নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর বাংলাদেশের বিরাট ভুল : তুরস্ক
জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করাটা বাংলাদেশের ‘বিরাট ভুল’ বলে মনে করছে তুরস্ক।
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত ড. বুরাক আকচাপার বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ কথা জানিয়েছেন। ড. বুরাক ঢাকাতেও তুরস্কের কূটনৈতিক কার্যক্রম তদারকি করছেন।
বাংলাদেশের নিজস্ব একটি বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে তুরস্ক কেন এত কঠোর অবস্থান নিয়েছে?-এমন প্রশ্নের জবাবে বুরাক জানান, তুরস্কের এই কঠোর অবস্থান সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত। এই ফাঁসি কার্যকর করায় তারা যে ক্ষুব্ধ, সেটা প্রকাশ করাটা তুরস্কের অধিকারের মধ্যেই পড়ে। তুরস্ক নিজামীকে কোনো যুদ্ধাপরাধী নয়, বরং একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেই দেখছে।
বুরাক বলেন, ‘একজন রাজনৈতিক নেতাকে ফাঁসিতে ঝোলানো যে কখনোই সমীচীন নয়’ আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গিটা স্পষ্টভাবে জানানোর প্রয়োজন ছিল। বাংলাদেশের মানুষকে আমরা বন্ধুর মতো, ভাইয়ের মতো ভালোবাসি বলেই তাদের এই বার্তাটা দিতে চেয়েছি যে এভাবে কোনো উদ্দেশ্য সিদ্ধি করা যায় না।’
তুরস্কের রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘তুরস্কের ইতিহাসেও একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে আদালতে বিচার করে তারপর ফাঁসিতে ঝোলানোর নজির আছে। কিন্তু আজও আমরা সেই ফাঁসির জন্য অনুশোচনা করি। এভাবে আসলে কোনো সমাধান হয় না।’ এখানে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত যার কথা বলছেন, সেই আদনান মেন্দেরিসকে সংবিধান লঙ্ঘন করার অপরাধে তুরস্কের একটি সামরিক আদালত মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন আজ থেকে ৫৫ বছর আগে। আর নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল আলবদরের মতো একটি বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়ার, যারা যুদ্ধের সময় খুন, ধর্ষণ বা গণহত্যায় লিপ্ত ছিল। নিজামীর বিচারও হয়েছে একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
এটা কি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ একটা বিষয়ে তুরস্কের হস্তক্ষেপ করার শামিল? এ প্রশ্নের জবাবে ড. আকচাপার বলছেন, ‘কোনো একটা জিনিস যদি আমরা মনে করি বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী, তাহলে আমাদেরও কিন্তু অধিকার আছে তা প্রকাশ করার। আমরা বাংলাদেশকে বন্ধু বলে মনে করি বলেই কিন্তু আমরা মন খুলে কথা বলছি। যাদের আপনি একই পরিবারের সদস্য বলে মনে করেন, তাদের বেলায় কখনো কখনো কিন্তু চুপ করে থাকার চেয়ে বড় প্রতারণা আর কিছু হয় না।’
বাংলাদেশের মানুষের একটা বিরাট অংশ বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করে এসেছেন, বিশেষ করে যুদ্ধের সময় যাঁরা প্রিয়জনদের হারিয়েছেন, তাঁদের সেই অন্যায়ের একটা ক্লোসার দেওয়ার (অবসান) অধিকার বাংলাদেশের এই জনগণের থাকার প্রশ্নটাকে তুরস্ক কীভাবে দেখছে - এই প্রশ্নের জবাবে ড. বুরাক জানান, বাংলাদেশের কী অধিকার আছে না-আছে তা নিয়ে তিনি মন্তব্য করতে চান না। তিনি বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ড এমনিতেই কোনো ভালো সাজা নয়, আর একজন রাজনৈতিক নেতাকে ফাঁসিতে ঝোলানো তো কিছুতেই মানা যায় না। অমুক কারণ কি তমুক কারণ দেখিয়ে একজন রাজনৈতিক নেতাকে যদি হত্যা করা হয়, তাহলে আমাদেরও কিন্তু অবশ্যই ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানানোর অধিকার আছে। তবে প্রশ্নটা শেষ পর্যন্ত অধিকারের নয়। আমাদের মূল কথাটা হলো এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ কিন্তু বিরাট একটা ভুল করেছে।’
এই সাক্ষাৎকারে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত নানাভাবে তাঁর কথার মধ্য দিয়ে এটিই স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, নিজামীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে যেসব অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে সেগুলোকে তাঁরা গুরুত্ব দিতে রাজি নন। তুরস্ক তাঁকে বাংলাদেশের একজন প্রথম সারির রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেই গণ্য করছে, কোনো যুদ্ধাপরাধী বলে মনে করছে না।
তাহলে বাংলাদেশে একাত্তরের যুদ্ধের সময়কার ভিকটিমরা কীভাবে বিচার পাবেন-এমন প্রশ্নের জবাবে আকচাপারের সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার’, অর্থাৎ সময়ের চেয়ে ভালো উপশম আর কিছু হতে পারে না।
১৯৭১ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের জন্য দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীকে গত ১১ মে দিবাগত রাতে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। সেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য বাংলাদেশের সমালোচনা করেছে অনেক দেশই। কিন্তু তুরস্ক যে ভাষা ও ভঙ্গিতে তাদের প্রতিবাদ ব্যক্ত করেছে তা প্রায় নজিরবিহীন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তুরস্ক বাংলাদেশ থেকে তাদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নেওয়ায় আঙ্কারা ও ঢাকার কূটনৈতিক সম্পর্কও এখন হুমকির মুখে।