যেভাবে গুম করা হয়েছিল, জানালেন সালাউদ্দিন আহমেদ
রাজধানীর উত্তরার একটি বাসা থেকে সাদা পোশাকে অস্ত্রধারীরা তুলে নেয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদকে। হাত বেঁধে, চোখ ঢেকে নিয়ে যাওয়া হয় অজ্ঞাত স্থানে। এখন যাকে সবাই চেনে আয়নাঘর নামে। সেই আয়না ঘরে কাটে ৬১ দিন। তারপর সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঠেলে দেওয়া হয়। অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে ভারতে সালাউদ্দিন আহমেদের বিচার হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পথ ধরে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে ফেরেন গুমের শিকার সালাউদ্দিন আহমেদ। আয়নাঘর থেকে ভারতের বন্দিত্বের দুঃসহ স্মৃতি তুলে ধরেছেন এনটিভির কাছে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাউদ্দিন আহমেদ ২০১৫ সালে দলের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ওই বছর ১০ মার্চ উত্তরার একটি বাসা থেকে সালাউদ্দিনকে তুলে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দেওয়া সদস্যরা। তারপর তাকে আইনের হাতে সোপর্দ না করে গুম করে রাখা হয়। দুমাসেরও বেশি সময় পর পরিবারের সদস্যরা খবর পান সালাউদ্দিন আহমেদ ভারতের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে সালাউদ্দিন আহমদে বলেন, ‘উত্তরার একটি বাসা থেকে আমাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে আমাকে সাদা পোশাকে অস্ত্রধারীরা তুলে নিয়ে যায় চোখ বেধে, হাত বেধে। তারপর পাঁচ ফিট বাই ১০ ফিটের একটি কুঠরিতে বন্দি করে রাখে প্রায় ৬১ দিন। ওখানে খাদ্য দেওয়ার জন্য একটি জায়গা ছিল দরজার নিচ। বাইরে ফ্যান ছিল, আওয়াজ হতো বায়ু সঞ্চালনের জন্য। আমাকে কখনো ওখান থেকে বের করেনি, কেবল রুম পরিষ্কারের জন্য বের করেছিল দরজার বাইরে। প্রতি মুহূর্তে আমি মৃত্যুর জন্য প্রহর গুনছিলাম। আয়নাঘরের যে বর্ণনা, তার চেয়ে কঠিন অবস্থায় আমি ছিলাম।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা ঠেলে ওপারে পাঠালেও অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলায় শিলংএ বন্দিত্বের জীবন কাটাতে হয় সালাউদ্দিন আহমদকে। দীর্ঘ আইন প্রক্রিয়ায় ছাড়াও পান তিনি, কিন্তু দেশে ফিরতে পারেননি। অবশেষ ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ১১ আগষ্ট দেশে ফেরেন।
সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যেদিন আমাকে আয়নাঘর থেকে বের করে নিয়ে গেল, সেদিন দীর্ঘ একটি যাত্রা। চোখ বেধে, হাত বেধে, অনেক কাপড়, অনেক মাস্ক পরে। তারপর শিলংয়ের একটি জায়গায়, এটাকে গলফ মাঠ বলা হয়। সেখানে আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলা হয়, ইউ আর ফ্রি নাও। দীর্ঘ ৯ বছর তিন মাস বা চার মাস হলো, যখন আইনিভাবে দেশে ফেরার চেষ্টা করছিলাম, তখন ভারত সরকার আবার আমার খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করে। সেই আপিল আদালত খালাস করার পর সরকারকে নির্দেশনা দিল যে, এই লোকোকে তার দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য আইনি প্রক্রিয়ায় পাঠান। আমার মতো অনেকেই আমার সহকর্মীদের মধ্যে, রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে, এমনকি সাংবাদিকরাও এই গুমের শিকার হয়েছেন। তারা অনেকেই আমার মতো সৌভাগ্যবান হননি যে বেঁচে আছেন বা তাদের খুঁজে পাওয়া গেছে। আমি অনেক সৌভাগ্যবান, আল্লার দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি।’
ভারতে বন্দি থাকার সময় দলের কাউন্সিলে সালাহউদ্দিন আহমদকে স্থায়ী কমিটির সদস্য করে বিএনপি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার যেনো গুমের ও খুনের বিচারের ব্যবস্থা করে সেই দাবি এই ভুক্তভোগী নেতার।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। যারা গুম হয়ে আছেন, সেসব পরিবারের বেদনা আমার পরিবারকে জিজ্ঞাস করলে আপনারা জানতে পারবেন। যারা এখনো গুম হয়ে আছেন, আপনি তাদের সঙ্গে কথা বলেন। বুঝতে পারবেন। অবর্ণনীয় অসহনীয় দুঃখ-যন্ত্রণা। মানুষ যদি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন, তার দাফন হয়, তাকে স্মরণ করে, কবর জিয়ারত করে। এ সুযোগটাও একজন মানুষের যখন থাকে না, তাদের বেদনা, তাদের পরিবারের বেতনা যে কত চরম হয়, সেটা কোনো ভাষায় বলে ব্যক্ত করা যাবে না। আর এই দেশের মাটিতে ইনশা আল্লাহ, প্রতিটি বিচারবহির্ভূত হত্যা-গুমের বিচার হবে। আয়নাঘরের বন্দিশালা তৈরি করে যারা ভিন্নমতকে দমনের কুশীলব জিয়াউল আহসানের মতো তাদেরও গ্রেপ্তার করে গুমের শিকার ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার দাবি গুমের শিকার সালাহ উদ্দিন আহমদের।