পুঁজিবাজারে মতিউর এক কোটি টাকা বিনিয়োগে মুনাফা পান ১৪ কোটি
ছাগলকাণ্ডে আলোচনা-সমালোচনায় উঠে আসা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমান পুঁজিবাজারের একজন দক্ষ বিনিয়োগকারী। তিনি জানালেন, পড়ে যাওয়া কোম্পানির শেয়ার কম দামে কিনে পরবর্তীতে অতি উচ্চ দামে বিক্রি করতেন। তেমনি অতীতে অতি মুনাফা করা ফরচুন সুজের শেয়ারের গল্প শোনালেন। আলোচিত কোম্পানিটিতে মাত্র এক কোটি টাকার শেয়ার কিনে পরবর্তীতে সেই শেয়ার অধিক দামে বিক্রি করেছেন। এতে তার মুনাফা হয়েছে ১৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া আগামীতে কোন শেয়ারটিতে বিনিয়োগ করলে অধিক মুনাফা হবে, সেটিও তিনি ধরতে পারতেন সহজেই। এভাবেই বিশ্লেষণ করে দুর্বল ও সম্ভাবনাময় পড়ে থাকা কম দামের শেয়ারে বিনিয়োগ করতেন। এতে বেশ ভাল লাভবানও হন। এভাবেই তিনি সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন।
বর্তমানে মতিউর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতির দায়িত্বে আছেন। তিনি সরকারি প্রতিষ্ঠান সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদেও রয়েছেন। গত ২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিন বছরের জন্য তাকে নিয়োগ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
এদিকে ছাগলকাণ্ডে নানা সমালোচনার মুখে পড়েন এনবিআরের এই সদস্য। বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছাগলকাণ্ডের ভাইরাল হওয়া মুশফিকুর রহমান ইফাতের অর্থের উৎস এবং তার নিজের দুর্নীতি নিয়ে শুরু হয় গুঞ্জন। এমন অবস্থায় দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভির কাছে মুখ খোলেন তিনি। দাবি করেন, ছাগলকাণ্ডের ভাইরাল হওয়া ইফাত তাঁর সন্তান নয়। এমনকি আত্মীয় বা পরিচিতও নয়। এরপর বিতর্কের আগুনে ঘি ঢালার মতো বেরিয়ে আসে তাঁর থলে বিড়াল।
মতিউর রহমান বিষয়টি অস্বীকার করলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাঁর স্বজনদের বরাত দিয়ে খবর প্রকাশিত হয়, যেখানে ইফাত তার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান বলে তুলে ধরা হয়। ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী জানান, ইফাত তার মামাতো বোনের সন্তান। ইফাত এনবিআর সদস্য মতিউর রহমানের দ্বিতীয় পক্ষের ছেলে। ধারণা করছি, রাগ করে মতিউর রহমান ইফাতের সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করেছেন।
এ ব্যাপারে মতিউর রহমানের বক্তব্য জানতে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
জানা গেছে, ইফাতের মা শাম্মী আখতার শিবলী ওরফে শিবু মতিউর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রী। শাম্মী আখতারের বাবার বাড়ি ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে।
মতিউর রহমান জানান, ১১তম বিসিএসে বাণিজ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন তিনি। তার বাড়ি বরিশালের মুলাদি উপজেলায়। তার স্ত্রী লায়লা কানিজ। ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন তার স্ত্রী। তাদের ঘরে এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। তারা সুশিক্ষিত।
সম্প্রতি এনটিভিতে দেওয়া প্রায় ৩৫ মিনিটের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে মতিউর রহমান তার বিপুল সম্পদ অর্জনের চিত্র তুলে ধরেন। ওই সাক্ষাৎকারে মতিউর রহমান জানান, অনুসন্ধান, বুদ্ধিমত্তা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে পুঁজিবাজারকে কাজে লাগিয়ে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। পুঁজিবাজারের দুর্বল ও সম্ভাবনাময় কোম্পানির মালিকদের সাথে বসে ওইসব কোম্পানির উন্নয়নের পরিকল্পনা করতেন তিনি। সেখানে তিনি বিনিয়োগও করতেন। পিছিয়ে পড়া বা কম দামে শেয়ার কিনতেন তিনি। পরবর্তীতে সেই শেয়ার উচ্চ দামে বিক্রি করে বিপুল মুনাফা করতেন। আইপিও ব্যবসার সাথে জড়িত আছেন তিনি। মতিউর রহমান জানান, পুঁজিবাজারে কোম্পানি ফরচুন সুজের মালিকরা তার কাছের মানুষ। তাকে ওই কোম্পানির মালিকরা ৮ টাকা দামে শেয়ার কিনতে দিয়েছিল। পরে ওই শেয়ার ৫৪ টাকা দামে বিক্রি করেন। এতে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ মুনাফা করেছেন।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের অর্থের উৎস প্রসঙ্গে মতিউর রহমান জানান, এসি-ডিসি থাকা অবস্থায় ভাল কাজের পুরস্কার হিসেবে সরকার থেকে পান ৮৭ লাখ টাকা। সেখান থেকে ৩৭ লাখ টাকা দিয়ে তিনি জমি কিনেন। পরবর্তীতে সেই জমি বিক্রি করেন সাড়ে চার কোটি টাকা। ওই টাকার একাংশ মানে দুই কোটি টাকা নিজের নামে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেন। অপরদিকে এক কোটি টাকা তার মেয়ে ফারহানা রহমানের নামে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেন। শুধু তার মেয়ের বিনিয়োগ থেকেই ১৪ কোটি টাকা মুনাফা করেছেন তিনি। তবে তার নিজের নামের বিনিয়োগ থেকে কত টাকা মুনাফা করেছেন, তা তিনি কৌশলে এড়িয়ে গেছেন।
পুঁজিবাজারে অধিক লাভ প্রসঙ্গে মতিউর রহমান বলেন, ‘এই মুহূর্তে সিলভা ফার্মাসিউটিক্যালস নিয়ে কাজ করছেন। এটা সামনে ভাল দিকে যাবে। আগামীতে কোম্পানি গ্রোথ তিনগুণ বাড়বে। বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি দাম ১৬ থেকে ১৭ টাকা। এক বছরের মধ্যে কোম্পানির শেয়ার প্রতি দাম ৩০ থেকে ৩২ টাকা হবে। সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। বিশ্লেষণ করে দুর্বল ও সম্ভাবনাময় এই রকমের পড়ে থাক কম দামে শেয়ারে আমি বিনিয়োগ করি। এতে বেশ ভাল লাভ হয়।’
জানা যায়, ঈদুল আজহার আগে ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল কিনতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হন মুশফিকুর রহমান ইফাত। সামাাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওঠে আসে ভাইরাল হওয়া এই তরুণের বাবা এনবিআরের সদস্য ড. মতিউর রহমান। লাখ টাকা বেতনে চাকরি করে অর্ধকোটি টাকার গরু-ছাগল কেনা নিয়ে সর্বত্র চলছে সমালোচনা। এরপর নতুন মোড় নেয় যখন মতিউর রহমান নিজের ছেলেকে অস্বীকার করে বলেন, ইফাত তার ছেলে নয়, ইফাত নামে কাউকে তিনি চেনেন না। ব্যাপক সমালোচনার কারণে মতিউর রহমান তার ছেলেকে অস্বীকার করছেন এমন অভিযোগ উঠেছে। কারণ ১৫ লাখ টাকার ছাগলকে কেন্দ্র করে ভাইরাল হওয়ার পর ইফাতের দামি ব্র্যান্ডের ঘড়ি, গাড়ি, আলিশান জীবনযাপনের নানা বিবরণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। সরকারি চাকরিজীবী বাবার বেতনের টাকা দিয়ে ছেলে কীভাবে এমন ব্যয়বহুল জীবনযাপন করতে পারে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে তাৎক্ষণিকভাবে তিনি ছেলের পরিচয় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে ফেসবুকে সমালোচনার জন্ম দেওয়া ১৫ লাখের ওই ছাগল ইফাত এক লাখ টাকা অগ্রিম দিয়েও আর বাসায় নেননি দাবি করেছে ছাগলটির মালিক সাদিক অ্যাগ্রো কর্তৃপক্ষ। তবে ইফাত আরও বেশি দামে একাধিক গরু কিনেছেন বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তথ্য ও ভিডিও প্রকাশ পায়। এদিকে ছেলের ছাগলকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু সমালোচনা এখন মতিউর রহমানের সম্পদের দিকে গড়িয়েছে। তার কত সম্পদ রয়েছে, সেটি নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে। একাধিক বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট ও প্লটের তথ্য বেড়িয়ে আসছে। চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নরসিংদী ও ময়মনসিংহে রয়েছে তার ও পরিবারের সদস্যদের নামে রিসোর্ট, শুটিং স্পট, বাংলো, জমিসহ নামে-বেনামে রয়েছে সম্পত্তি। ব্যাংক হিসাবে রয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ, পুঁজিবাজারে রয়েছে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ।