১৫ বছরে বিদ্যুতে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা
আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছরে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র ও ভাড়াভিত্তিক (রেন্টাল- কুইক রেন্টাল) বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ এক লাখ ছয় হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, ২০০৮-০৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর ১৫ বছরের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে এক লাখ ছয় হাজার ৭৮৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত ১০ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৪৩ হাজার ৩৩৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। অথচ ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে ৬৩ হাজার ৪৫২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে যত সমালোচনা
বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অলস বসিয়ে রাখলে চুক্তি অনুযায়ী তাদের যে পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হয়, সেটারই আনুষ্ঠানিক নাম ক্যাপাসিটি চার্জ। বিদ্যুৎ খাতের বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে শুরু থেকে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা সমালোচনামুখর ছিলেন। এ পদ্ধতিকে ‘রাষ্ট্রের অর্থ লুটপাট’র সুযোগ হিসেবে উল্লেখ করে তীব্র সমালোচনা করেন তারা।
এটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয় যখন সরকারের একটি প্রতিষ্ঠানের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার তৈরি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জকে একটি ‘লুটেরা মডেল’ হিসেবে চিহ্নিত করা হেয়েছে।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে পিডিবিকে লোকসান গুণতে হয় প্রায় এক লাখ ১৬ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা। এর আগের ১২ বছরে সংস্থাটি লোকসান গুণেছে এক লাখ ৫ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১২ বছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকার মোট যা লোকসান করেছে, তার চেয়ে বেশি লোকসান হয়েছে গত দুই অর্থবছরে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট সক্ষমতার মাত্র ৫৬ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। এর কারণ, জ্বালানি ও কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ অনেক বেশি। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে অতিরিক্ত মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে গ্রাহকদের সরবরাহ করতে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিতে হয়।
বিদ্যুৎ খাতের ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে জাতীয় সংসদে গত বৃহস্পতিবার (৯ মে) জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা জি এম কাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সরকারের সমালোচনা করে জি এম কাদের বলেন, উৎপাদন ছাড়াই বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হচ্ছে।
কুইক রেন্টাল সংক্রান্ত আইন নিয়ে প্রশ্ন তুলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা ১৭ হাজার মেগাওয়াটের। আর বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার ১৬২ মেগাওয়াটের। প্রয়োজনের চেয়ে ১০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র বসে আছে। অথচ এ ধরনের পরিস্থিতিতে সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্যই এই অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বেসরকারি খাতে অনেক বেশি সুবিধা নিয়ে স্থাপন করা হয়েছিল। জনগণ এর সুফল পাচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে যা বলছে সরকার
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে কথিত যেসব বিশেষজ্ঞ প্রশ্ন তোলেন তাদের বলব, আপনারা ক্যাপাসিটি চার্জ ছাড়া তেল, গ্যাস বা কয়লাভিত্তিক একটা ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র করেন দেখান। চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি আপনারা পারবেন না। কারণ বিশ্বের কোনো ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই শর্তে অর্থায়ন করতে রাজি হবে না।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীতে নিজ বাসায় প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ক্যাপাসিটি চার্জ হলো একটা কেন্দ্রের দৈনন্দিন নির্দিষ্ট ব্যয় যেমন বেতন, ভাতা, ব্যাংক সুদ ইতাদি। এটা তো তাকে দিতেই হবে। সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রেও তো সরকার ক্যাপাসিটি চার্জ দিচ্ছে। কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদন না হলেও সেখানে বেতন, ভাতা ও অন্যান্য ব্যয় সরকারকে করতে হচ্ছে। ক্যাপাসিটি চার্জ ছাড়া বিশ্বের কোথাও বিদ্যুৎ কেন্দ্র নেই। আমাদের বিশেষজ্ঞ, রাজনীতিবিদদের এটা কীভাবে বোঝাব? আসলে যত ভালো কাজই করি না কেন সমালোচকরা সমালোচনা করবেই।
বিদ্যুৎ খাতের ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন জানিয়েছেন, বিশ্বের যেকোনো পাওয়ার সেক্টরে এটা স্বাভাবিক ঘটনা। ভারত, ইউরোপের মতো দেশে রিজার্ভ মার্জিন ৭০ শতাংশ বা অনেক সময় শতভাগ হয়ে থাকে।
মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, বর্তমানে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ২৩ হাজার মেগাওয়াটের মতো। পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই পিডিবির মালিকানাধীন এবং সেগুলোরই সক্ষমতা কমেছে অথবা বন্ধ আছে। এগুলোর সঙ্গে ক্যাপাসিটি চার্জের বিষয়টি প্রযোজ্য নয়।
অন্যদিকে, বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই চাহিদা বেড়ে গেলে চালু থাকে। ফলে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র ‘অলস বসে থাকে’ এটা বলার সুযোগ নেই।
এক প্রশ্নের জবাবে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক বলেন, ডিজেলচালিত কিছুকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে সমালোচনা হয়। কিন্তু এগুলো তৈরিই করা হয়েছে পিক ডিমান্ড বা সর্বোচ্চ চাহিদার সময় বিদ্যুতের সরবরাহ যাতে ঠিক থাকে তার যোগান দেওয়ার জন্য। ওই কয়টা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আসলে যেটা বলা হয় যে, বন্ধ থাকে কিন্তু ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়। আদারওয়াইজ প্রাইভেট সেক্টরের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো কিন্তু চলে। ক্যাপাসিটি চার্জটা পুরো বিনিয়োগ প্রক্রিয়ার একটি অংশ। বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গেলে দুটি বড় ব্যয় রয়েছে—একটি হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানির মূল্য এবং আরেকটি হলো বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয়। ক্যাপাসিটি চার্জটা উৎপাদন ব্যয়ের অন্তর্ভুক্ত।’
পিডিবির ক্ষেত্রে নিজস্ব উৎপাদন কেন্দ্র থাকায় তাদের এই ক্যাপাসিচটি চার্জ হিসাব করা হয় না। তবে বেসরকারি উদ্যোগের ক্ষেত্রে একজন উদ্যোক্তা সব ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করেই হিসাব করে থাকে বলেও জানান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক।