হিজবুল্লাহ হিজবুল্লাহ কী? কেন তারা ইসরায়েলে হামলা করছে?
গাজা উপত্যকায় হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে মুসলিম বিশ্বের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বেশকিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক। ইসরায়েলের অমানবিক হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোনো মুসলিম দেশ কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। তবে একতরফাভাবে ইসরায়েলের ওপর ক্রমাগত হামলা চালিয়ে গেছে লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন ‘হিজবুল্লাহ’। খবর আলজাজিরার।
এখনও ইসরায়েলের সীমান্তে হামলা চালাচ্ছে সংগঠনটি। সম্প্রতি হামলা জোরদার করার পর থেকে নতুন করে আলোচনায় এসেছে সংগঠনটি। হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের ‘ইট মারলে পাটকেল ছোড়ার’ সর্ম্পক নতুন রূপ নিয়েছে সাম্প্রতিক আক্রমণের মধ্য দিয়ে। ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়ার পর থেকে হিজবুল্লাহর আক্রমণ সবার চোখে নতুন যুদ্ধের আবহ গড়ে দিচ্ছে। নেতানিয়াহু সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে হিজবুল্লাহর আক্রমণ মোকাবিলা করা। গত বছরের ৮ অক্টোবর ইসরায়েল রাফায় আক্রমণ শুরু করলে হিজবুল্লাহ আগের চেয়ে জোরালো আক্রমণ শুরু করে ইসরায়েল সীমান্তে।
এ প্রসঙ্গে ইসরায়েলি এক কর্মকর্তা বলেন, হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধের জন্য ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর একটি পরিকল্পনা রয়েছে। অন্যদিকে হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরাল্লাহ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ইসরায়েলের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত।
হিজবুল্লাহ কী?
হিজবুল্লাহ, বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় ‘আল্লাহর দল’। এটি ইরান সমর্থিত সংগঠন, যা ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইসরায়েল লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল দখল করলে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য হিজবুল্লাহ গঠিত হয়েছিল। হিজবুল্লাহ সবচেয়ে বেশি সমর্থন পেয়ে থাকে শিয়া মুসলমানদের কাছ থেকে। সংগঠনটি এই অঞ্চলে ইসরায়েলের অন্যতম বড় শত্রু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
সংগঠনটি গাজায় ইসরায়েলের হামলার পর থেকে বলছে, তাদের কাছে পর্যাপ্ত রকেট রয়েছে, যা ইসরায়েলের সমস্ত ভূখণ্ডে আঘাত হানতে পারে এবং ২০২১ সালের হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ বলেছিলেন, হিজবুল্লাহর এক লাখ যোদ্ধা আছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য অনুসারে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান হিজবুল্লাহর জন্য বার্ষিক কয়েকশ মিলিয়ন ডলার করে বরাদ্দ করছে। ১৯৯২ সাল থেকে নাসরাল্লাহর নেতৃত্বে সংগঠনটি পরিচালিত হয়ে আসছে এবং হিজবুল্লাহ লেবাননের অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। বিশাল রাজনৈতিক প্রবণতা ও সামরিক সুযোগ-সুবিধা থাকার কারণে প্রায়শই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা হিজবুল্লাহকে ‘একটি রাষ্ট্রের মধ্যে আরেকটি রাষ্ট্র’ হিসেবে অভিহিত করে থাকেন।
হিজবুল্লাহর লক্ষ্য কী?
হিজবুল্লাহ যখন প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, তখন তাদের লক্ষ্য ছিল লেবানন থেকে ইসরায়েলকে বিতাড়িত করা। প্রায় ২০ বছর ধরে চলা যুদ্ধে কারও সঙ্গে কোনো শান্তি আলোচনা ছাড়া ২০০০ সালে ইসরায়েল লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল থেকে একতরফা সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর হিজবুল্লাহ নিজেদের ‘প্রথম আরব সেনাবাহিনী’ হিসেবে ঘোষণা করে। ইসরায়েল এখনও সিরিয়ার গোলান মালভূমি এবং ১৯৬৭ সালে যুদ্ধের পর থেকে ফিলিস্তিনের এক-তৃতীয়াংশ দখল করে রেখেছে।
হিজবুল্লাহ গঠনের পর একটি ইশতেহার পিডিএফ আকারে প্রকাশ করে, যার মধ্যে ইসরায়েলকে পরাজিত করা এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক ধারণা ও সংস্থাগুলোকে দূর করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ইসরায়েলের সঙ্গে আগে কখনো হিজবুল্লাহর সংঘর্ষ হয়েছিল?
২০০৬ সালের জুলাইয়ে একটি আন্তসীমান্ত অভিযানে হিজবুল্লাহ দুজন ইসরায়েলি সৈন্যকে আটক করে। কিন্তু এই ঘটনার পর লেবানন সীমান্ত জুড়ে ইসরায়েল সামরিক অভিযান চালায়, যার ফলে ৩৪ দিনের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ দেখে বিশ্ব, যা ‘জুলাই যুদ্ধ’ নামেও পরিচিত। কোনো পক্ষই এই যুদ্ধে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়নি, তবে এক হাজার ১০০ জনেরও বেশি লেবানিজ এবং ১৬৫ জন ইসরায়েলি নিহত হয়েছিল। নাসরাল্লাহ প্রায়শই বলেন, ২০০৬ সালের যুদ্ধ হিজবুল্লাহর জন্য একটি সাফল্য ছিল। তারা ইসরায়েলের অনেক বড় সৈন্য বহরকে প্রতিহত করেছিল।
বিশ্লেষকরা বিশ্বাস করেন, হিজবুল্লাহ এই অঞ্চলের একমাত্র অ-রাষ্ট্রীয় সংগঠন, যারা ইসরায়েলের আগ্রাসন দমিয়ে রাখতে পারে।
হিজবুল্লাহ কি হামাসের চেয়ে ব্যতিক্রম?
হিজবুল্লাহ লেবানন ভিত্তিক সংগঠন। তবে হামাস একটি ফিলিস্তিনি সংগঠন, যা ১৯৮৭ সালে ইসরায়েলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে গাজায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। দুটি দল পৃথক হলেও তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা। ২০০৬ সালে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর থেকে হামাস গাজা উপত্যকা শাসন করে আসছে।
ইসরায়েল কি হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে?
দুপক্ষের মুখোমুখী অবস্থান ও ক্রর্মবধমান পরিস্থিতির জন্য আশঙ্কা করা হচ্ছে যুদ্ধ হতে পারে। বিশ্লেষকরা দীর্ঘদিন ধরে বলছেন, হিজবুল্লাহ যদি আক্রমণ শুরু করে, তবে লেবাননে থাকা ফিলিস্তিনি সংগঠনগুলো শক্তি সঞ্চয় করে আক্রমণ শুরু করবে। যেহেতু উভয় পক্ষই এখনও পর্যন্ত নিজেদের সংযত রেখেছে, তাই কোনো কিছু হবে কিনা তা দেখা বাকি রয়েছে।
হিজবুল্লাহ কি ‘সন্ত্রাসবাদী’ সংগঠন?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সৌদি আরব ও পশ্চিমা দেশগুলো হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করে আসছে।
লেবাননে হিজবুল্লাহর ভূমিকা কী?
লেবাননের পার্লামেন্ট একাধিক হিজবুল্লাহ সমর্থিত মন্ত্রী এবং আইন প্রণেতারা রয়েছে। ২০০৫ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরিকে হত্যার পর সিরিয়া লেবানন থেকে সরে আসার পর সংগঠনটি রাজনৈতিকভাবে আরও পরিচিত হয়ে ওঠে। লেবাননের রাজনীতিতে সৌদির প্রতীক হিসেবে হারিরিকে দেখা হতো।
২০১৬ সালে হিজবুল্লাহ সমর্থিত মিশেল আউন প্রেসিডেন্ট হন। এর দুই বছর পর হিজবুল্লাহ এবং তার মিত্ররা ৯ বছর পর লেবাননের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ২০২২ সালে মিশেল আউন পদত্যাগ করলে হিজবুল্লাহ ও তাদের মিত্ররা সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়।