‘মানুষের প্রতিবাদে সরকারের ভয় কোথায়?’
“প্রশ্ন হলো, ‘উন্নয়ন’ যদি সত্যিকারের উন্নয়নই হয় তাহলে তা নিয়ে মানুষের কথা শুনতে অসুবিধা কী? মানুষের প্রতিবাদে সরকারের ভয় কোথায়? খবর প্রকাশে এত বাধা কেন? খোলাখুলি কথা বলতে অসুবিধা কী?”
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে ত্রিমুখী সংঘর্ষে চারজন গ্রামবাসী নিহত হওয়ার ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে এমন প্রশ্নই রেখেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর ও খনিজ সম্পদ রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
গতকাল সোমবার বাঁশখালীর গণ্ডামারা এলাকায় এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে গ্রামবাসীর সঙ্গে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে চারজন নিহত ও বহু মানুষ আহত হন।
এই খবর প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ঘটনার সমালোচনা করে পোস্ট দিচ্ছেন সাধারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা। যার যার জায়গা থেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও দেখাচ্ছেন তাঁরা।
এঁদের একজন গায়ক ও কবি কফিল আহমেদ। নিজের প্রোফাইলে তিনি লিখেছেন, ‘এমনকি মানুষের শ্বাস-নিশ্বাসের জন্য যে অন্তত সামান্য বাতাস দরকার ... তা পর্যন্ত গভর্নমেন্ট অনুভব করছে না! তাহলে এই ছোট্ট দেশে কয়লাতাপ প্রকল্পের মতো বাতাস গরম করার এমন উদ্যোগ নেওয়ার কথা না! আর দেশে এমন প্রাণঘাতী প্রকল্প যারা নিতে পারে তাদের পক্ষে গুলি করে মানুষকে হত্যা করা মোটেও আশ্চর্য কিছু না!’
এ সম্পর্কে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের পুরো পোস্টটি হলো – “চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চীনা কোম্পানির সাথে এস আলম গ্রুপের জমি দখল ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে অনেকদিন থেকেই প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন এলাকাবাসী। তারই একপর্যায়ে আজ প্রতিবাদী এলাকাবাসীর মিছিলের ওপর পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের হামলা এবং গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এতে কমপক্ষে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। আশঙ্কা, এই সংখ্যা আরো বাড়বে, গুলিবিদ্ধ অনেকে। প্রশ্ন হলো, ‘উন্নয়ন’ যদি সত্যিকারের উন্নয়নই হয় তাহলে তা নিয়ে মানুষের কথা শুনতে অসুবিধা কী? মানুষের প্রতিবাদে সরকারের ভয় কোথায়? খবর প্রকাশে এত বাধা কেন? খোলাখুলি কথা বলতে অসুবিধা কী? না, কেউ কথা বলতে পারবে না, কোনো সভা-সমাবেশ করা চলবে না। সন্ত্রাসী আর পুলিশসহ রাষ্ট্রীয় বাহিনী লাগানো হবে জনগণের বিরুদ্ধে। কারণ কর্তারা ঠিকই জানে এগুলো উন্নয়নের মুখোশ পরানো ধ্বংস, দখল আর লুণ্ঠনের প্রকল্প। একই চেহারা আমরা দেখেছি ফুলবাড়ীতে; দেখছি রামপাল, রূপপুর,
মাতারবাড়ীতেও। ঘুষ দিয়ে বা ধমক দিয়ে মিডিয়া থেকে গায়েব করা হয় জনগণের প্রতিবাদ, যুক্তি, তথ্য। বাঁশখালীতে বেশ কিছুদিন ধরে প্রতিবাদ চললেও এতদিন তাই কোনো খবরই আসেনি সংবাদপত্রে, টিভিতে। জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে আমরা এসব হিংস্র দমনপীড়নের তীব্র প্রতিবাদ জানাই এবং নিরস্ত্র মানুষ হত্যার জন্য কোম্পানি ও সরকারি ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করি। সরকারের কাছে আমাদের আরো দাবি, জোরজবরদস্তি, প্রতারণা, ভয়ভীতি, দুর্নীতির ওপর ভর করে ‘উন্নয়ন’ নামের দখল, লুণ্ঠন ও ধ্বংসের তৎপরতা বন্ধ করুন। যথাযথ স্বচ্ছতা, জনসম্মতি এবং জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিত না হলে জনগণ কোনো প্রকল্পই গ্রহণ করবে না। ভয়ভীতি দেখিয়ে, ত্রাস সৃষ্টি করে কতদিন আর মানুষকে চুপ রাখতে পারবেন?”
প্রকৌশলী কল্লোল মোস্তফা লিখেছেন, ‘জোর করে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে গিয়ে বাঁশখালীতে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছে এস আলম গ্রুপের মাস্তান ও পুলিশ। বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন অসংখ্য। দেশি এস আলম ও চায়নিজ কোম্পানির স্বার্থ রক্ষার জন্য বাঁশখালীতে মানুষ হত্যার তীব্র নিন্দা জানাই।’
ব্যারিস্টার জ্যাতির্ময় বড়ুয়া লিখেছেন, ‘সারা দেশে সবাই দাঁড়ান। বাঁশখালীতে যা ঘটেছে তা আপনার এলাকাতেও ঘটছে। প্রতিবাদ আজ লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে, সকল হত্যার বিরুদ্ধে, অপশাসনের বিরুদ্ধে। অধিকার বুঝে নিন- এই রাষ্ট্র আমাদের।’
সাবেক ছাত্রনেতা বাকী বিল্লাহ লিখেছেন, ‘গুলি ছাড়া দেশের মানুষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলার আর সব ভাষা ভুলে গেছে রাষ্ট্র। মানুষের জীবন, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনো তোয়াক্কা করছে না তারা- কেবল চোর, খুনি ও লুটপাটকারীদের রক্ষা করাই তার একান্ত কর্তব্য। সমস্ত দেশের মানুষ যখন হত্যা-ধর্ষণের বিচার চাইছে তখন নৃশংস-নির্বিচার গুলি চালিয়ে বাঁশখালীতে চারজন মানুষকে হত্যা করা হলো।
কী ভয়াবহ উন্নয়ন!’
গীতিকার মনিরুল ইসলাম রানা লিখেছেন, ‘কয়লা চাই, বিদ্যুৎ চাই, উন্নয়ন চাই, প্রকল্প চাই, ভিনদেশি বিনিয়োগ চাই, অভ্যন্তরীণ দালাল চাই; শুধু মানুষ চাই না।
আসুন সকল উন্নয়নকে হ্যাঁ বলি আর তার বলি হতে থাকা মানুষগুলোকে না বলি।’
স্ট্যাটাস পোস্ট করা ছাড়াও এই ঘটনার প্রতিবাদে বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত বিক্ষোভ কর্মসূচিতে যোগদানের আহ্বান জানিয়ে বিভিন্ন ইভেন্টও খোলা হচ্ছে।