স্মরণ
বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ, বাংলাদেশই বঙ্গবন্ধু
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন স্থিতধী। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, নিরন্তর একনিষ্ঠতা, অকুতোভয় চারিত্রিক দৃঢ়তা তাঁর নেতৃত্বকে দেশ ও কাল উভয় সীমাকেই অতিক্রম করতে সহায়তা করেছে। মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে তিনি হাজার হাজার বছরের পরাধীন বাঙালি জাতিকে দান করেছেন মুক্তির অমিয় সুধা। তিনিই প্রথম গণমানুষকে দেশপ্রেমে দীক্ষিত করে তুলেছেন। তাঁর নেতৃত্বের প্রতি আপামর জনগণের এতটাই আস্থা ছিল যে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে পাকিস্তান সরকারের কুৎসা রটানো সত্ত্বেও সেই আস্থায় কোনো ছেদ পড়েনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বেশ কিছু বিশেষণ আছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাতির জনক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি, বঙ্গবন্ধু ইত্যাদি। তাঁর নামের সঙ্গে যে বিশেষণগুলো যুক্ত হয়েছে সেগুলো বিশ্লেষণ করলেই প্রতীয়মান হয়, তিনি বাংলাদেশের জন্য কী করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন এক চরিত্র, যাঁকে বাদ দিলে বাংলাদেশ মানচিত্রে কল্পনা করা অসম্ভব। ইতিহাসে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যায়, বাংলা ভূখণ্ড কখনো অনেকগুলো ছোট ছোট জনপদে বিভক্ত ছিল আবার কখনো কখনো বৃহৎ ভারতের অংশ ছিল আবার কখনো ছিল পাকিস্তান মানচিত্রের অংশ। যখন বাংলা ভূখণ্ড বিভাজিত ছিল অনেক জনপদে, কিংবা বৃহৎ ভারতের অংশ ছিল অথবা যুক্ত ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে; সকল বাস্তবতায় বর্তমান বাংলাদেশ ছিল শোষণ আর অধীনতার শিকার। বংশপরম্পরায় কখনো কখনো সুলতানি এবং মোগল সাম্রাজ্যে বাংলার শাসকরা দীর্ঘদিন থাকার কারণে কিছুটা এ দেশীয় হয়ে উঠেছিল। ১৬০০ সালে বাণিজ্য করতে আসা ব্রিটিশরা দেড়শত বছরেই ভারতবর্ষে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে। হাজার বছর ধরে অধীন থাকা বাংলাদেশ ১৯৪৭ সালে এসে পাকিস্তান মানচিত্রে স্থান করে নেয়। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেই পরাধীনতা বজায় ছিল।
ইংরেজদের হাত থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করার জন্য ভারতের জনগণ যখন ঐক্যবদ্ধ হচ্ছিল তখন থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান সক্রিয় রাজনীতি করতেন। ১৯৩৪ সালে যখন তিনি সপ্তম শ্রেণিতে পড়তেন তখন তিনি অসুস্থতাজনিত কারণে অনেক দিন স্কুলে যাননি। সে সময় তিনি স্বদেশি আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ প্রসঙ্গে লিখেছেন ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে- ‘চোখের চিকিৎসার পর মাদারীপুরে ফিরে এলাম, কোনো কাজ নেই। লেখাপড়া নেই, খেলাধুলা নেই, শুধু একটা মাত্র কাজ, বিকালে সভায় যাওয়া। তখন স্বদেশি আন্দোলনের যুগ। মাদারীপুরের পূর্ণ দাস তখন ইংরেজের আতঙ্ক। স্বদেশি আন্দোলন তখন মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের ঘরে ঘরে।’
পাকিস্তান রাষ্ট্র গড়ে ওঠার পরপরই বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ওপর বিমাতাসুলভ আচরণ করতে থাকে। দেশ বিভাগের পরপরই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা না করা এবং উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদে এবং পাকিস্তান সরকারের সমালোচনা করার দায়ে তাঁকে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে কারাবাসে যেতে হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইংরেজমুক্ত যে স্বাধীন দেশ দেখতে চেয়েছিলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই তাঁর অন্তঃসার শূন্যতা উপলব্ধি করলেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর উচ্চকিত কণ্ঠস্বর পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের পর সেপ্টেম্বরে আবারও তাঁকে কারাবাস ভোগ করতে হয়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকার বঞ্চিত চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। অধিকার আদায়ের এ আন্দোলনের কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছাত্রত্ব বাতিল করে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অন্যরা ভবিষ্যতে আর আন্দোলন না করার লিখিত অঙ্গীকার দিয়ে ছাত্রত্ব ফিরে পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ন্যায়ের পথে অনঢ় থাকার স্বার্থে লিখিত দিয়ে ছাত্রত্ব ফিরে পাওয়ার কোনো চেষ্টাই করেননি। সময় যত সামনের দিকে এগিয়েছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার রাজনীতিতে ততটাই প্রভাবক হয়ে উঠেছিলেন।
দেশ বিভাগে অসীম সম্ভাবনার অযুত স্বপ্ন নিয়ে বর্তমান বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার আনন্দে মেতে উঠেছিলেন। সেই আনন্দ অনতিবিলম্বে ফিকে হয়ে আসে। সমস্ত আশা পরিণত হয় হতাশায়। আশাভঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানের সব শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তিনি প্রথমত মানুষদের সংগঠিত করার কাজ করেন। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের যে রাজনৈতিক ইতিহাস, সেই বৃত্তের মধ্যকার বিন্দুর মতো ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রকৃত অর্থে তাঁকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে পাকিস্তান শাসনামলের বাংলার রাজনীতি।
১৯৫৬ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হলে তিনি মন্ত্রিত্ব লাভ করেন। কিন্তু পরের বছরেই দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। এর আগে তিনি ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক সরকারের কৃষি ও বনমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেছিলেন। সেই মন্ত্রিপরিষদ কেন্দ্রীয় সরকার চক্রান্ত করে ভেঙে দেয়। ১৯৫৮ সালে ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রধান আইয়ুব খান রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন। ১১ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এক বছর দুই মাস কারাবাসের পর মুক্তি লাভ করলে তিনি গোপনে ছাত্রদের দিয়ে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বারবার কারা ভোগ করতে থাকেন। যখনই কারাগার থেকে মুক্ত হন, তখনই তিনি পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে থাকেন।
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করে একটি নতুন রাষ্ট্র রচিত হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ঘটনা হচ্ছে ১৯৬৬ সালের উপস্থাপিত ছয় দফা। ছয় দফা ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিতার ফল। মূলত ছয় দফাই একাত্তরে বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করে গড়ে তুলেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শোষিত-বঞ্চিত মানুষের দুঃখানুভূতিকে ধারণ করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সমস্যা সমাধানের মূলমন্ত্র।
পাকিস্তান সরকারের পক্ষে ছয় দফা মেনে নেওয়া ছিল কঠিন। কারণ ছয় দফা মেনে নিলে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কার্যত ঠুটো জগন্নাথে পরিণত হতো। বাংলার ইতিহাস হচ্ছে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একসঙ্গে জীবন-যাপন করা। সে কারণে দেখা যায় দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভাগ হলেও সব হিন্দু যেমন ভারতে চলে যায়নি, আবার সব মুসলমানও তেমনি পাকিস্তানে চলে আসেনি। পূর্ব পাকিস্তানে থাকা সব মানুষকে একত্রিত করার চেষ্টা থেকে ছয় দফা উপস্থাপনের অনেক আগেই আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি তুলে দেওয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ দলটি হয়ে উঠেছিল পূর্ব পাকিস্তানের সব জনগণের।
পাকিস্তানি শোষক শ্রেণি বরাবরই চেষ্টা করেছে ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় থাকতে। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেষ্টা করেছেন মানুষের মধ্যে অধিকার বোধ সৃষ্টি করতে। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তানবাসীকে অধিকারসচেতন করে তোলেন। সত্যিকার অর্থেই ছয় দফা ছিল বাঁচার দাবি।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন নিজের সিদ্ধান্তে অনঢ়। তিনি কোনো দিন কারো তোষামোদ করেননি। ব্যক্তিস্বার্থের বাইরে থেকে তিনি সব সময় দেশস্বার্থ দেখেছেন। ছয় দফা উপস্থাপনের কারণে নিজ দলের অনেক নেতাও তাঁর ওপর মনঃক্ষুণ্ণ ছিলেন। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেননি। পাকিস্তানের হাত থেকে বাংলাদেশের শোষণপ্রক্রিয়া রুখতে হলে শোষিতদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন ছিল। আইয়ুব খান যতই প্রচার করেছে ছয় দফা হচ্ছে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র, ততই ছয় দফার প্রতি শোষিতদের সমর্থন বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ, শোষিতরা যখনই ছয় দফা সম্পর্কে জ্ঞাত হয়েছেন, তখনি তাঁরা মুক্তির বারতা পেয়েছেন সেখানে।
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের এক নম্বর শত্রুতে পরিণত হন। বারংবার তাঁকে জেলে যেতে হয়েছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করে। ছয় দফার প্রতি সমর্থন বাড়ার কারণে বঙ্গবন্ধুর প্রতি গণমানুষের ভালোবাসা তীব্র হয়ে ওঠে। ছয় দফার একটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, এই ছয় দফার মধ্য দিয়ে দেশের আপামর জনগণ দেশকে একটি স্বতন্ত্র মাত্রায় গ্রহণ করতে শিখেছে। ছয় দফাকে দেশপ্রেমের সূতিকাগারও বলা যায়। ভাষা আন্দোলনে ভাষার প্রতি মানুষের আবেগ পল্লবিত হয়েছে। আর ছয় দফার মধ্য দিয়ে ভাবতে শিখেছে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের মুক্তি কোন পথে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র থেকেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। ছয় দফা উপস্থাপন করার পর থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানিদের শক্ত শত্রুতে পরিণত হন। পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে আর কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিল না। তারা যেন বুঝে গেছে বঙ্গবন্ধু কোন পথে হাঁটছেন। সে কারণে ছয় দফা উপস্থাপন করার পর থেকে তাঁকে জেলেই থাকতে হয়েছে। প্রায় ২১ মাস জেলে থাকার পর ১৯৬৮ সালের ২১ জানুয়ারি জেল থেকে ছাড়া পেতে না পেতেই আবার কারাগারে যেতে হয়। কারাগার থেকে বের হতেই তিনি দেখতে পান কারাফটকে সেনাবাহিনী তাঁকে গ্রেফতার করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যারও চেষ্টা করা হয়েছিল। ১৯৬৮ সালের ১৮ জুন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কার্যক্রম শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানিরা হত্যা ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে ছিলেন অন্তরীণ। পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা উপস্থাপন ছিল চরম গর্হিত কাজ। তাই তারা এর বিপক্ষে প্রচারণা চালাতে থাকে। অন্যদিকে খুবই দ্রুত বাংলার গণমানুষের কাছে ছয় দফা ইতিবাচক অর্থে পৌঁছে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে দেশ উত্তাল। প্রতিদিন মিছিলে মিছিলে কম্পিত রাজপথ।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাবাসী থাকা অবস্থায় আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিল। আন্দোলন রূপ নেয় গণ-অভ্যুত্থানে। ষড়যন্ত্রের প্রধান আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দিতে চেয়েছিল। বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া দূরে থাকুক, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাঁকে নিঃশর্ত ছাড়তে বাধ্য হয়।
১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া খান নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রচারণায় ছয় দফার কথা উল্লেখ করেন। ক্ষমতা লাভ করলে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদেও ১১ দফা ও ছয় দফার ভিত্তিতে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার অঙ্গীকার করেন। ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের পালা। কিন্তু ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে গড়িমসি শুরু করেন। ক্ষমতা হস্তান্তরে জুলফিকার আলী ভুট্টোও বিরোধিতা করেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের সভা আহ্বান করেন। ১ মার্চ সেই সভা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন। প্রতিবাদে ৩ মার্চ আওয়ামী লীগ হরতাল আহ্বান করে। অলিখিতভাবে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই চলছিল দেশ। ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে ইয়াহিয়া খানের কালক্ষেপণ দেখে ৭ মার্চ আয়োজন করা হয় এক বিশাল জনসভা। সেই জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণ দেন, তা পৃথিবীর সেরা চারটি ভাষণের একটি হয়ে আছে। সেখানেই মূলত তিনি স্বাধীনতার ডাক দেন। সেখানে তিনি ঘোষণা করেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ৭ মার্চের ভাষণ এখনো শিহরিত করে তোলে। কোনো অতিরঞ্জন নেই, বাহুল্য নেই, পরিমিত এবং অনিবার্য শব্দব্যঞ্জনায় শ্রোতাকে ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ করে তোলে। হাজার বছরের নিপীড়িত জাতির মুক্তির লক্ষ্যে তিনি একের পর এক যেন বাণীবন্দনা করেছেন।
৭ মার্চের ভাষণেই রচিত হয়েছে বাঙালির মুক্তির নির্দেশনা। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির ঝাঁপিয়ে পড়া, জীবন উৎসর্গ করা সবটাই যেন সেই নির্দেশনারই বাস্তবায়ন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একধরনের মন্ত্রমুগ্ধতা ছিল, যা জনগণকে অন্তর্গত বন্ধনে আবদ্ধ করে। তিনি যেন সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট, আশা-আকাঙ্ক্ষা পড়তে পারতেন। সে কারণে তাঁর গণমানুষপন্থী সব বক্তব্যেই সাধারণ মানুষ জেগে উঠতেন।
ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ইয়াহিয়া খান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে আলোচনা ব্যর্থ হয়। ৭ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত এই আলোচনা চলে। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরতম ঘৃণ্য আক্রমণ চালায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ, পিলখানা রাইফেল সদর দপ্তরে তারা এই আক্রমণ শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ শে মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিকে শুধু রাজনৈতিক মুক্তি দান করেননি। ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে মূলত মুক্তি ঘটেছে মানবতার। বঙ্গবন্ধু ছিলেন লোকসংস্কৃতিজাত উদার মানবতাবাদে উজ্জীবিত এবং মহৎ প্রাণের অধিকারী। রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক-ভাষিক সব স্তরেই মুক্তি সাধিত হয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশের জনগণের রাজনীতি করার কোনো স্বাধীনতাই ছিল না। পীড়ন-নির্যাতন-জেল-জুলুম ছিল রাজনীতিবিদদের অলঙ্ঘনীয় নিয়তি। সামজিক সামগ্রিকতায় অধীনতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে নব্য ঔপনিবেশিকতায় যেন আচ্ছন্ন ছিল বাংলা ভূখণ্ড। বাঙালিদের সংস্কৃতিচর্চা ছিল অবরুদ্ধ। রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধঘোষিত ছিল। সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত জীবাণু ছিল পাড়ায়-মহল্লায়। পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল চরম পর্যায়ের। ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ প্রচারপত্র লিখে সেখানে বৈষম্যের সূচকগুলো তুলে ধরা হয়েছিল। ভাষাগত প্রশ্নে বিমাতাসুলভ শত্রুসম আচরণ ছিল দেশ বিভাগের শুরু থেকেই। বিভিন্ন স্তরের এসব শোষণ থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমৃত্যু চেষ্টা করে গেছেন।
বাংলাদেশ নামের যে মানচিত্র আমরা লাভ করেছি, সেই ভূখণ্ডের নামকরণও করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডকে যখন পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ব পাকিস্তান নামকরণ করেন, তখন তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের নাম বাংলা করার প্রস্তাব করেছিলেন। এরপর সময় গড়াতে গড়াতে পাকিস্তানের শোষণের মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করে, পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের বৈষম্য বাড়তে থাকে। পাকিস্তানিদের কদর্য চরিত্র উন্মোচিত হওয়ার পর এবং তাদের সংশোধনের কোনো চেষ্টা পরিলক্ষিত না হওয়ায় বঙ্গবন্ধু যেন অনেকটাই উপলব্ধি করতে পারেন যে স্বাধিকার আন্দোলনে সমস্যা সমাধান হবে না। “১৯৬৯-এর ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে এ ভূখণ্ডের নতুন নামকরণ করলেন ‘বাংলাদেশ’। তিনি বললেন, আমাদের আবাসভূমির নাম হবে পূর্ব পাকিস্তান নয়, তা হবে বাংলাদেশ।”
২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করা হয়। যুদ্ধকালীন তিনি পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন। দুঃসহ এক সময় সেখানে কাটিয়েছেন। যন্ত্রণাদগ্ধ ছিলেন প্রতিটি মুহূর্ত। তাঁকে মৃত্যুর হুমকি দেওয়া হয়েছিল। মৃত্যুভয়ও তাঁকে দোলাচলে ফেলতে পারেনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে আসে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। বঙ্গবন্ধু যেমন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, তেমনি বাঙালিদের জন্য সর্বকালের শ্রেষ্ঠ দিন ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। পাকিস্তানিদের সঙ্গে এ দেশীয় শত্রুরা যদি জোট না করত তাহলে পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের এত বড় ক্ষতি কিছুতেই করতে পারত না।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছিল অনিঃশেষ ত্যাগ। স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর রক্ত মিশেছিল সেই মাটিতে যে মাটি একদিন তিনি কপালে ছুঁয়েছিলেন। ব্যক্তিজীবনের সব সময়টুকুই তিনি নিবেদন করেছিলেন বাংলাদেশ গঠনের জন্য। স্ত্রী-সন্তান-পরিজন কাউকেই তিনি একান্তে সময় দিতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাবার স্মৃতি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বাবাকে একবার গোপালগঞ্জ থানায় আনা হলে দাদার সঙ্গে আমি ও কামাল দেখতে যাই।… ও (কামাল) বাবাকে খুব কাছ থেকে কখনো দেখেনি। আমার কাছেই বাবার গল্প শুনত মুগ্ধ হয়ে। গোপালগঞ্জ জেলখানার কাছে পুকুরপাড়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, বাবাকে নিয়ে যাবে কোর্টে, তখনই আমরা দেখব। কামাল কাছ ঘেঁষে বলল : হাচুপা, তোমার আব্বাকে আব্বা বলতে দেবে?’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ দেশের জন্য পাকিস্তানিদের কাছে কখনোই নত হননি। বারবার হত্যার ষড়যন্ত্র করেও পাকিস্তানি শাসকচক্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারেনি। সেই স্বাধীন দেশেই এ দেশের শত্রুদের হাতে তিনি ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন। বাংলাদেশের ইতিহাসে সৃষ্টি হয় কালো অধ্যায়। মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অমর।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ছাড়া বাংলাদেশের জন্ম সম্ভব হতো না। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যভাবে লিখিত হতো। বাঙালি জাতির অবরুদ্ধ থাকার, অধীন থাকার ইতিহাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতো। বিস্ময়কর নেতৃত্বের প্রতিভা নিয়ে রাজনীতিতে তাঁর অংশগ্রহণ। কৈশোরে জ্বলে ওঠা শেখ মুজিব একদিন হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের পরিপূরক একটি নাম। অসাসাম্য নেতৃত্বগুণে হাজার বছরের পরাধীন জাতিকে তিনি মুক্তির আঙিনায় নিয়ে এসেছেন। আজকের যে বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশ গঠনের এবং বিনির্মাণের প্রধান প্রাণপুরুষ তিনি। সে জন্যই বলা যায় বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ, বাংলাদেশই বঙ্গবন্ধু।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।