কক্সবাজারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে মিয়ানমার প্রতিনিধিদল
প্রত্যাবাসন ইস্যুতে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে দ্বিতীয় দিন কক্সবাজারের টেকনাফে এসেছে মিয়ানমারের ইমিগ্রেশন বিভাগের প্রতিনিধিদল। আজ বুধবার (১ নভেম্বর) দুপুরে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
আজ সকাল সাড়ে ৮টায় নাফ নদ পাড়ি দিয়ে মিয়ানমারের ২৮ সদস্যের প্রতিনিধিদলটি টেকনাফ ট্রানজিট জেটিঘাটে পৌঁছায়। এ সময় তাদের স্বাগত জানানো হয়। এরপর তাদের সড়ক ও জনপথ বিভাগের সরকারি রেস্ট হাউসে আনা হয়। আজ বিকেলেই মিয়ানমারে ফিরে যাবে প্রতিনিধিদলটি।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার জানান, গতকাল মঙ্গলবার মিয়ানমারের ৩৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল টেকনাফ আসে। প্রতিনিধিদলটি দুটি ভাগে বিভক্ত হয়। একটি দল রোহিঙ্গাদের ৮০টি পরিবারের যাচাই-বাছাই কার্যক্রম করে এবং আরেকটি দল ১০০টি পরিবার প্রধানের সঙ্গে প্রত্যাবাসন বিষয়ে আলোচনা করে। পরে সন্ধ্যায় তারা কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত ছাড়া মিয়ানমারের ফিরে যায়।
জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের ৬০টি পরিবার যাচাই-বাছাই কার্যক্রমে কথা বলে তাদের সঙ্গে। এ সময় রোহিঙ্গারা তাদের নাগরিকত্ব, নিজেদের ভিটে-মাটিতে মর্যাদাপূর্ণ ও স্বাধীনভাবে চলাফেরাসহ জাতিগত স্বীকৃতি না দিলে মিয়ানমারে ফিরে যাবে না বলে জানিয়েছে।
সাংবাদিকদের সঙ্গে ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক মাইনুল কবির জানান, বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ও টেকসই প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করছে। সরকার সব সময় রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে গুরুত্বারোপ করে আসছে। রোহিঙ্গারা যাতে নিজ দেশে ফিরে গিয়ে নিজেদের জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারে সেই বিষয়ের গুরুত্ব দিয়ে আসছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, মিয়ানমার প্রতিনিধিদল ও রোহিঙ্গা দুই পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান হবে। প্রতিনিধিদল রাখাইন স্টেটে সেই দেশের সরকার কর্তৃক এর আগে প্রত্যাবাসনের জন্য যে সব কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে এবং মডেল ভিলেজ নির্মাণসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করেছে তার একটি ভিডিওচিত্র রোহিঙ্গাদের দেখিয়েছেন।
মোহাম্মদ মিজানুর রহমান আরও জানান, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনাকালে মিয়ানমার প্রতিনিধিদল রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব, নিজেদের ভিটে-মাটি ফিরিয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছে।
মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘জল ও স্থলপথে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হবে। যা ২০১৮ সালে দুই দেশের চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে। আমরা জল ও স্থলপথে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য প্রস্তুত রয়েছি। আমরা আশা করি, দুই পক্ষের কথাবার্তার মাধ্যমে তাদের মধ্যে যে আস্থার সংকট রয়েছে, সেটি দূর হবে এবং অচিরেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে, যার জন্য আমরা প্রস্তুত। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন অবশ্যই মর্যাদাপূর্ণ, টেকসই এবং স্বেচ্ছায় হবে। এ জন্য বাংলাদেশ সরকার সব সময় কাজ করে যাচ্ছে।’
তৃতীয় দফায় টেকনাফে এসে মিয়ানমার প্রতিনিধিদলটির নেতৃত্ব দেন রাখাইন প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী ও ইমিগ্রেশন প্রধান স নাইং। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমারবিষয়ক সেলের মহাপরিচালক মিয়া মো. মাইনুল কবির।
এ সময় শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান, অতিরিক্ত আরআরআরসি মো. সামছুদ্দৌজাসহ এপিবিএন পুলিশের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
২০১৭ সালে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের দ্বিপক্ষীয় প্রত্যাবাসন চুক্তির পর, ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর ও ২০১৯ সালের ২৩ আগস্ট দিনক্ষণ ঠিক হলেও তা ভেস্তে যায় মিয়ানমারের ছলচাতুরিতে। এরপর চলতি বছর চীনের মধ্যস্থতায় নতুন করে আলোচনায় আসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। তৃতীয় দফায় দেশটির প্রতিনিধিদল এলেও রোহিঙ্গাদের কাছে প্রশ্নের মুখেই রয়েছে মিয়ানমারের অবস্থান।
এর আগে চলতি বছর দু’বার মিয়ানমার প্রতিনিধিদল আসে টেকনাফে। গত ১৫ মার্চ প্রথম দফায় এবং গত ২৫ মে দ্বিতীয় দফায় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে মিয়ানমার প্রতিনিধিদল এসেছিল। এরই মধ্যে গত ৫ মে বাংলাদেশের সাত সদস্য এবং রোহিঙ্গাদের ২০ সদস্যের প্রতিনিধিদলও মিয়ানমারের মংডুর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েছিল।
২০১৮ সালে কয়েক দফায় আট লাখের বেশি রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারকে হস্তান্তর করে বাংলাদেশ। তারমধ্যে মাত্র এক লাখ এক হাজার রোহিঙ্গার তালিকা ভেরিফাই করে মিয়ানমার সরকার। এরমধ্যে মাত্র পাঁচ হাজার রোহিঙ্গাকে তারা প্রত্যাবাসনের জন্য ছাড়পত্র দেয়। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয়রত রয়েছে। কিন্তু গত ছয় বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি মিয়ানমার।