাংলাদেশের মানুষের সার্বিক পুষ্টি সমস্যা সমাধানের জন্য সয়াবিনের ব্যবহার বৃদ্ধি একান্ত অবশ্যক।
এর আগে ২০১৪ সালে বশেমুরকৃবির কৃষিত্ত্ব বিভাগ থেকে বিইউ সয়াবিন-১ নামে খর্বাকৃতি ও অপেক্ষাকৃত কম সময়ে পরিপক্ব উচ্চ ফলনশীল এবং বিইউ সয়াবিন-২ নামে উচ্চ ফলনশীল, খরা ও জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে, যা কৃষক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।
উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ত এলাকায় সয়াবিনের উৎপাদন বৃদ্ধিতে নতুন জাত বিইউ সয়াবিন-৩ এবং বিইউ সয়াবিন-৪ বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।