ঝুঁকি এড়াতে ভালো কোম্পানিতে বিনিয়োগের আহ্বান বিশ্লেষকদের
দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) উত্থানে পার করল গত সপ্তাহ। এ সময় শীর্ষ লেনদেনের তালিকায় অধিকাংশ ছিল দুর্বল কোম্পানির শেয়ার। এ ধরনের দুর্বল কোম্পানির শেয়ার শীর্ষে ওঠে আসা ভালভাবে নেননি পুঁজিবাজারের বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, গত সপ্তাহে পুঁজিবাজারে লেনদেন ও সূচক উত্থানে ওঠে এসেছে। বেড়েছে মূলধনও। এটা ভাল। তবে দুর্বল কোম্পানির ওপরে ভর করে ওঠে আসা স্বাভাবিক মেনে নেওয়া কষ্টকর বলে জানাচ্ছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, গত সপ্তাহে কোম্পানিগুলোর লেনদেনে গতি বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে পুঁজিবাজার মূলধন। সূচকও উত্থানে। এটা পুঁজিবাজারের জন্য গুড সাইন। চলতি বছর দুই সপ্তাহ পার করল। এর মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চন হয়। এর মধ্যেও কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর কমার চেয়ে বেড়েছে বেশি। যদিও দুর্বল কোম্পানির লেনদেনে দাপট বেশি ছিল এসময়।
আবু আহমেদ এনটিভি অনলাইনকে আরও বলেন, দুর্বল কোম্পানিতে বিনিয়োগে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বিগত সপ্তাহগুলোতে বেশি দেখা গেছে। এতে দিনদিন দুর্বল কোম্পানিতে বিনিয়োগ বাড়ছে। ফলে বিনিয়োগ ঝুঁকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি বিনিয়োগ নিরাপত্তার স্বার্থে ঝুঁকি এড়ানোর পরামর্শ দেন। একই সাথে ভাল কোম্পানিতে বিনিয়োগ আহবান জানান তিনি।
ঝুঁকি এড়াতে ভাল কোম্পানিতে বিনিয়োগ করার ওপরে জোর দিতে হবে জানিয়ে ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী এনটিভি অনলাইকে বলেন, বেশি লাভের আশায় অনেকেই দুর্বল কোম্পানির দিকে ঝুঁকছে। এতে শীর্ষে লেনদেনে দুর্বল কোম্পানি স্থান পাচ্ছে। শাকিল রিজভী আরও বলেন, মুনাফার লোভে যারা দুর্বল কোম্পানির দিকে যাচ্ছে, তাদের অনেকেই ক্ষতির মখোমুখি হচ্ছেন। এটা মাথায় রাখতে হবে। তাই বিনিয়োগ ঝুঁকি এড়াতে বুঝে শুনে, বিশ্লেষণ করে ভাল কোম্পানির বিনিয়োগে জোর বেশি দিতে হবে।
ডিএসইর ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, বিদায়ী সপ্তাহে (রোববার থেকে বৃহস্পতিবার) ডিএসই সব ধরনের সূচক উত্থানে লেনদেন শেষ হয়েছে। আগের সপ্তাহ থেকে আলোচিত সপ্তাহে লেনদেন পরিমাণ বেড়েছে ৩৭ দশমিক ৬০ শতাংশ। পুঁজিবাজারে মূলধন পরিমাণও বেড়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি। কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর কমার চেয়ে বেড়েছে ৪ দশমিক ৪৫ গুন বেশি। মোট লেনদেনের ২৭ শতাংশই ১০টি কোম্পানির দখলে।
গেল সপ্তাহে ‘বি’ ক্যাটাগরির ৬০ শতাংশ লেনদেন শীর্ষ ১০টি কোম্পানির দখলে রয়েছে। বাকি ৪০ শতাংশ ‘এ’ ক্যাটাগরির কোম্পানির শেয়ার অবস্থান করেছে। এদের মধ্যে ৯টির শেয়ার দর বাড়লেও কমেছে একটির শেয়ার দর। গেল সপ্তাহে মোট লেনদেনের ২৬ দশমিক ৯০ শতাংশ শেয়ার ১০টি কোম্পানির দখলে রয়েছে। এই ১০টি কোম্পানি লেনদেন করেছে ৫৯১ কোটি ২৩ লাখ টাকার শেয়ার। কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে ‘বি’ ক্যাটাগরির বিডি থাইয়ের শেয়ার। কোম্পানিটি একাই মোট শেয়ারের লেনদেন করেছে ৯০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা বা ৪ দশমিক ১২ শতাংশ। শেয়ার প্রতি দর বেড়েছে ১ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। এ ছাড়া সী পার্ল বিচের (‘এ’ ক্যাটাগরি) ৭০ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, ইন্ট্রাকোর (‘এ’ ক্যাটাগরি) ৬৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, রুপালী ব্যাংকের (‘বি’ ক্যাটাগরি) ৬৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা, মেঘলা লাইফের (‘এ’ ক্যাটাগরি) ৫৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা, ওরিয়ন ইনফিউশনের (‘এ’ ক্যাটাগরি) ৫৬ কোটি ২২ লাখ টাকা, খুলনা প্রিন্টিংয়ের (‘বি’ ক্যাটাগরি) ৪৮ কোটি ১৬ লাখ টাকা, মিডল্যান্ড ব্যাংকের (‘বি’ ক্যাটাগরি) ৪৬ কোটি ৩৬ লাখ টাকা, অলিম্পিক এক্সেসরিজের (‘বি’ ক্যাটাগরি) ৪৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা এবং দেশবন্ধু পলিমারের (‘বি’ ক্যাটাগরি) ৪৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে।
আগের সপ্তাহে (১ থেকে ৫ জানুয়ারি) ‘বি’ ক্যাটাগরির ৬০ শতাংশ কোম্পানির শেয়ার টপটেন লেনদেনে অবস্থান করেছিল। বাকি ৪০ শতাংশ ‘এ’ ক্যাটাগরির কোম্পানির শেয়ার শীর্ষে অবস্থান করেছিল। এদের মধ্যে ছয়টির শেয়ার দর বাড়লেও কমেছিল চারটির শেয়ার দর। ওই সপ্তাহে মোট লেনদেনের ২৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ শেয়ার ১০ কোম্পানির দখলে রয়েছিল। এই ১০টি কোম্পানি লেনদেন করেছে ৪৬২ কোটি ৯৪ লাখ টাকার শেয়ার। কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে ‘এ’ ক্যাটাগরির সী পার্ল বিচের শেয়ার। কোম্পানিটি একাই মোট শেয়ারের লেনদেন করেছিল ৭১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা বা ৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ। শেয়ার প্রতি দর বেড়েছে ৩ দশমিক ৩১ শতাংশ।
এছাড়া বিডি থাইয়ের (‘বি’ ক্যাটাগরি) ৬৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা, অলিম্পিক এক্সেসরিজের (‘বি’ ক্যাটাগরি) ৫২ কোটি ২৯ লাখ টাকা, ওরিয়ন ইনফিউশনের (‘এ’ ক্যাটাগরি) ৪৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা, খুলনা প্রিন্টিংয়ের (‘বি’ ক্যাটাগরি) ৪৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, ইন্ট্রাকোর (‘এ’ ক্যাটাগরি) ৪৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, সেন্ট্রাল ফার্মার (‘বি’ ক্যাটাগরি) ৩৭ কোটি ৩ লাখ টাকা, স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্সের (‘এ’ ক্যাটাগরি) ৩৪ কোটি ২৪ লাখ টাকা, খান ব্রাদার্সের (‘বি’ ক্যাটাগরি) ৩২ কোটি ৫১ লাখ টাকা এবং এমারেল্ড অয়েলের (‘বি’ ক্যাটাগরি) ৩০ কোটি ৯২ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছিল।
গত ১০ অক্টোবর পুঁজিবাজারে সরকারি বন্ডের লেনদেন শুরু হয়। এরপর ডিএসইতে ২৫০ বন্ডের লেনদেন হয়। এতে ডিএসইর শেয়ারবাজার মূলধন ২ লাখ ৫২ হাজার ২৬৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা বেড়ে ৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯৩৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছিল। এরপর গত ২৭ অক্টোবর শেয়ারবাজার মূলধন কমে দাঁড়িয়েছিল ৭ লাখ ৬৯ হাজার ৪৬৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা। গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার শেয়ারবাজার মূলধন দাঁড়ায় ৭ লাখ ৮৬ হাজার ১৯৮ কোটি ৭২ লাখ টাকায়। এর আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার শেয়ারবাজার মূলধন দাঁড়িয়েছিল ৭ লাখ ৮১ হাজার ৭৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকায়। এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজার মূলধন বেড়েছে পাঁচ হাজার ১১৯ কোটি ছয় লাখ টাকা বা দশমিক ৬৬ শতাংশ। আগের সপ্তাহে বাজার মূলধন বেড়েছে ২০৩ কোটি টাকা।
গেল সপ্তাহে ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে দুই হাজার ১৯৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে লেনদেন হয়েছিল এক হাজার ৫৯৭ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এই সময়ের ব্যবধানে লেনদেন বেড়েছে ৩৭ দশমিক ৬০ শতাংশ। ডিএসইতে প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয়েছে ৫৪৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে গড়ে লেনদেন হয়েছিল ৩৯৯ কোটি ৩১ লাখ টাকা। গেল সপ্তাহে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত ৪০৬টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়। এর মধ্যে শেয়ার দর বেড়েছে ১৪৭টির, দর কমেছে ৩৩টির ও অপরিবর্তিত রয়েছে ২০০টি কোম্পানির। লেনদেন হয়নি ২৬টি কোম্পানির শেয়ার।
সপ্তাহে সব ধরনের সূচক উত্থানে লেনদেন শেষ হয়। এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫৭ দশমিক ৫৩ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ৩০১ দশমিক ৭০ পয়েন্টে। শরিয়াহ সূচক ডিএসইএস দশমিক ৯৬ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৩৭৫ দশমিক ৯২ পয়েন্টে। এ ছাড়া ডিএসই৩০ সূচক ২৩ দশমিক ৬৫ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ১১৭ দশমিক ৯১ পয়েন্টে।
এদিকে গেল সপ্তাহের শেষে (বৃহস্পতিবার) ডিএসইর পিই রেশিও অবস্থান করে ১৩ দশমিক ২৩ পয়েন্টে। আগের সপ্তাহের শেষে (বৃহস্পতিবার) পিই রেশিও দাঁড়িয়েছিল ১৩ দশমিক ১২ পয়েন্টে। পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজারে কোনো কোম্পানির মূল্য আয় অনুপাত (পিই রেশিও) ১৫ পয়েন্ট ছাড়ালেই তা বিনিয়োগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। অন্যদিকে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি) মার্জিন ঋণের যোগ্যতা হিসেবে সর্বোচ্চ ৪০ পিই রেশিও বেঁধে দিয়েছে। এ হিসেবে ৪০ পর্যন্ত পিইধারীর শেয়ার বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ বলে জানায় বিএসইসি। সেই হিসেবে গত বৃহস্পতিবারের ডিএসইর পিই রেশিও হিসাবে বিনিয়োগ নিরাপদ অবস্থানে রয়েছে।