উইকিলিকস ও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে ঘিরে ঘটনাপ্রবাহ
দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর অবশেষে গত সোমবার (২৪ জুন) যুক্তরাজ্যের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন মার্কিন গোপন দলিল ফাঁস করে সাড়া ফেলে দেওয়া ওয়েবসাইট উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নথি ফাঁস করে ২০১০ সালে বিশ্বজুড়ে হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছিলেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল গুপ্তচরবৃত্তি, ইরাক-আফগানিস্তান যুদ্ধে মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁসসহ একাধিক দেশের তথ্য ফাঁস করার।
অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক অ্যাসাঞ্জ ২০১৯ সালের এপ্রিলে লন্ডনে ইকুয়েডরের দূতাবাস থেকে গ্রেপ্তার হন। তিনি ২০১২ সাল থেকে সেখানে দীর্ঘ সাত বছর অবস্থান করেন।
সুইডেন সরকার ৫২ বছর বয়সী অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনলে তিনি ইকুয়েডর দূতাবাসে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। অ্যাসাঞ্জ সুইডেন সরকারের করা অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে দাবি করেছেন, তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করার এটি একটি চক্রান্ত। পরে সুইডিশ সরকার তার বিরুদ্ধে করা ধর্ষণ মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয়।
২০১৯ সালের মে মাসে জামিনের শর্ত লঙ্ঘনের দায়ে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ব্রিটেনের আদালত অ্যাসাঞ্জকে ৫০ সপ্তাহের কারাদণ্ড প্রদান করেন এবং তাকে বেলমার্শ কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। লন্ডনের বেলমার্শ কারাগার সবচেয়ে নিরাপদ ও প্রাচীন হিসেবে প্রসিদ্ধ।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে ঘিরে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো হলো–
২০০৬ সালে উইকিলিকস প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ‘ডেড-লেটারবক্স’ শিরোনামে মার্কিন যু্ক্তরাষ্ট্রের গোপন তথ্য ফাঁস করেন।
২০১০ সালের এপ্রিলে উইকিলিকস ইরাকে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর মার্কিন হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর ফুটেজ প্রকাশ করে।
২০১০ সালের আগস্টে সুইডিশ প্রসিকিউটররা দুটি ধর্ষণের অভিযোগে এনে অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। অ্যাসাঞ্জ যা ‘ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করেন।
২০১০ সালের ডিসেম্বরে অ্যাসাঞ্জকে লন্ডনে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পরে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। তারপর তিনি আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিরুদ্ধে আপিল করেন।
২০১২ সালের মে মাসে যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্ট রায় দেন, ধর্ষণ মামলার অভিযোগের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে সুইডেনে প্রত্যাবর্তন করা উচিত।
২০১২ সালের জুনে লন্ডনে ইকুয়েডরের দূতাবাসে অ্যাসাঞ্জ প্রবেশ করেন। ২০১২ সালের আগস্টে অ্যাসাঞ্জকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান করা হয়। অ্যাসাঞ্জ দূতাবাস থেকে সাংবাদিকদের বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেন ‘গরু খোঁজা’ বন্ধ করে।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাজ্য ও সুইডিশ কর্তৃপক্ষ নির্বিচারে আটক করেছে বলে জাতিসংঘের একটি বিচারক প্যানেল রায় দেন এবং তাকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
২০১৭ সালের মে মাসে সুইডেনের পাবলিক প্রসিকিউশনের পরিচালক ঘোষণা করেন, অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলার তদন্ত স্থগিত করা হয়েছে।
২০১৮ সালের অক্টোবরে অ্যাসাঞ্জকে বিভিন্ন শর্ত ও নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয় ইকুয়েডরের দূতাবাসে থাকার জন্য। এরপর অ্যাসাঞ্জ ‘মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা’ লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে ইকুয়েডর সরকারের বিরুদ্ধে।
২০১৮ সালের নভেম্বরে মার্কিন বিচার বিভাগ গোপনে অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ দায়ের করেন।
২০১৯ সালের এপ্রিলে লন্ডনের মেট্রোপলিটন পুলিশ ইকুয়েডর সরকারের অনুমতি নিয়ে দূতাবাসে প্রবেশ করে এবং ২০১২ সালে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পরও আদালতে আত্মসমর্পণ না করার জন্য অ্যাসাঞ্জকে গ্রেপ্তার করে।
বেলমার্শ কারাগারে প্রেরণ
২০১৯ সালের মে মাসে জামিনের শর্ত লঙ্ঘনের দায়ে অ্যাসাঞ্জকে ৫০ সপ্তাহ কারাদণ্ড প্রদান করেন যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্ট।
২০১৯ সালের মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল গ্র্যান্ড জুরি অ্যাসাঞ্জকে গুপ্তচরবৃত্তি আইনের ১৭টি আইন লঙ্ঘন করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে, তার বিরুদ্ধে মোট ১৮টি অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।
২০১৯ সালের মে মাসে অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে সুইডেন সরকার ধর্ষণ মামলার তদন্ত পুনরায় চালু করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে অভিযোগ চার্জশিট প্রকাশ করে। যুক্তরাজ্যে থাকার জন্য অ্যাসাঞ্জ আদালতে আইনি লড়াই শুরু করেন।
২০১৯ সালের নভেম্বরে পুনরায় সুইডিশ প্রসিকিউটররা ধর্ষণ মামলার তদন্ত স্থগিত করে।
২০২১ সালের জানুয়ারিতে অ্যাসাঞ্জের মানসিক স্বাস্থ্যের ভারসাম্যহীনতা দেখা যাওয়ার ফলে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণ করার জন্য মার্কিন সরকারের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন একজন ব্রিটিশ বিচারক। কিন্তু ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই রায়েরে বিরুদ্ধে আপিল করে জয়ী হয়।
২০২২ সালের জুনে যুক্তরাজ্য সরকার অ্যাসাঞ্জকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যাবর্তন করার নির্দেশ দেয়, তবে অ্যাসাঞ্জকে আপিল করার সুযোগ প্রদান করে।
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে অ্যাসাঞ্জের আইনজীবীরা ব্রিটেনের সুপ্রিম কোর্টে অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো ঠেকাতে আপিল করেন।
২০২৪ সালের মে মাসে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেযন, অ্যাসাঞ্জ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যাবর্তনের বিরুদ্ধে নতুন করে আপিল করতে পারবেন।
২০২৪ সালের ১৯ জুনে অ্যাসাঞ্জ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন এবং হাইকোর্ট অ্যাসাঞ্জের জামিন মঞ্জুর করেন।
২০২৪ সালের ২৪ জুন অ্যাসাঞ্জ আনুষ্ঠানিকভাবে গুপ্তচরবৃত্তি আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ স্বীকার করেন। যার বিনিময়ে কারাগার থেকে মুক্তি প্রদান ও তার জন্মস্থান অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। মুক্তি পেয়ে চুক্তির আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে প্লেনে করে অট্রেলিয়ার নিকটবর্তী প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন অধ্যুষিত উত্তর মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জে যান তিনি।
অ্যাসাঞ্জের মুক্তি নিয়ে খুশি তার পরিবার ও স্বজনরা। অ্যাসাঞ্জের মুক্তি বিষয়ে মার্কিন বিচার বিভাগ দীর্ঘ বিবৃতি প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, অনুমতি ব্যতীত অ্যাসাঞ্জ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুনরায় ফিরতে পারবেন না।