আমি মালালা বলছি
নারীজাতির সব চিহ্ন মুছে ফেলতে চাইছিল
তবুও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী প্রদেশে আমাদের পশতুন মাতৃভূমিতে সব কিছু ছিল অন্যরকম। ২০০২ সালে মুশাররফ নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য নির্বাচন করলেন। প্রধান দলগুলোর নেতা নওয়াজ শরিফ এবং বেনজির ভুট্টো। নির্বাসনে থাকায় আজব একটা নির্বাচন হলো। আমাদের প্রদেশে এই নির্বাচন ‘মোল্লা সরকার’-কে ক্ষমতায় আনল। মুত্তাহিদা মুসলিম-ই-আমল জোট ছিল ‘জামিয়াত উলেমা-ই-ইসলাম’সহ পাঁচটি ধর্মীয় দল নিয়ে গঠিত। জেইউআই তালিবানদের প্রশিক্ষণার্থে মাদ্রাসা চালাত। মানুষ ঠাট্টা করে এমএমএ-কে বলত ‘মোল্লা মিলিটারি এলায়েন্স’ এবং বলত তারা মুশাররফের সহযোগিতার কারণেই জয়লাভ করেছে। কিন্তু কিছু মানুষ তাদের সমর্থন করত কারণ খুব ধার্মিক পশতুনরা আফগানিস্তানে মার্কিন অনুপ্রবেশ নিয়ে এবং আফগানিস্তান থেকে তালিবানদের ক্ষমতাচ্যুত করা নিয়ে ক্ষেপে ছিল।
আমাদের এলাকাটা সব সময়ই পাকিস্তানের অন্য সব জায়গা থেকে রক্ষণশীল ছিল। আফগান জিহাদের সময় অনেক মাদ্রাসা নির্মিত হয়েছিল, যার বেশির ভাগই সৌদিদের দ্বারা অর্থায়িত এবং সেখানে বিনামূল্যে পড়াশোনা হওয়ায় অনেক যুবক সেখান থেকে পাস করে গেছে। আমার বাবার ভাষায়, ওটাই পাকিস্তানে ‘আরবায়নের প্রথম ধাপ’। ৯/১১-এর মাধ্যমে এই জঙ্গিত্ব মূলধারার সঙ্গে আরো সম্পৃক্ততা পায়। মাঝেমধ্যে আমি যখন মূল রাস্তা ধরে হেঁটে যেতাম, তখন বিল্ডিংয়ের পাশে চক দিয়ে লেখা বার্তা দেখতাম। কল করার জন্য একটা ফোন নম্বর দিয়ে ওই বার্তায় লেখা থাকত ‘জিহাদ প্রশিক্ষণের জন্য আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন’। তখনকার দিনে জিহাদি দলগুলো তাদের খুশিমতো কাজ করত। তারা খোলাখুলিভাবেই দানের অর্থ সংগ্রহ করত এবং লোক নিয়োগ দিত। এমনকি শাংলায় একজন হেডমাস্টার ছিলেন যিনি গর্ব করে বলতেন, তাঁর বড় সাফল্য হলো গ্রেড নাইনের দশ ছেলেকে কাশ্মীরে জিহাদ প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো।
এমএমএ সরকার সিডি এভং ডিভিডির দোকানগুলো বন্ধ করে দিল এবং আফগান তালিবানের মোরালিটি পুলিশ স্থাপনের চিন্তা করল। তাদের ধারণা ছিল, তারা কোনো পুরুষের সঙ্গে যেতে থাকা মহিলাকে থামিয়ে মহিলাকে প্রমাণ দিতে বলতে পারবে যে পুরুষটি তার আত্মীয়। সৌভাগ্যবশত, আমাদের সুপ্রিম কোর্ট এটা থামাল। এমএমএর সক্রিয় ব্যক্তিরা সিনেমা হলে হামলা চালাল এবং মহিলাদের ছবিওয়ালা বিলবোর্ড ছিঁড়ে ফেলল বা রং দিয়ে ঢেকে ফেলল। কাপড়ের দোকান থেকে মহিলা ম্যানিকিনও নিয়ে গেল তারা। ঐতিহ্যবাহী সালোয়ার কামিজের পরিবর্তে পশ্চিমা ধাঁচের শার্ট এবং ট্রাউজার পরা লোকদের তারা হয়রানি করত। মহিলাদের মাথা আবৃত রাখতে জোর করত তারা। ব্যাপারটা এমন ছিল যে, তারা যেন সর্বজনীন জীবনযাপন থেকে নারীজাতির সব চিহ্ন মুছে ফেলতে চাইছিল।
বাবা ২০০৩ সালে হাইস্কুল খুললেন। প্রথম বছর ছেলেমেয়ে একসঙ্গে ক্লাস হতো, কিন্তু ২০০৪ সাল আসতে আসতে পরিবেশ এমনই পাল্টে গেল যে, একই ক্লাসে ছেলে এবং মেয়ে পড়াটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। সেই পরিবর্তনশীল পরিবেশ গুলামুল্লাহকে আরো সাহসী করে তুলল। স্কুলের এক কর্মচারী বাবাকে বলল, মুফতি প্রায়ই স্কুলে আসে এবং জানতে চায়, কেন মেয়েরা এখনো প্রধান ফটক ব্যবহার করে। সে আরো বলল, একদিন আমাদের এক পুরুষ শিক্ষক একজন নারী শিক্ষককে রিকশায় তুলে দিতে রাস্তায় নিয়ে গেলে মাওলানা জিজ্ঞেস করেছেন, ‘যে লোকটি মহিলাটিকে রাস্তা পর্যন্ত নিয়ে গেল, সে কি তার ভাই?’
‘না’, কর্মচারীটি উত্তর দিল। ‘সে মহিলাটির সহকর্মী।’
‘এটা ঠিক না’। মাওলানা বললেন।
বাবা কর্মচারীটিকে বলে রাখলেন, পরেরবার মাওলানা এলে তাঁকে যেন ডাকা হয়। ডাক এলে বাবা এবং ইসলাম শিক্ষার শিক্ষক মাওলানার মুখোমুখি হলেন।
‘মাওলানা তুমি আমাকে পাগল করে ফেলছ।’ বাবা বললেন, ‘তুমি কে? তুমি একটা পাগল, মাথা খারাপ। তোমার ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। তোমার কি মনে হয় আমি স্কুলে ঢুকে জামাকাপড় খুলে ফেলি? একটা ছেলে আর একটা মেয়েকে দেখলেই তোমার কাছে কেলেংকারি মনে হয়। ওরা স্কুলের বাচ্চা। আমার মনে হয় তোমার উচিত ডা. হায়দার আলীর কাছে যাওয়া।’
ডা. হায়দার আলী ছিলেন আমাদের এলাকার নামকরা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। হায়দার আলীর কাছে নিতে বলার অর্থ হলো, ‘তুমি কি পাগল?’
মুফতি চুপ হয়ে গেলেন। তিনি তাঁর পাগড়ি খুলে বাবার কোলে রাখলেন। আমাদের কাছে পাগড়ি বীরধর্মের প্রতীক এবং পশতুনতার স্মারক এবং একজন মানুষের পাগড়ি হারানো মানে বিরাট অপমান। কিন্তু তিনি তখনই আবার শুরু করলেন। আমি তোমার কর্মচারীকে কখনোই এসব বলিনি। সে মিথ্যা বলছে।
আমার বাবা যথেষ্ট শুনেছিলেন। এখানে তোমার কোনোই প্রয়োজন নেই। বাবা চিৎকার করে বললেন, ‘চলে যাও।’
মুফতি আমাদের স্কুল বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, কিন্তু দেশটা কীভাবে বদলে যাচ্ছে তারই একটা সংকেত ছিল মুফতির নাক গলানো। বাবা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা একটার পর একটা সভা করতে লাগলেন। সভায় শুধু গাছকাটা প্রতিরোধ বিষয়েই না, বরং শিক্ষা এবং গণতন্ত্র নিয়েও কথা হতো।
২০০৪ সালে, আড়াই বছরেরও বেশি সময় ধরে ওয়াশিংটন থেকে আসা চাপ সামলানোর পর জেনারেল মুশাররফ ‘ফেডারেলি অ্যাডমিনিস্টার্ড ট্রাইবাল এরিয়াজ (ফাতা)’-এ সৈন্য পাঠালেন যেটা হলো আফগানিস্তানের সীমানার কাছে থাকা সাতটি এজেন্সি এবং যেখানে সরকারের খুব কম নিয়ন্ত্রণই ছিল। মার্কিনরা দাবি করল যে মার্কিনদের বোমাবর্ষণের সময় যেসব আলকায়েদা জঙ্গি আফগানিস্তান থেকে পালিয়েছিল তারা ওই সব এলাকায় পশতুন আতিথেয়তার সুযোগ নিয়ে নিরাপদে থাকছে। সেখান থেকে তারা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালাচ্ছে এবং সীমান্তে ওপারে ন্যাটো বাহিনীর ওপর আকস্মিক আক্রমণ চালাচ্ছে। সোয়াতে আমাদের জন্য এটা খুব কাছেই ছিল। বাজাউর নামে একটা এজেন্সি সোয়াতের খুব কাছে। ফাতায় থাকা সবাই আমাদের ইউসুফজাই গোষ্ঠীর মতো লোকজন, সবাই আফগানিস্তানের সঙ্গে সীমান্তের দুই পাশে থাকত।
উপজাতীয় এজেন্সিগুলো ব্রিটিশ শাসনামলে আফগানিতানের এবং তৎকালীন ভারতের মধ্যে প্রাবর-এলাকা হিসেবে সৃষ্টি হয়েছিল এবং এখনো উপজাতীয় প্রধান বা বয়োজ্যেষ্ঠ, যাদেরকে মালিক বলা হতো, তাদের দ্বারাই শাসিত হয়। দুর্ভাগ্যবশত, মালিকরা খুব কমই পার্থক্য করে। সত্যি কথা বলতে উপজাতীয় এলাকাগুলো শাসনই করে না কেউ। সেগুলো হলো রুক্ষ পাথুরে ভুলে যাওয়া উপত্যকা, যেখানে মানুষ চোরাচালানির মাধ্যমে কষ্টেসৃষ্টে জীবিকা নির্বাহ করে। (তাদের গড় বার্ষিক আয় ২৫০ ডলার, পাকিস্তানের গড়ের ঠিক অর্ধেক।) তাদের খুব কম হাসপাতাল এবং বিশেষত মেয়েদের জন্য খুব কম স্কুল আছে এবং কিছুদিন আগেও সেখানে রাজনৈতিক দল অনুমোদিত ছিল না। ওই সব এলাকার মহিলারা বলতে গেলে পড়তেই পারে না। পুরোনো ব্রিটিশ নথিপত্র পড়লেই বেরিয়ে যাবে, তারা তাদের তেজ এবং স্বাধীনতার জন্য বিখ্যাত ছিল।
আমাদের সৈন্যরা আগে কখনো ফাতায় যায়নি। বরং তারা ব্রিটিশদের মতোই পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করত এবং সাধারণ সৈন্যদের থেকে তারা পশতুনদের নিয়োগকৃত সীমান্ত সাময়িক বাহিনীর ওপরই বেশি ভরসা করত। নিয়মিত সেনাবাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্তটা খুবই কঠিন ছিল। কেবল আমাদের সেনাবাহিনী এবং আইএসআইয়ের সঙ্গে জঙ্গিদের ভালো যোগাযোগই ছিল না, এটার মাধ্যমে আমাদের সৈন্যদেরও তাদের নিজেদের পশতুন ভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। ২০০৪ সালের মার্চে সেনাবাহিনী দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে প্রথমবারের মতো প্রবেশ করল। স্থানীয় লোকরা দেখল, এটা তাদের জীবনযাত্রার ওপর একটা আঘাত। ওখানে সবাই অস্ত্র বহন করত এবং স্থানীয়রা বিদ্রোহ করলে শত শত সৈন্য নিহত হলো। সেনাবাহিনীর জন্য এটা ছিল বিরাট এক অভিঘাত। কেউ কেউ যুদ্ধ করতে অস্বীকার জানাল, নিজেদের লোকের সঙ্গে যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানাল। ঠিক নয়দিন পর তারা নিজেদের প্রত্যাহার করে নিল এবং নেক মোহাম্মদের মতো স্থানীয় জঙ্গিনেতার সঙ্গে ‘আলোচিত শান্তি মীমাংসা’-তে পৌঁছাল এর মাধ্যমে সব আক্রমণ থামাতে এবং বিদেশি যোদ্ধাদের কক্ষতে জঙ্গিদের ঘুষ দিতে বাধ্য হলো সেনাবাহিনী। জঙ্গিরা সেই অর্থ দিয়ে আরো অস্ত্র কিনে তাদের কার্যক্রম সক্রিয় রাখত। কয়েক মাস পর যুক্তরাষ্ট্রের একটি ড্রোনের মাধ্যমে পাকিস্তানের ওপর প্রথম হামলা এলো।
২০০৪ সালের ১৭ জুন একটি মানুষবিহীন প্রিডেটর দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে নেক মোহাম্মদ স্যাটেলাইট কোনের মাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় তার ওপর নরকাগ্নি মিসাইল নিক্ষেপ করে। তিনি এবং তাঁর আশপাশের সব মানুষ তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করেন। স্থানীয় লোকজন কিছুই বুঝতে পারেনি তখন আমরা জানতামই না যে আমেরিকা এমন কাজ করতে পারে। নেক মোহাম্মদকে নিয়ে যে যাই বলুক, আমরা মার্কিনদের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলাম না এবং আমাদের আকাশ থেকে আমাদেরই ভূমিতে তারা আক্রমণ করবে, এটা ছিল কল্পনারও অধিক। উপজাতীয় এলাকার লোকজন খুব রেগে ছিল এবং অনেকেই স্থানীয় বেসামরিক বাহিনী ‘লস্কর’ বা জঙ্গি বাহিনীতে যোগ দিল।
এরপর আরো আক্রমণ হলো। মার্কিনরা বলল যে, লাদেনের ডেপুটি আইমান আল-জাওয়াহিরি বাজাউরে লুকিয়ে আছে এবং সেখানে বিয়েও করেছে। ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে তাকে লক্ষ্য করে একটি ড্রোন ডামাডোলা নামে একটি গ্রামে আঘাত হেনে তিনটি বাড়ি ধ্বংস করে দিল এবং ১৮ জন মানুষকে হত্যা করল। মার্কিনরা বলল, সে হুঁশিয়ারি পেয়ে পালিয়ে গেছে। একই বছরের ৩০ অক্টোবর আরেকটা মার্কিন প্রিডেটর খার মূল শহরের কাছে একটি পাহাড়ের ওপর একটি মাদ্রাসায় আঘাত হেনে যুবকসহ ৮২ জন মানুষ মেরে ফেলল। মার্কিনরা বলল, ওটা ছিল গ্রুপের ভিডিওতে উল্লিখিত আল-কায়েদা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প এবং বন্দুক স্থাপনের মঞ্চ আর সুড়ঙ্গ দ্বারা অস্ত্র আনা নেওয়া করতো। পাহাড়টা প্রহেলিকাচ্ছন্ন ছিল। আক্রমণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে একজন প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা এবং মাদ্রাসার মালিক ফকির মোহাম্মদ ঘোষণা দিলেন যে এই মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়া হবে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে আত্মঘাতী বোমা হামলার মাধ্যমে।
বাবা এবং তাঁর বন্ধুরা চিন্তিত হয়ে পড়লেন এবং একটি শান্তি আলোচনা সভার জন্য স্থানীয় মুরব্বি এবং নেতাদের আহ্বান জানালেন। সেটা ছিল জানুয়ারির একটি তীব্র শীতের রাত, কিন্তু ১৫০ জন লোক জড়ো হলো।
এটা এখানে আসছে, বাবা সাবধানবাণী দিলেন, ‘আগুন এই উপত্যকা ছুঁয়ে ফেলছে। জঙ্গিদের আগুন এখানে পৌঁছানোর আগেই তা নিভিয়ে ফেলতে হবে।’
কিন্তু কেউ শুনল না। সামনের সারিতে বসা এক স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাসহ কেউ কেউ হেসে ফেললেন।
‘খানসাহেব’, বাবা তাঁকে বললেন, ‘আপনি জানেন আফগানিস্তানের লোকদের কী হয়েছে। তারা শরণার্থী হিসেবে আমাদের সঙ্গে থাকছে। একই জিনিস বাজাউরে ঘটছে। একই ব্যাপার আমাদের ক্ষেত্রেও ঘটবে, আমার কথাগুলো মনে রাখুন, এবং আমাদের কোনো আশ্রয় থাকবে না, কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকবে না।’
কিন্তু লোকটার চেহারায় বিদ্রূপাত্মক ভাব ফুটে উঠল। এই লোককে দেখ, সে যেন বাবার হয়ে কথা বলল, ‘আমি একজন খান। কার সাহস আমাকে এই এলাকা থেকে তাড়ানোর?’
বাবা হতাশ হয়ে ঘরে ফিরলেন। আমার একটা স্কুল আছে, কিন্তু আমি খানও নই, রাজনৈতিক নেতাও নই। আমার কোনো খুঁটির জোর নেই, তিনি বললেন। ‘আমি শুধুই সামান্য একটা লোক।’
চলবে