আধুনিক আবাসন পেয়ে আনন্দিত হরিজন সম্প্রদায়
চাঁদপুরে প্রথম বারের মতো আধুনিক ফ্ল্যাট পাচ্ছে হরিজন সম্প্রদায়ের ৮৮টি পরিবার। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার ও ইউএনডিপির অর্থায়নে এই ফ্ল্যাট তৈরি করা হয়। আধুনিক আবাসন পেয়ে উন্নত জীবনের স্বপ্ন বুনছেন সমাজের পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীর মানুষ। এখান থেকে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্ম আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস হরিজন পল্লীর বাসিন্দাদের।
গতকাল বুধবার (১০ জুলাই) সকালে প্রাথমিক পর্যায়ে হরিজন সম্প্রদায়ের ১০ সদস্যের হাতে ফ্ল্যাটের চাবি তুলে দেন পৌর মেয়র মো. জিল্লুর রহমান।
ভোরে যখন পুব আকাশে উদিত হয় সূর্য, নগরীর অনেকেই তখনও ভোরের বয়ে যাওয়া হিমেল হাওয়ায় গায়ে কাঁথায় জড়িয়ে ঘুমে বিভোর। ঠিক তখন নগর পরিষ্কারের যুদ্ধে নেমে পড়ে একদল মানুষ। সমাজে যারা পরিচিত হরিজন কিংবা পরিচ্ছন্নকর্মী হিসেবে।
মহাসড়ক থেকে অলিগলি ও মার্কেট থেকে বাসা-বাড়ি সব স্থানের ময়লা-আবর্জনা ঝাঁড় দিয়ে পরিষ্কার করে তোলে প্রকৃতি। আগের দিনের ময়লা-আবর্জনায় এটো করে রাখা শহর হয়ে ওঠে ঝলমলে পরিষ্কার।
ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে পরিবেশ আলো ঝলমলে করে তুললেও এই হরিজনদের নিজেদের জীবনটা অন্ধকারে ঘেরা। দিন দিন সমাজ কিংবা রাষ্ট্র সামনে এগুলেও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাবে তাদের যাত্রা আরও পশ্চাতে। তবে আশারবাণী হচ্ছে প্রান্তিক এসব মানুষের জীবন-মান উন্নয়নে কাজ করছে সরকার।
চাঁদপুর শহরের স্বর্ণখোলা রোড এলাকার হরিজন দম্পতি জুনু ও রজনী রানী। বংশ পরম্পরায় তাঁরা করে আসছেন পরিচ্ছন্নতার কাজ। খুব ভোরে তৈরি হয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ময়লা সংগ্রহের কাজে। শহরের অলিগলি ধরে বাঁশি ফুঁকে সংগ্রহ করেন ময়লা-আবর্জনা। উঁচু-উঁচু সব ভবন দেখে মনের কোণে জমে হাহাকার- সমাজ পরিষ্কারের কাজ করলেও নিজেদের বসবাসের জন্য নেই কোনো পরিচ্ছন্ন আবাসন। পৌরসভার দেওয়া ফ্ল্যাট পেয়ে ঘুচেছে আজন্মের সেই আক্ষেপ। স্বপ্ন বুনছেন উন্নত পরিবেশে বসবাস করে স্মার্ট বাংলাদেশের উপযোগী করে ছেলে-মেয়েদের গড়ে তোলার।
জুনু ও তার স্ত্রী রজনী রানী বলেন, ‘আমাদের বাবা, দাদা থেকে শুরু করে বংশ পরম্পরায় পরিচ্ছন্নতার কাজ করে আসছি। কিন্তু কখনও ভাবিনি নিজেদের থাকার জন্য এমন ঘর পাব। আমরা অনেক খুশি। ছেলে-মেয়েদের ভালোমতো লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করতে চাই। যেন ভবিষ্যতে এই পেশায় না থেকে ভালো কিছু করতে পারে।
পুকুর লাগোয়া প্রায় ২৫ শতাংশ জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে পাশাপাশি পাঁচতলা বিশিষ্ট দুটি ভবন। পরিবেশবান্ধব ব্লকে তৈরি আধুনিক এই ভবনের নান্দনিক ডিজাইন মন কাড়বে যে কারও। দূর থেকে তাকালে মনে হতে পারে ইউরোপ কিংবা উন্নত বিশ্বের কোনো বাসভবন। এমন দৃষ্টিনন্দন ভবন দুটি তৈরি করা হয়েছে হরিজন পল্লীর বাসিন্দাদের জন্য। যাতে রয়েছে ৮৮টি ফ্ল্যাট। প্রতিটি ফ্ল্যাটে রয়েছে একটি করে বসবাসের রুম, টয়লেট ও রান্নঘর। প্রতিটি ভবনের নিচতলায় রয়েছে অনুষ্ঠান করার জন্য কমন স্পেস।
জুনু কিংবা রজনী রানি নন। আধুনিক এমন ফ্ল্যাটের মালিক হয়ে খুশিতে আত্মহারা আরও অনেকেই। স্বাস্থ্যকর পরিবেশে ছেলে-মেয়েদের আরও উন্নত জীবন গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর হরিজন পরিবারগুলো। তবে ফ্ল্যাটে বসবাসের জায়গার কিছুটা স্বল্পতার কথা বলছেন কেউ কেউ।
জনি হরিজন বলেন, ‘ফ্ল্যাট পেয়ে আমরা খুশি। তবে থাকার জায়গা কম। একটা মাত্র রুম তাও আবার ছোট। যেখানে পরিবার নিয়ে থাকা অনেক কষ্টকর। এর সমাধান করা প্রয়োজন।’
পৌর মেয়র মো. জিল্লুর রহমান জুয়েল বলেন, আজকে ১০ জনের মধ্যে ফ্ল্যাটের চাবি তুলে দেয়া হলো। খুব সহসায় আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মাধ্যমে সবার মধ্যে ফ্ল্যাটের কাগজপত্র হস্তান্তর করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর অবদান আপনাদের এই আধুনিক বাসস্থান। এটা সত্যি বরাদ্দকৃত ফ্ল্যাটগুলোর আয়াতন কম। এতে আমাদের পৌরসভার কোনো হাত ছিল না। এটি প্রজেক্ট ডিপার্টমেন্টের কাজ। তবে আমরা পরিবারের সদস্য সংখ্যা দেখে পাশাপাশি একাধিক ফ্ল্যাট বরাদ্দ দিয়েছি। যাতে তাদের বসবাসে সমস্যা না হয়। ভবিষ্যতে যেসব ভবন নির্মাণ করা হবে, সেখানে এই ডিজাইন পরিবর্তন করা হবে।
মেয়র আরও বলেন, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে এই আধুনিক আবাসন ব্যবস্থা। জীবন যাপনের পরিবেশ উন্নয়নের পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া এই সমাজের শিশুদের শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ করা হচ্ছে। এসব জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন জরুরি বলে জানান তিনি।
লেখক ও গবেষক মুহম্মদ ফরিদ হাসান বলেন, একটি রাষ্ট্র কেমন আছে তা বুঝা যায় সেই রাষ্ট্রের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান দেখে। সরকার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হরিজনদের আধুনিক আবাসনের ব্যবস্থা করেছে, যা অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এর পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। এতে সামগ্রিকভাবে তাদের যেমন উন্নতি হবে, একই সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পদের সুষম বণ্টন হবে। রাষ্ট্র আরও এগিয়ে যাবে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার ও ইউএনডিপির অর্থায়নে ভবন দুটি নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০২৩ সালে। প্রায় ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় ৮৮টি ফ্ল্যাট। এ ছাড়া নতুন আরও দুটি ভবন নির্মাণের কাজ সহসাই শুরু হবে। চাঁদপুরে প্রায় শত বছর ধরে বসবাস করছে হরিজন সম্প্রদায়ের তিন শতাধিক পরিবার।