‘বড় বাপের পোলায় খায়’ বনাম ‘সব বাপের পোলায় খায়’
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের সঙ্গে ভোজনরসিক শব্দের ঘনিষ্ঠতাও পুরোনো। বাহারি সব পদের ইফতার সামগ্রী ভরে উঠেছে এলাকা। রমজানের শুরুতেই জমজমাট সেখানের ইফতার বাজার। প্রকাশ্য লড়াইয়ে যেন ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ ও ‘সব বাপের পোলায় খায়’। কে কাকে টেক্কা দেবে তা নিয়ে রীতিমত শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা। তাদের স্লোগানে ইফতার বাজার সরগরম। পুরান ঢাকার চকবাজার, ইসলামপুর, বাংলাবাজারসহ রাস্তার পাশের টং দোকানগুলোতে ঘুরে ব্যাপক আয়োজন দেখা গেছে।
ঢাকার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ইফতারের মার্কেট চকবাজারে সরেজমিনে দেখা যায়, বিভিন্ন রকম ইফতারের জমকালো পরিবেশনা। সাধারণ ছোলা-মুড়ি, পেঁয়াজু, বেগুনি, চপ, শরবতের পাশাপাশি দেখা গেছে ইফতারের নানারকম আইটেম। এছাড়া ইসলামপুর ও বাংলাবাজারেও দেখা গেছে বিভিন্ন রকমের ইফতারের আয়োজন।
বিভিন্ন ধরনের কাবাব রয়েছে। টেংরি কাবাব, সুতি কাবাব, শিক কাবাব, কাঠি কাবাবের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। এ ছাড়া রয়েছে আস্ত মুরগির রোস্ট, কোয়েলের রোস্ট, খাসির আস্ত পা রোস্ট, গরুর হালিম।শুদু মাংসই নয় রয়েছে সবজি নান, দুধ নান, পরোটা, কিমা পরোটা, গরুর মাংসের বিরিয়ানিও। ক্রেতাদের আকর্ষণ করতে তারা নানা রকম বিজ্ঞাপনী কথাবার্তাও বলে চলেছেন।
ভারী খাবারের পাশাপাশি রয়েছে নানারকম পানীয়। ইফতারির শুরুর আইটেম হিসেবে থাকছে ডেজার্ট, ঘোল, মোহব্বতের শরবত, লাচ্ছি, ডাব, বিভিন্ন ফলের রসসহ।
ঘোল লিটারপ্রতি ১০০ টাকা, ডেজার্ড ২০০, মোহব্বতের শরবত ১০০ থেকে ১২০ টাকা, লাচ্ছি ২২০ থেকে ২৫০ টাকা লিটার পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া আকার ভেদে প্রতিটি ডাব বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা করে।
মুখরোচক ইফতারের বিভিন্ন পদ যেমন গ্রিল ৮০ থেকে ১০০ টাকা, দুধ নান ৬০ থেকে ১০০ টাকা, সবজি নান ৮০ থেকে ৯০, পরোটা ৩০, কিমা পরোটা ৫০ থেকে ৬০, গরুর মাংসের বিরিয়ানি ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা, আস্ত মুরগির রোস্ট ৩৫০ থেকে ৪৫০, গরুর হালিম ২০০ থেকে শুরু করে ৮০০ টাকা, কোয়েল রোস্ট ১০০ টাকা, খাসির আস্ত পা রোস্ট ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বিক্রেতা ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘আমরা দুপুরের পর থেকে ইফতারের আগ পর্যন্ত বেচাকেনা করি। বেচাকেনা আল্লাহর রহমতে ভালোই চলছে।’
এ ছাড়া কাবাবের আইটেমে দেখা গেছে ভিন্নতা। টেংরি কাবাব ৮০ টাকা, শিক কাবাব ১২০ টাকা, কাঠি কাবাব ৭০ টাকা এবং সুতি কাবাব এক হাজার ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
কাবাব বিক্রেতা মোক্তার আলী বলেন, ‘এই রমজান মাসেই আমাদের বিক্রি সবচেয়ে বেশি হয়। গতবারের তুলনায় দাম বাড়লেও ক্রেতার সংখ্যা কমেনি। ক্রেতাদের ভালো সাড়া পাচ্ছি।’
এখানকার ইফতার বাজারের খ্যাতি রাজধানী জুড়ে। এজন্য শুধু স্থানীয়রাই নয়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ইফতার কিনতে আসে লোকজন। গাজীপুর থেকে আসা ক্রেতা সেলিম হায়দার বলে, ‘আমি প্রতি বছরই রমজানে চকবাজার থেকে ইফতারি কিনতে আসি। এবারও এসেছি। তবে এবারের বাজারে দামের ঊর্ধ্বগতির ছোঁয়া লেগেছে। সব কিছুরই দাম বাড়তি।’
পুরান ঢাকার ইফতার বাজারের সবচেয়ে চেনা সংলাপ, ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙা ভইরা লইয়া যায়।’ চকবাজারের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো এটি। প্রায় ১৫ রকম আইটেমের সঙ্গে আরও ১৫ রকম মশলা যোগ করে বানানো হয় এ খাবার। এতে দেওয়া হয় মুরগির মাংস, মাংসের কিমা, সুতি কাবাব, ডাবলি, গরুর মগজ, বুটের ডাল, ডিম, আলু, ঘি, বাদাম, কাঁচা ও শুকনো মরিচসহ নানারকম মসলা। মান ও দোকানভেদে এটি ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে বাজারে ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ কে টেক্কা দিতে চলে এসেছে ‘সব বাপের পোলায় খায়’ ইফতারটি। বিক্রেতারা বলে চলেছেন, ‘এই যে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার, চকবাজারের সেরা। সব বাপের পোলায় খায়, ঠোঙা ভইরা লইয়া যায়।’
তাদের দাবি তাদের এই খাবার ৭৮ বছরের ঐতিহ্যবাহী। ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ ইফতারের আইটেমের মতোই প্রায় একই উপাদান দিয়ে বানানো এ ইফতারের আইটেম যে কেউ তার সামর্থ্য অনুযায়ী কিনতে পারেন।
এ ছাড়া সাধারণ পেঁয়াজু, বেগুনি ও চপ প্রতি পিস পাঁচ টাকা থেকে শুরু করে ২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
ইফতারের ডেজার্ট আইটেম হিসেবে থাকছে রসমালাই, দই, চমচম, রসগোল্লা, দুধসর, পানতুয়া, ঘিয়ে ভাজা জিলাপি এবং মেগা জিলাপি। রসমালাই ও দই কেজি প্রতি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, রসগোল্লা ৩০০ টাকা, দুধসর ও পানতুয়া যথাক্রমে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, ঘিয়ে ভাজা জিলাপি ২৫০ টাকা কেজি এবং মেগা জিলাপি ৩৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
এ ছাড়া ইফতারের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ফলের দোকান। স্ট্রবেরি, আনারস, কমলা, আঙুর, বেদানা, মাল্টা, তরমুজ, নাশপাতি, আপেল, নাশফল, লেবু, শসা, বাঙ্গি, বেল, পেয়ারাসহ বিক্রি হচ্ছে নানারকম ফলমূল। আনারস সাইজ ভেদে ৫০ থেকে ১০০ টাকা, কমলা ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, আঙুর ৩০০ থেকে ৩২০, মাল্টা ৩০০ থেকে ৩৫০, বেদানার ৪০০ থেকে ৪৫০, আপেল ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, নাশপাতি ও নাশফল ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, শসা ৮০ টাকা, পেয়ারা ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে এবং লেবু মান ভেদে ৪০ থেকে ১২০ টাকা হালি ও প্রতিটি বেল ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতিটি তরমুজ আকার ভেদে বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত।
ফল বিক্রেতা সালাম হোসেন বলেন, ‘গত বছরে তুলনায় এই রমজানে সব ফলেই প্রায় ২০-৩০ টাকা কেজি প্রতি বেড়েছে। কী করব, আমাদেরও তো লাভ করতে হবে। তাই এই বেশি দামেই বিক্রি করছি।’
খেজুরের দোকানে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ৩০ থেকে ৪০ রকমের খেজুর সাজিয়ে নিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। সৌদি আরবের আজওয়া, মাবরুম, মাশরুক, আম্বর, সাফওয়ি, কালমি, মরিয়ম, আরব আমিরাতের বরই, নাগাল ও দাব্বাস খেজুরসহ ইরাকের জাহেদি খেজুর রয়েছে প্রতিটি দোকানে। মানভেদে কেজি প্রতি ৪০০ থেকে ৩৫০০ টাকা পর্যন্ত দাম হাঁকছেন বিক্রেতারা।
তবে গত বছরের তুলনায় এবছর খেজুরের দাম প্রায় দ্বিগুণ বাড়ায় ক্রেতাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে অসন্তোষ। পুরান ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা মোহাম্মদ হামিদ বলেন, ‘গত বছর যে খেজুর ২০০ টাকা করে কেজি কিনেছি এবার সেই একই খেজুর কিনতে হচ্ছে ৪৫০ টাকা কেজি দামে। ইনকাম তো বাড়েনি। তাই বাধ্য হয়ে আমাদের কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিতে হচ্ছে অথবা কম দামি খেজুর কিনতে হচ্ছে।’
তবে সব কিছুর দাম বাড়লেও প্রতিটা বাজারেই লক্ষ্য করা গেছে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়। পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন নিয়ে অনেকেই এসেছেন ইফতারির বাজার করতে। এছাড়া অনেকেই এসেছেন ইফতারি বাজার ঘুরে দেখতে।
চকবাজার থানার সহকারী পুলিশ কমিশনার জায়েন উদ্দিন মোহাম্মদ যিয়াদ তার টিম নিয়ে বাজার তদারকি করতে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘ক্রেতারা দ্রব্য কিনতে ভোগান্তির মুখে পড়ছে কি না সেটা দেখতে এসেছি। এ ছাড়া ফুটপাত দখল করে বসা টং দোকানগুলোকে আমরা সরিয়ে দিচ্ছি, যাতে করে যাতায়াতের কোনো অসুবিধা না হয়।’