শুরুতেই ছন্দপতন ‘ইন্ডিয়া’ জোটের?
আগামী বছর ভারতে লোকসভা নির্বাচন। তার আগে ২৮টি দল একমঞ্চে এসে গড়েছে ‘ইন্ডিয়া’ জোট। ১২টি দল নিয়ে এই মঞ্চ পথচলা শুরু করলেও ক্রমশ বাড়ছে সদস্য সংখ্যা। ইতোমধ্যে বৈঠক হয়েছে পাটনা, বেঙ্গালুরু ও মুম্বইয়ে।
‘ইন্ডিয়া’র লক্ষ্য কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন বিজেপি ও তাদের সহযোগীদের টেক্কা দেওয়া। যখন রাজ্যে রাজ্যে নির্বাচনি বোঝাপড়া নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়ার কথা, সেই সময়ই তাল কেটেছে!
এই সমঝোতা নিয়ে আলোচনার লক্ষ্যে ‘ইন্ডিয়া’ জোট তৈরি করেছে সমন্বয় কমিটি। এই কমিটির সদস্য তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। দেশের সবচেয়ে বড় বামপন্থী দল সিপিএম-কে এই কমিটিতে রাখা হয়েছে। কিন্তু তারা কোনো প্রতিনিধি পাঠাচ্ছে না।
কমিটিতে নেই সিপিএম
সিপিএমের পলিটব্যুরো বৈঠকে বসেছিল ১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বর। সমন্বয় কমিটিতে কে সিপিএমের প্রতিনিধি হবেন, সেই নাম ঠিক হবে বলে জল্পনা ছিল। কিন্তু বাম দলটি প্রতিনিধি পাঠানো দূরের কথা, সমন্বয় কমিটি গঠনের প্রয়োজন নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে।
পলিটব্যুরোর মতে, ‘ইন্ডিয়া’ কোনো জোট নয়, এটি রাজনৈতিক দলগুলোর ব্লক। এখানে সাংগঠনিক কাঠামোর প্রয়োজন নেই।
পলিটব্যুরোর সদস্য ও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, “আসন সমঝোতার বিষয়টি প্রত্যেক রাজ্যে ঠিক হওয়ার কথা। তাহলে কেন্দ্রীয় স্তরে কমিটি গড়ে কী লাভ? কে কটা আসন খালি রাখবে, কার পাদুকা রাখা হবে, সেই আলোচনার জন্য!”
অভিষেকের জন্য উষ্মা?
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘিরে সেলিমের এই ‘পাদুকা’ কটাক্ষ আগেই শোনা গিয়েছে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর সমন্বয় কমিটির বৈঠকে যোগ দিতে পারেননি তৃণমূলের শীর্ষ নেতা। সেদিন নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে ইডির তলবে তিনি হাজিরা দেন কলকাতার নিজাম প্যালেসে। জোটের বৈঠকে একটি আসন খালি রাখা হয় অভিষেকের জন্য। তারপরই সেলিম ‘পাদুকা রাখার’ কথা বলেছিলেন।
‘ইন্ডিয়া একটা মঞ্চ, এর কোনো সাব কমিটি থাকার দরকার নেই’
এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তা হলে অভিষেক আছেন বলেই কি সিপিএম দূরে থাকতে চাইছে? সিপিএমের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক কমিটি পলিটব্যুরোর সদস্য রামচন্দ্র ডোম ডয়চে ভেলেকে বলেন, “ইন্ডিয়া একটা মঞ্চ। এর কোনো সাব কমিটি থাকার দরকার নেই। আমরা এ ধরনের সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে ঢুকব না। তাই কমিটিতে আমাদের প্রতিনিধি থাকছেন না। সিদ্ধান্ত মঞ্চের নেতৃত্বই নিতে পারবেন।’
কংগ্রেসের দুই পথ
পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ সভাপতি অধীর চৌধুরী কেন্দ্রীয় কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তিনি এ রাজ্যে তৃণমূল বিরোধিতায় এখনো সরব। একই মত প্রদেশ কংগ্রেসের অন্যান্য নেতাদের। তৃণমূল বিরোধিতার প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গের বাম ও কংগ্রেস এক বিন্দুতে দাঁড়িয়ে রয়েছে ‘ইন্ডিয়া’ জোটে থাকা সত্ত্বেও।
প্রদেশ কংগ্রেস নেতা ও সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের বিরুদ্ধেই সিপিএম লড়বে, এই বার্তাটা ওই দলের নেতৃত্ব কর্মীদের দিতে চাইছেন। জোটের সব দলের নেতারা যখন বৈঠকে বসবেন, তখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হবে। সমন্বয়ে কমিটিতে হবে না। সিপিএম তো জোট থেকে বেরিয়ে আসেনি।”
অথচ প্রকাশ্যে সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধীর মতো কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুসম্পর্কই এখন দেখা যাচ্ছে। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের নিচুতলার নেতারা ধন্দে রয়েছেন।
সিপিএম প্রসঙ্গে অভিষেক বলেছেন, “বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সিপিএম কী করবে, সেটা তারাই বলতে পারবে। তৃণমূল কংগ্রেস ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে সঙ্গে নিয়ে বিজেপিকে সরাতে চায়।”
জোটের ভবিষ্যৎ
বিজেপি এই জোটকে বারবার কটাক্ষ করছে। সিপিএমের সমন্বয়ে কমিটিতে না থাকা সম্পর্কে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের মন্তব্য, “ক্ষমতার লোভে এই দলগুলো এক জায়গায় এসেছে। এদের মধ্যে কোন বোঝাপড়া হতে পারে না।”
সিপিএমের সিদ্ধান্তে কি গোড়াতেই ছন্দপতন হলো ইন্ডিয়া জোটে? প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র বলেন, “সিপিএম অনেক ছোট দল। পশ্চিমবঙ্গ ও কেরলের আঞ্চলিক বাধ্যবাধকতা ভেবেই তাদের এগোতে হবে। সেটাকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আগেই স্বীকার করেছেন। সে কারণেই বিজেপি বিরোধী মঞ্চে থাকলেও তৃণমূল ও কংগ্রেসের বিরোধিতা সিপিএমকে চালিয়ে যেতেই হবে।”
সম্প্রতি দেশজুড়ে যে ছটি আসনে উপনির্বাচন হয়েছে, তার পাঁচটিতেই কংগ্রেসের ভোট বেড়েছে। ফলে আড়াইশোর বেশি যে আসনে সরাসরি কংগ্রেস ও বিজেপি লড়াই হবে, সেখানে বিরোধী ভোট ভাগ না হলে গান্ধী ব্রিগেডের সুবিধা। একথা মনে করিয়ে শুভাশিস বলেন, “কংগ্রেস অনেক বড় দল। তাই রাজ্য নেতৃত্বের কথা শুনলেও তারা জাতীয় প্রেক্ষাপটকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। ভারসাম্য রেখে এগোচ্ছেন।”