আর সত্যি কথা বলবেন না সেই এমপি আবুল কালাম আজাদ
নাটোর-১ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আবুল কালাম আজাদ নির্বাচনে খরচ করা এক কোটি ২৬ লাখ টাকা তোলার ঘোষণা দিয়ে এখন তোপের মুখে৷ সংবিধান ও আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে তার শাস্তি দাবি করছেন অনেকে৷ এ প্রসঙ্গে সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমি যে কথা বলেছি, তা সত্য এবং সরল বিশ্বাসে বলেছি৷ তবে এখন মনে হচ্ছে, সব সত্য কথা এভাবে বলতে নেই৷ ভবিষ্যতে এভাবে সত্য কথা বলবে না৷’
আবুল কালাম আজাদ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এবং দলের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হয়েছেন৷ ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন৷
নাটোরের লালপুর উপজেলায় ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংসদ সদস্য আবুল কালম আজাদ বলেন, ‘নির্বাচনে এক কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে৷ এটা আমি তুলব, যেভাবেই হোক৷ এটুক অন্যায় আমি করবই৷ তারপর আর করব না৷’ তিনি আরও বলেন, ‘২৫ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা দিয়েছি৷ ট্যাক্স-ফ্রি গাড়ি কিনেছি ২৭ লাখ টাকা দিয়ে৷ ইচ্ছা করলে আমি এক কোটি টাকা দিয়ে গাড়ি কিনতে পারতাম৷ কিন্তু আমার যেহেতু টাকা নেই, আমি ২৭ লাখ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম৷ এবার আমি কিনবে, ওই টাকা দিয়ে কিনব৷ ওই টাকা আমি তুলে নেব৷ নিয়ে আর কিছু করব না৷ খালি এই এক কোটি ২৬ লাখ টাকা তুলব৷’
সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ শুক্রবার (২৯ মার্চ) বলেন, ‘আমি একজন আইনজীবী৷ এ ছাড়া আমার আয়ের আর কোনো উৎস নেই৷ অনেক লোককে সহায়তা করতে হয়৷ করোনার সময় অনেককে সহায়তা করেছি৷ এখন আবার পাঁচ বছর করতে হবে৷ আমি কোথায় টাকা পাব? এক প্রকল্পের টাকা আরেক প্রকল্পে নেব৷ এক প্রকল্প থেকে টাকা বাঁচিয়ে সেই টাকা দিয়ে মানুষকে সহায়তা করব৷ এগুলোও দুর্নীতি, অনিয়ম৷ কিন্তু এ ছাড়া তো আর উপায় নাই৷’
আবুল কালাম আজাদ আরও বলেন, ‘সংসদ সদস্য হিসেবে আমার পাঁচ বছরের বেতন-ভাতা এক কোটি ২৬ লাখ টাকা৷ সেই টাকা তো নির্বাচনে খরচ করে ফেলেছি৷ তাই আমি সেই টাকা তোলার কথা বলেছি৷ আর এটা সত্য যে, নির্বাচনে ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ের সীমা থাকলেও আমার এক কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে৷ সেটা তো আমি বলতে পারব না৷ তবে আমি ওই কথা বলেছি, মানুষকে বাস্তব পরিস্থিতি বোঝানোর জন্য৷ এটা ছিল কথার কথা৷ আমি শেষে বলেছি, আমি দুর্নীতি করব না৷’
নাটোর-১ আসনের এই সংসদ সদস্য বলেন, ‘২০১৪ সালে আমি বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছি৷ আমি ছাড়া আর কোনো প্রার্থী ছিল না৷ তখন আমার নির্বাচনে কোনো টাকা খরচ হয়নি৷ এবার তো হয়েছে৷’ ওই ধরনের কথা আইন ও সংবিধানের লঙ্ঘন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে সব সত্য কথা এভাবে প্রকাশ্যে বলতে নেই৷ এটা আমি বুঝতে পেরেছি৷ বুঝতে পেরেছি, কিছু কথা গোপন রাখতে হয়৷ ভবিষ্যতে এভাবে সত্য কথা আর বলবে না৷’
ওই আসনের সদস্য সাবেক সংসদ সদস্য মো. শহীদুল ইসলাম বকুল এবার নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে হেরে যান৷ তিনিও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি৷ তিনি বলেন, ‘এমপি সাহেব যা বলেছেন, তাতে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত৷ আমি নিজেও আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলেছি৷ দেখি তার বিরুদ্ধে মামলা করা যায় কিনা৷’
শহীদুল ইসলাম বকুল আরও বলেন, ‘আবুল কালাম সাহেব এরকম কথা আগেও বলেছেন৷ ২০১৪ সালে বিনা ভোটে এমপি হয়ে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর লালপুরের প্রধানমন্ত্রী আমি৷ এরপর তিনি দল থেকে আর মনোনয়ন পাননি৷’ তিনি বলেন, ‘একজন আইন প্রণেতা হয়ে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে তিনি যা বলেছেন, তা আমাদের স্বাধীনতার চেতনা ও সংবিধানের লঙ্ঘন৷ আশা করি, দল তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে৷’
রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য
বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ‘আসলে দেশে যে আইনের শাসন নেই, সেটা ওই এমপি সাহেবের বক্তব্যের পর আবারও প্রমাণিত হলো৷ কারণ, তিনি সংবিধানের অধীনে শপথ নেওয়ার পর দুর্নীতি করার কথা বলেছেন, এটা সংবিধান লঙ্ঘন ছাড়াও ফৌজদারি অপরাধ৷ তিনি একজন আত্মস্বীকৃত অপরাধী৷ কিন্তু এখনও তার বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি৷ যেখানে তিনি ওই কথা বলেছেন, সেই অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেছেন ইউএনও৷ তিনিও কোনো আইনগত উদ্যোগ নেননি৷ দেশে এখন আইনের শাসন নাই৷ আওয়ামী লীগ যা করবে, তাই আইন৷ ওই এমপি সাহেব স্বতন্ত্র হলেও তিনি আওয়ামী লীগেরই লোক৷’
কায়সার কামাল বলেন, ‘এরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়৷ তাই এদের কোনো জবাবদিহিতা নেই৷ এরা দুর্নীতি করে৷ এবার প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে দুর্নীতি শুরু করেছে৷’
আর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হেসেন এমপি বলেন, ‘এমপি সাহেব ওই কথা যদি বলে থাকেন, তাহলে তা দুঃখজনক৷ তারপরও তিনি কী ব্যাখ্যা দেন তা দেখার আছে৷’ তিনি বলেন, ‘এখন নির্বাচন কমিশন দেখতে পারে, তার ওই কথার ওপর ভিত্তি করে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় কিনা৷ আর দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নিতে পারে দলের কেন্দ্রীয় কমিটি৷ হয়ত পরবর্তী সভায় বিষয়টি নিয়ে আলাপ হবে৷’
এক প্রশ্নের জবাবে এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী চান দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ৷ তারপরেও সব পর্যায়ে দুর্নীতি আছে৷ সেটা রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক সবখানেই৷’
আইন ও সংবিধান কী বলে?
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘ওই এমপি যেহেতু নিজেই স্বীকার করেছেন, তিনি ২৫ লাখ টাকার বেশি নির্বাচনে খরচ করেছেন৷ আর হিসাব দিচ্ছেন ২৫ লাখ টাকার৷ এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা নিতে পারেন৷ আর দুর্নীতি করার ঘোষণা দিয়ে তিনি দেশের প্রচলিত আইনেই অপরাধ করেছেন৷ এটা স্পিকার বা অন্য কোনো সংস্থা দেখতে পারে৷’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক বলেন, ‘তিনি (এমপি আবুল কালাম) সংবিধান ও আইনের লঙ্ঘন তো করেছেনই, একই সঙ্গে আমাদের রাজনীতির দেউলিয়াত্ব তার কথায় প্রকাশ হয়েছে৷’
ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক বলেন, ‘সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ মতে, ওই এমপির বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনের অভিযোগে ব্যবস্থা নিতে পারেন স্পিকার৷ তিনি বিষয়টি সংসদেও তুলতে পারেন অভিসংশনের জন্য৷ আর নির্বাচন কমিশন ২৫ লাখ টাকার বেশি খরচ করার কথা তিনি যেহেতু স্বীকার করছেন, তাই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে৷ দলের পক্ষ থেকেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
আর সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যেভাবেই হোক ওই এমপি সাহেব মুখ ফসকে সত্য কথা বলে ফেলেছেন৷ বাস্তব অবস্থা এর চেয়েও খারাপ৷’
রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘উনি (এমপি আবুল কালাম) যেহেতু নির্বাচনে নির্ধারিত সীমার বেশি খরচ করেছেন এবং সেই টাকা আবার দুর্নীতির মাধ্যমে তোলার কথা কলেছেন এটা নৈতক স্খলন৷ এটার জন্য তিনি দণ্ডিত হতে পারেন৷ যেহেতু তিনি শপথ নিয়েছেন তাই সংসদকে উদ্যেগ নিতে হবে৷ স্পিকার যদি নির্বাচন কমিশনে বিষয়টি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পাঠান, তাহলে নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা নিতে বাধ্য৷’