আমি মালালা বলছি
‘মাথায় গুলিবিদ্ধ মেয়েটিকে, বার্মিংহাম’
গুলিবিদ্ধ হওয়ার এক সপ্তাহ পরে ১৬ অক্টোবর আমার জ্ঞান ফিরল। আমার বাড়ি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে আমি নিশ্বাসে সাহায্য করার জন্য আমার ঘাড়ে টিউব বসানো এবং আমি কথা বলতে অক্ষম। আরেকটি সিটি স্ক্রিনের পর আবারও আমার নিবিড় পরিচর্যার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে এবং ঠিকমতো জেগে ওঠার আগে আমি ঘুম এবং জাগ্রত অবস্থার মাঝে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম।
জ্ঞান ফেরার পর আমার মাথায় আসা প্রথম চিন্তাটা ছিল, আল্লাহর শোকর আমি মারা যাইনি। কিন্তু আমি কোথায় আছি যে ব্যাপারে কোনো ধারণা ছিল না। আমি জানতাম আমি আমার জন্মভূমিতে নেই। ডাক্তার এবং নার্সরা বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছেন বলে মনে হলেও সবাই ইংরেজিতেই কথা বলছিলেন। আমিও তাঁদের সাথে কথা বলছিলাম কিন্তু ঘাড়ের টিউবটার কারণে কেউ আমাকে শুনতে পাচ্ছিল না। শুরুতে বাম চোখ ঝাপস দেখছিলাম এবং সবাইকে চার চোখের এবং দুই নাকওয়ালা বলে মনে হচ্ছিল। আমার মাথায় প্রশ্নের ঝড় বয়ে গেল, ‘আমি কোথায়? কে আমাকে এখানে এনেছে? বাবা-মা কোথায়? আমার বাবা বেঁচে আছেন কি?’ ভয় পেয়ে গেলাম।
জ্ঞান ফেরার পর ড. ডেভিডকে দেখতে পাই। তিনি বললেন, আমার ভয় পাওয়া চেহারা তিনি কখনোই ভুলবেন না। আমার সাথে তিনি উর্দুতে কলা বললেন। আমি শুধু জানতাম যে আল্লাহ আমাকে নতুন একটা জীবন দিয়েছেন। হিজাব পরিহিতা চমৎকার এক মহিলা আমার হাত ধরে বললেন, আসসালামু আলাইকুম। এরপর তিনি উর্দুতে প্রার্থনা করলেন এবং কোরআনের আয়াত পড়তে শুরু করলেন। তিনি বললেন যে তাঁর নাম রেহানা এবং তিনি এখানকার মুসলিম ধর্মনেতা, তাঁর কণ্ঠে ছিল কোমল এবং কথাগুলো ছিল যন্ত্রণা উপশমকারী, এবং আমি আবারও ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
স্বপ্নে দেখলাম, আমি আসলে হাসপাতালে নেই, পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে জানালাবিহীন এবং উজ্জ্বল আলোর একটি আজব সবুজ কক্ষে আবিষ্কার করলাম। সেটা ছিল কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র। সবই ছিল পরিষ্কার এবং ঝকমকে, মিঙ্গোরার হাসপাতালের মতো নয়।
নার্স আমাকে খাতা ও পেনসিল দিলেন। আমি ঠিকমতো লিখতে পারছিলাম না ভুল লেখা আসতে থাকল। আমি আমার বাবার ফোন নম্বর লিখতে চাইছিলাম। বর্ণের মাঝে ফাঁক দিতে পারছিলাম না। ড. জাভিদ আমাকে বর্ণ নির্বাচন করতে একটি অ্যালফাবেট বোর্ড নিয়ে এলেন। সেখানে আমি বানান করে প্রথম শব্দ দুটো বলেছিলাম।
সেগুলো হলো বাবা এবং দেশ। সেবিকা আমাকে বললেন যে আমি বার্মিংহামে আছি, কিন্তু এই জায়গা সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না এরপর তাঁরা একটি অ্যাটলাস এনে আমাকে ইংল্যান্ড দেখালেন। আমি জানতাম না আমার কী হয়েছিল। নার্সরা আমাকে আমার নামটাও বলছিলেন না। আমি কি এখানে মালালাই আছি?
আমার মাথায় এত ব্যথা হচ্ছিল যে তাঁদের ইনজেকশন আমার ব্যথা থামাতে পারছিল না। আমার বাম কান থেকে রক্ত বেরুচ্ছিল এবং বাম হাতটায় কেমন করতে থাকলেন। নার্সরা আমাকে প্রশ্ন করলেন এবং হ্যাঁ-বোধক উত্তরের জন্য দুবার চোখের পলক ফেলতে বললেন। কেউ আমাকে বলল না যে কী চলছে বা কে আমাকে হাসপাতালে এনেছে। আমি ভাবছিলাম, তারা নিজেদের চেনে না। আমি অনুভব করছিলাম যে আমার মুখের বামপাশটা ঠিকমতো কাজ করছে না। ডাক্তার বা নার্সদের দিকে বেশিক্ষণ একটানা তাকিয়ে থাকলে আমার বাম চোখে পানি আসত। আমার মনে হচ্ছিল বাম কানে কিছু শুনতে পাচ্ছি না। এবং ঠিকমতো চোয়াল নাড়াতে পারছি না। আমি মানুষজনকে ইশারায় বলতাম আমার বামপাশে দাঁড়াতে।
এরপর কদিনের মাঝেই তাঁরা আমার কাছে যেতে পারবেন। কিন্তু তাঁরা কিছুই শুনলেন না। আমার অবস্থা জানার ডা. ফিওনা নামের দয়ালু এক নারী আমাকে একটি সাদা টেডি বিয়ার দিলেন। তিনি বললেন যে আমার উচিত একে জুনাইদ ডাকা এবং কারণটি তিনি পরে বুঝিয়ে দেবেন। জুনাইদ কে তা আমি জানতাম না, তাই আমি টেডির নাম দিলাম লিলি। ডা. ফিওনা আমাকে লেখার জন্য একটি গোলাপি খাতা এনে দিলেন। কলম দিয়ে আমি লিখলাম, কেন আমার বাবা এখানে নেই? এবং আমা বাবার কোনো টাকা-পয়সা নেই। এসবের খরচ কে দেবে?
তোমার বাবা নিরাপদেই আছেন, তিনি উত্তর দিলেন। তিনি পাকিস্তানেই আছেন। আর খরচ নিয়ে তুমি দুশ্চিন্তা করো না।
যেই আসত তাকেই আমি এই প্রশ্নগুলো করতাম। সবাই একই উত্তর দিত। কিন্তু আমি এতে নিশ্চিন্ত হলাম না। আমার সাথে কী ঘটেছে তা আমি জানি না এবং কাউকে আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমার বাবা ভালোই যদি থাকেন তবে এখানে আসেননি কেন। আমি ভাবছিলাম যে আমি কোথায় আছি সেটা আমার বাবা-মা জানেন না, তাঁরা নিশ্চয়ই আমাকে মিঙ্গোরার হাটে-বাজারে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আমার বিশ্বাসই হয়নি তাঁরা নিরাপদে আছেন। শুরুর দিনগুলোয় আমার মন এক স্বপ্নরাজ্যের ভেতরে-বাইরে আসা-যাওয়া করতে থাকল। আমার শুধু একটা দৃশ্যই মনে পড়তে থাকল-আমি আমার শুধু একটা দৃশ্যই মনে পড়তে অগণিত মানুষ আর আমি জিজ্ঞেস করছি, বাবা কোথায়? আমার মনে হচ্ছিল আমি গুলিবিদ্ধ হয়েছি কিন্তু এগুলো কি স্মৃতি নাকি স্বপ্ন, নিশ্চিত ছিলাম না।
চিকিৎসার খরচের চিন্তায় আমি আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। অ্যাওয়ার্ডের অর্থ সব স্কুল আর শাংলায় জমি কেনার পেছনে খরচ হয়ে গেছে। আমি যখনই দেখতাম ডাক্তাররা একে অপরের সাথে কথা বলছেন, তখনই মনে হতো তাঁরা নিশ্চয়ই বলছেন, মালালার কোনো টাকা পয়সা নেই, মালালা ওর চিকিৎসার খরচ পরিশোধ করতে পারবে না। ডাক্তারদের মধ্যে একজন পোলিশ ব্যক্তির চেহারায় একটু দুঃখী ভাব ছিল। আমি মনে করলাম তিনি হাসপাতালের মালিক এবং আমি টাকা পয়সা দিতে না পারায় তার মন খারাপ। তাই আমি ইশারায় এক নার্সের কাছ থেকে কাগজ নিয়ে লিখলাম। আপনার মনে দুঃখ কেন? তিনি উত্তর দিলেন, ‘না তো, আমার মনে তো দুঃখ নেই।’ ‘টাকা দেবে কে?’ আমি লিখলাম। ‘আমাদের তো টাকা নেই’। তুমি দুশ্চিন্তা করো না, তোমাদের সরকার টাকা দেবে’, তিনি জানালেন এর পর থেকে আমার সাথে দেখা হলেই তিনি হাসতেন।
আমি সব সময়ই সমস্যার সমাধান নিয়ে চিন্তা করি, তাই ভাবলাম নিচে হাসপাতালের রিসেপশনে গিয়ে মা বাবাকে কল করার জন্য একটা ফোন চাওয়া যায়। কিন্তু আমার মস্তিষ্ক বলছিল, কলের দাম দেওয়ার অর্থ তোমার নেই, কান্ট্রি কোডও তুমি জানো না। এরপর ভাবলাম, আমাকে এখান থেকে বেরিয়ে কাজ করে অর্থ উপার্জন করতে হবে যাতে একটা ফোন কিনে বাবার সাথে কথা বলে আবার একত্র হতে পারি।
আমার মাথায় সবকিছু তালগোল পাকিয়ে গেল। আমি ভাবছিলাম যে ডা. ফিওনার দেওয়া টেডি বিয়ারটা সবুজ ছিল এবং সেটা বদলে এখন সাদা টেডি দেওয়া হয়েছে। সবুজ টেডি বিয়ারটা কই? আমি জিজ্ঞেস করতেই থাকলাম যদিও আমাকে বলা হচ্ছিল যে কোনো সবুজ টেডি ছিল না। সম্ভবত নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের দেয়ালের ছায়া পড়ে সেটাকে সবুজ দেখাচ্ছিল কিন্তু আমার এখানে মনে হয় একটা সবুজ টেডি সেখানে ছিল।
ভুলে যাওয়া ইংরেজি শব্দগুলো মনে করার চেষ্টা করতে শুরু করি একসময়। নার্সদের দেওয়া আমার একটা চিরকুটে ছিল দাঁত পরিষ্কার করার জন্য একটা তার। আমার মনে হচ্ছিল দাঁতের ফাঁকে কিছু একটা আটকে আছে এবং আমি ফ্লস চাইছিলাম। আসলে আমার জিভ অবশ ছিল। দাঁত ঠিকই ছিল। আমার শান্তি লাগত কেবল রেহানা এলে। তিনি আরোগ্য লাভেল দোয়া পড়তেন। কিছু কিছু অংশে আমি ঠোঁট নাড়াতাম এবং শেষে আমিন (আমরা আমেন কে আমিন বলি) বলতাম। আমি মিঙ্গোরায় মাস্টারশেফ দেখতে পছন্দ করতাম, টিভি সব সময় বন্ধ রাখা হলেও মাস্টারশেফ চলার সময় খোলা হতো কিন্তু আমি সব ঝাপসা দেখতাম, পরে আমি জেনেছিলাম যে আমার কাছে কারো কোনো খবরের কাগজ আনা বা কোনোকিছু জানানো নিষেধ ছিল। কারণ এর ফলে আমার স্নায়বিক আঘাত পাওয়ার আশঙ্কা ছিল।
আমি আতঙ্কিত ছিলাম, কারণ আমার বাবা মৃতও হতে পারেন। তখন ফিওনা গত সপ্তাহের একটি পাকিস্তানি খবরের কাগজ আনলেন, সেখানে আমার বাবা জেনারেল কায়ানির সাথে কথা বলছেন আর পেছনে আমার ভাইয়ের পাশে চাদর পরিহিত এক অবয়ব বসা। আমি শুধু তাঁর পা দেখতে পারছিলাম। এটা আমার মা। আমি লিখলাম।
সে দিনই পরের দিকে ডা. জাভিদ তাঁর মোবাইল ফোন দিয়ে এলেন। আমরা তোমার বাবা-মাকে ফোন করার চেষ্টা করছি। তিনি জানালেন। উত্তেজনায় আমার চোখ চকচক করে উঠল। তুমি কাঁদবে না, ফোঁপাবে না, তিনি নির্দেশ দিলেন। তিনি বদমেজাজি হলেও খুব দয়ালু ছিলেন, যেন আমার চিরচেনা। আমি তোমাকে মোবাইলটা দেব, তুমি শক্ত থাকবে, আমি মাথা নাড়ালাম। তিনি নম্বরটা ডায়াল করে কথা বলে ফোনটা আমাকে দিলেন।
বাবার কণ্ঠ, ঘাড়ের টিউবটার কারণে কথা বলতে না পারলেও তাঁর কণ্ঠ শুনতে পেরে খুব খুশি হয়েছিলাম। আমার চেহারার কারণে হাসতে না পারলেও ভেতরে আনন্দ হচ্ছিল। তিনি বললেন, ‘বিশ্রাম নাও, আমরা দুদিনের মধ্যেই চলে আসব।’ পরে বাবা-মা আমাকে ক্লান্ত করে দিতে চাননি। মা আমাকে দোয়া দিয়ে আশীর্বাদ করে দিলেন।
আমি তখনো অনুমান করছিলাম যে আমার চিকিৎসায় অর্থ না থাকায় বাবা আমার কাছে আসছেন না। তাই আমাদের গ্রামের জমি এবং স্কুলটা বিক্রি করার জন্যই তিনি পাকিস্তানে থেকে গেছেন। কিন্তু আমাদের জমিটা ছোট আর স্কুল এবং বাড়ির ভবনগুলো ছিল ভাড়া করা, তাহলে তিনি কী বিক্রি করবেন? হয়তো তিনি ধনী লোকদের কাছ থেকে ঋণ চাইছেন।
কলের পরও আমার বাবা-মা পুরোপুরি আশ্বস্ত হলেন না। তারা সত্যিকার অর্থে আমার কণ্ঠ শোনেননি এবং তখনো বাইরের দুনিয়ার সাথে তাঁদের যোগাযোগ ছিল না। তাঁদের সাথে দেখা করতে আসা লোকজনের মধ্যে ছিলেন সোয়াতে তালেবানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সামরিক অভিযানের প্রধান জেনারেল গুলাম ক্বামার। যুক্তরাজ্য থেকে ভালো খবর আসছে। তিনি আমার বাবাকে বললেন, ‘আমাদের মেয়ে বেঁচে যাওয়ায় আমরা খুবই খুশি।’ তিনি আমাদের শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন কারণ তখন আমাকে জাতির কন্যা হিসেবে দেখা হচ্ছিল।
জেনারেল বাবাকে বলেছিলেন যে তাঁরা সোয়াতে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছেন এবং সীমান্ত পর্যবেক্ষণ করছেন। তাঁরা জেনেছেন যে আমাকে টার্গেট করা লোকগুলো বাইশজন তালেবানের একটি দলের সদস্য এবং এরাই দুই মাস আগে গুলিবিদ্ধ হওয়া আমার বাবার বন্ধু জাহিদ খানের ওপর আক্রমণ করেছিল।
বাবা কিছু না বললেও ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড রেগে ছিলেন। সেনাবাহিনী বহুদিন ধরেই বলে আসছে যে মিঙ্গোরায় কোনো তালেবান নেই, তারা সবাইকে শেষ করে ফেলেছে। এখন এই জেনারেল বলছেন যে অন্তত দুই মাস ধরে বাইশজন তালেবান সেখানে থেকেছে। আর্মি আরো বলেছিল যে জাহিদ খান তালেবান নয় বরং পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এখন তারা বলছে যে তাঁকে যারা আক্রমণ করেছে সেই একই তালেবানরাই আমাকে আক্রমণ করেছে। বাবা বলতে চাইলেন, আপনারা জানতেন দুই মাস ধরে উপত্যকায় তালেবান থাকত। আপনারা জানতেন তারা আমার মেয়েকে হত্যা করতে চেয়েছে আর তাদের থামানোর কোনো চেষ্টাই আপনারা করেননি? কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন, এতে কোনো লাভই হবে না।
জেনারেলের কথা শেষ হয়নি। তিনি বাবাকে জানালেন, আমার জ্ঞান ফেরাটা সুখবর হলেও আমার দৃষ্টিশক্তির কিছু সমস্যা আছে। বাবা বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন। তাঁর কাছে যে তথ্য নেই তা এই কর্মকর্তার কাছে কীভাবে এসেছে? তাঁর দুশ্চিন্তা হলো যে আমি অন্ধ হয়ে যাব। তিনি কল্পনা করলেন, তাঁর প্রাণপ্রিয় মেয়ে আলোকিত মুখ নিয়ে অন্তহীন আঁধারে হেঁটে হেঁটে জিজ্ঞেস করছে, ‘বাবা, আমি কোথায়?’ এই ভয়ংকর খবর তিনি মাকেও জানাতে পারলেন না যদিও তিনি কথা গোপন রাখার মাঝে কোনো আশা খুঁজে পান না, বিশেষত মায়ের কাছ থেকে। বরং তিনি আল্লাহকে বললেন, এটা অগ্রহণযোগ্য। আমি আমার নিজের চোখ দুটোর একটি তাকে দিয়ে দেব। তখনই তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন, তেতাল্লিশ বছর বয়সে তাঁর নিজের চোখ খুব ভালো নাও থাকতে পারে। সে রাতে প্রায় ঘুমাতেই পারলেন না। পরদিন সকালে তিনি নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মেজরের কাছে কর্নেল জুনাইদকে ফোন করার জন্য তাঁর ফোনটা চাইলেন। ‘আমি শুনেছি মালালা দেখতে পায় না’, তিনি বিপর্যস্ত অবস্থায় বললেন।
এসব অবান্তর কথা, মেজর উত্তর দিলেন সে লিখতে পড়তে পারলে না। দেখে কীভাবে? ডা. ফিওনা আমাকে সব খরবাখবর দিচ্ছেন, এবং মালালার লেখা প্রথম চিরকুটগুলোর মাঝে একটা ছিল আপনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা।
বহুদূরে বার্মিংহামে আমি যে শুধু দেখতেই তা না, আমি আয়না চাইছিলাম। ‘আয়না,’ আমি গোলাপি ডায়েরিতে লিখলাম- আয়নায় আমি আমার মুখ এবং চুল দেখতে চাইছিলাম। নার্সরা তখন আমাকে ছোট্ট একটা সাদা আয়না এনে দিলেন, যেটা আমার এখানে আছে। নিজের অবস্থা দেখে আমি বিহ্বল হয়ে গেলাম। আমার দীর্ঘ কেশ, যা নিয়ে স্টাইল করতে আমি লম্বা সময় কাটাতাম সব চলে গেছে এবং মাথার বা পাশে কোনো চুলই ছিল না। এখন আমার চুল ছোট, আমি ওই খাতায় লিখতাম। আমি মনে করেছিলাম, তালেবানরা আমার চুল কেটে দিয়েছে। আসলে পাকিস্তানি ডাক্তাররা নির্দয়ভাবে আমাকে দেখে মনে হচ্ছিল কেউ যেন এটা টেনে একপাশে নামিয়ে দিয়েছে, আর বাম চোখের পামে একটা গভীর দাগ ছিল।
আমার এ অবস্থা কে করেছে? আমি লিখলাম, তখনো আমি বর্ণগুলো উল্টাপাল্টাভাবে লিখছি। ‘আমার কী হয়েছে?’ উজ্জ্বল আলোয় আমার মাথাব্যথা হওয়ায় আমি লিখলাম, ‘লাইট নেভাও।’
‘তোমার খারাপ কিছু হয়েছে,’ ডা. ফিওনা বললেন। ‘আমাকে কি গুলি করা হয়েছিল? আমার বাবাকে কি গুলি করা হয়েছিল?’ আমি লিখলাম।
তিনি আমাকে বললেন যে আমি স্কুলবাসে গুলিবিদ্ধ হয়েছি। আমার দুজন বন্ধুও আমার সাথেই গুলিবিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু আমি তাদের নাম শুনে চিনতে পারলাম না। তিনি আমাকে বোঝালেন বুলেটটা আমার বাম চোখের পাশে যে দাগ আছে সেখানে দিয়ে ঢুকে বাম কাঁদের দিকে আঠারো ইঞ্চি ভেতরে গিয়ে থেমেছে। সেটার কারণে আমার চোখ বেরিয়ে আসতে পারত বা মগজেও ঢুকে পারত। আমার বেঁচে থাকাটা এক অলৌকিক ব্যাপার।
আমার কোনো অনুভূতিই ছিল না, হয়তো কিছুটা সন্তুষ্টি এসেছিল। তাহলে তারা কাজটা করেছিল, আমার একমাত্র আক্ষেপ ছিল তারা গুলি করার আগে তাদের সাথে একটা কথা বলারও সুযোগ পাইনি, এখন তারা কখনোই শুনবে না। আমি কী বলতে চেয়েছিলাম যে আমাকে গুলি করেছে, তাকে নিয়ে আমার মাথায় একটা খারাপ চিন্তাও আসেনি, প্রতিশোধের কোনো ভাবনাও আসেনি। আমি চেয়েছিলাম বাড়ি যেতে।
এরপর আমার মাথায় নানান চিন্তা ভেসে বেড়াতে থাকল কিন্তু কোনটা স্বপ্ন আর কোনটা বাস্তব সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। গুলিবিদ্ধ হওয়ার যে ঘটনাটা আমার মনে পড়ে সেটার সাথে আসল ঘটনার অনেক পার্থক্য। আমি আমার বাবা এবং বন্ধুদের নিয়ে গুল নামের আরেকটি মেয়ের সাথে আরেকটি স্কুলবাসে ছিলাম। বাসায় যাওয়ার পথে হঠাৎ কালো কাপড় পরা দুজন তালেবানের আবির্ভাব হলো। একজন আমার মাথায় একটা বন্দুক ধরল আর ছোট্ট একটা বুলেট আমার দেহে প্রবেশ করল। স্বপ্ন অনুযায়ী আমার বাবাও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এরপর সব অন্ধকার, আমি স্ট্রেচারে শুয়ে আছি। চারপাশে অনেক অনেক মানুষ আর আমার চোখ দুটো বাবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। অবশেষে তাঁর দেখা পেয়ে কথা বলার চেষ্টা করলাম কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছিল না। আবার অন্যান্য সময় মনে হয় আমি ইসলামাবাদের জিন্নাহ মার্কেটে বা চীনাবাজারের মতো নানা জায়গায় গুলিবিদ্ধ হয়েছি। আমি এমনকি এটাও স্বপ্ন দেখলাম যে ডাক্তাররাও তালেবান।
আমার সংজ্ঞা যত বাড়ল ততই বিস্তারিত জানতে চাইতাম। ভেতরে আসা লোকজনের মোবাইল আনা নিষিদ্ধ হলেও জরুরি বিভাগের ডাক্তার হওয়ায় ডা. ফিওনা সব সময় তাঁর আইফোন সাথে রাখতেন। তিনি ওটা নামিয়ে রাখতেই, আমি নিজের নাম লিখে গুগলে সার্চ দেওয়ার চেষ্টা করলাম, আমি ভুল বর্ণে চাপ দিচ্ছিলাম, কারণ সবকিছু দুটো দুটো করে দেখছিলাম আমি। নিজের ইমেইলটাও খুলে দেখার ইচ্ছা ছিল কিন্তু পাসওয়ার্ডটা মনে পড়ছিল না।
পঞ্চম দিনে আমি কণ্ঠ ফিরে পেলাম কিন্তু সেটা অন্য কারো কণ্ঠ বলে মনে হচ্ছিল না। রেহানা এলে আমরা ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে গুলি করার ঘটনাটা বিশ্লেষণ করতে লাগলাম। তারা আমাকে গুলি করেছে, আমি তাকে বললাম।
‘হ্যাঁ’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘মুসলিমদের জগতের অনেক মানুষ বিশ্বাসই করতে পারছে না যে একজন মুসলিম এ ধরনের কাজ করতে পারে’। উদাহরণস্বরূপ, আমার মা বলতেন যে এরা মুসলিম হতেই পারে না। কেউ কেউ নিজেদের মুসলিম বলে দাবি করলেও তাদের কাজকর্ম মুসলিমদের মতো নয়। কোনো ঘটনার বিভিন্ন কারণ সম্পর্কে আমরা কথা বললাম, আমার সাথে কী ঘটেছে এবং ইসলামে যে শুধু পুরুষ নয় বরং নারীদেরও শিক্ষার অধিকার দেওয়া হয়েছে সে ব্যাপারে ও কথা বললাম। মুসলিম নারী হিসেবে আমার স্কুলে যাওয়ার অধিকারের কথা নিয়েই আমি সরব হয়ে উঠছিলাম। কণ্ঠ ফিরে পেয়েই আমি ডা. জাভিদের ফোনে বাবা-মায়ের সাথে কথা বললাম। আমি চিন্তিত ছিলাম আমার গলা অন্যরকম শোনাচ্ছে কি না। আমার গলা কি অন্যরকম শোনাচ্ছে? আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম।
‘না’ তিনি বললেন। তোমার কণ্ঠ আগের মতোই আছে এবং এর উন্নতি ঘটবে। ‘তুমি কি ঠিক আছ?’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
‘হ্যাঁ’ আমি জবাব দিলাম কিন্তু মাথাব্যথাটা খুব ভয়ানক, আমার সহ্যই হচ্ছে না।
আমার বাবা সত্যিই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। আমার মনে হলো, তিনি আমার চেয়ে বড় মাথাব্যথা নিয়ে কথা শেষ করলেন। পরের কলগুলোতেও তিনি জিজ্ঞেস করতেন, ‘মাথাব্যথা কি বাড়ছে না কমছে?’
এর পর থেকে আমি তাঁকে বলতাম, ‘আমি ভালোই আছি।’ আমি তাঁর মন খারাপ করাতে চাইনি এবং তারা যখন ঘাড়ে বড় বড় ইনজেকশন দিল তখনো কোনো অভিযোগ করিনি। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘আপনারা কবে আসছেন?’ তখন তাঁরা রাওয়ালপিন্ডির হাসপাতালের সেনা হোস্টেলে আটকা পড়ে ছিলেন এবং কবে বার্মিংহাম আসবেন সে ব্যাপারে কোনো তথ্যই পাচ্ছিল না। মা এতই মরিয়া হয়ে গেলেন যে বাবাকে বললেন, কালকের মধ্যেই যদি কোনো খবর না আসে তাহলে আমি অনশনে যাব। সেদিনই বাবা নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মেজরের কাছে গিয়ে একথা জানালেন। মেজরকে দেখে মনে হলো তিনি সতর্ক হয়ে গেছেন। দশ মিনিটের মধ্যে বাবাকে বলা হলো যে সেদিনই তাঁদের ইসলামাবাদ নেওয়ার ব্যবস্থা হবে। আসলেই কি সেখানে সবকিছুই ব্যবস্থা করতে পারবে তারা?
বাবা মায়ের কাছে ফিরেই বললেন, তুমি একজন মহান নারী। এতদিনে আমি ভাবতাম আমি আর মালালাই অভিযান করে যাচ্ছি কিন্তু সত্যিকার অর্থে তুমিই জানো কীভাবে প্রতিবাদ করতে হয়।
তাঁদেরকে ইসলামাবাদের কাশ্মীর হাউসে স্থানান্তর করা হলো, সেটা ছিল সংসদ সদস্যদের হোস্টেল। নিরাপত্তা তখনো এত বড় ছিল যে বাবা একবার নাপিতের কাছে শেভ করাতে গেলে সারাক্ষণই একজন পুলিশ বসে বসে নজর রাখছিলেন যে নাপিত যাতে তাঁর গলা কেটে না দেয়।
অন্তত তাঁরা তাঁদের মোবাইল ফেরত পেয়েছেন এবং আমরা আরো সহজে কথা বলতে পারছি। প্রতিবার ডা. জাভিদ আগেভাগে আমার বাবাকে ফোন করে জানিয়ে দিতেন তিনি তখন আমার সাথে কথা বলতে পারবেন এবং নিশ্চিত হতেন তিনি ফ্রি আছেন। কিন্তু ডাক্তার যখনই ফোন করতেন বাবার ফোন তখনই ব্যস্ত থাকত। বাবা সারাক্ষণই ফোনে নম্বরটা চাপতেই ডা. জাভিদের মুখে বিস্ময় দেখা দিল, তখনই তিনি বুঝতে পারলেন আমার স্মৃতিশক্তি ভালোই আছে। কিন্তু আমার বাবা-মা তখনো বুঝতে পারছিলেন না কেন তারা আমার কাছে আসতে পারছেন না। তাঁদের না আসার ব্যাপারে ডা. জাভিদও ধাঁধায় ছিলেন। তাঁরা যখন বললেন যে তাঁরাও জানেন না, তখন ডা. জাভিদ একটা ফোনকল করে নিশ্চিত হয়ে তাঁদের জানালেন যে সেনাবাহিনীতে নয়, সমস্যাটা বেসামরিক সরকারেই।
পরে জানা গেল, আমার বাবা-মাকে অসুস্থ মেয়ের সাথে দেখা করানোর জন্য বার্মিংহামের প্রথম ফ্লাইটের ব্যবস্থা করাতে যতটা না সময় লেগেছে তার চাইতে বেশি সময় লেগেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রেহমান মালিককে তাঁদের সাথে একই ফ্লাইটে আনার ব্যবস্থা করায়। তিনি হাসপাতালে একটি সংবাদ সম্মেলন যোগ দেওয়ার জন্য আসতে চাইছিলেন। তাঁকে এটাও নিশ্চিত করতে হচ্ছিল যে, আমার বাবা-মা ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইছেন না। এটা তাঁর সরকারের জন্য বিব্রতকর। অবশেষে তিনি তাদের খোলাখুলিভাবে জিজ্ঞেস করলেন, তাঁদের পরিকল্পনায় এটা আছে কি না। সেটা খুবই হাস্যকর ছিল কারণ রাজনৈতিক আশ্রয়ের ব্যাপারটা সম্পর্কে আমার মায়ের কোনো ধারণাই ছিল না। আর বাবা কখনো এই কথা মাথাতেই আনেননি, তাঁর আরো অনেক বিষয় নিয়েই মাথা ঘামানোর ছিল।
কাশ্মীর হাউসে যাওয়ার পর আমাদেরকে ইসলামাবাদ সফরে নিয়ে যাওয়া বন্ধু শিজা শাহিদের মা সোনিয়া শাহিদ আমার মা-বাবার সাথে দেখা করতে এলেন। তিনি ভেবেছিলেন তাঁরা আমার সাথে যুক্তরাজ্যে চলে গেছেন, কিন্তু যখন দেখলেন তাঁরা এখনো পাকিস্তানেই আছেন। তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তাঁরা বললেন যে তাঁদেরকে বলা হয়েছে, বার্মিংহাম ফ্লাইটের কোনো টিকেট নেই। তাঁরা সবকিছু সোয়াতে ফেলে এসেছিলেন তাই সোনিয়া তাঁদের জামাকাপড় এনে দেন এবং প্রেসিডেন্ট জারদারির কার্যালয়ের ফোন নম্বর জোগাড় করে দেন। বাবা ফোন করেন এবং একটি বার্তা পাঠান। সেই রাতে প্রেসিডেন্ট তাঁকে ফোন করেন করেন এবং সবকিছু সমাধান করে দেওয়ার কথা দেন। নিজের কারাগারের থাকার দিনগুলোর কথা স্মরণ করে তিনি বললেন, ‘আমি জানি সন্তানদের থেকে দূরে থাকতে কেমন লাগে।’
যখন শুনলাম বাবা-মা দুদিনের মধ্যেই বার্মিংহাম পৌঁছাবেন তখন আমি তাঁদের একটি অনুরোধ করলাম, ‘আমার স্কুলব্যাগটা এনো,’ আমি আমার বাবাকে অনুনয় করলাম। যদি ওটা আনার জন্য সোয়াতে যেতে না পারো, তাতে সমস্যা নেই- নতুন বই কিনে এনো কারণ মার্চ মাসে আমার বোর্ড পরীক্ষা। অবশ্যই আমি ক্লাসে প্রথম হতে চেয়েছিলাম আমি বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞান বইটা চেয়েছিলাম কারণ পদার্থবিজ্ঞান কঠিন, আর আমার সংখ্যা সূচকগুলো চর্চা করে দরকার ছিল কারণ আমি অঙ্কে ভালো নই এবং সমাধান করতে বেশ ঝামেলা হয়।
মনে করলাম, নভেম্বরের মধ্যেই বাড়ি ফিরতে পারব।
বাবা-মা আসার আগে হাসপাতালে আমি দশ দিন কাটিয়েছিলাম। তাঁদের ছাড়া এই দশ দিন আমার কাছে একশ দিন মনে হচ্ছিল। খুব একঘেয়ে লাগত আর আমার ভালো ঘুম হতো না। আমার ঘরের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। নার্সরা আমাকে আশ্বস্ত করত যে আমি বেঁচে আছি এবং জীবনে প্রথমবারের মতো দেখলাম আমি সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠছি। প্রতিদিন আমি নার্সদের আসার নির্দিষ্ট সময় সকাল ৭টার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। কুইন এলিজাবেথ হসপিটাল শিশু হাসপাতাল নয়, তাই তাঁরা গেমসের জন্য একজন ক্রীড়া সমন্বয়কারীকে আনলেন। আমার প্রিয় গেমগুলোর একটি ছিল কানেক্ট ৪। ডা. ফিওনার সঙ্গে সাধারণত ড্র করলেও আমি সবাইকেই হারাতে পারতাম। পরিবার থেকে অনেক দূরে ভিনদেশে থাকা এই আমার জন্য নার্স এবং হাসপাতালের কর্মীরা দুঃখবোধ করতেন এবং খুবই দয়ালু ছিলেন, বিশেষত অস্ত্রোপচারগুলো হাসিখুশি পরিচালক ঈমা চৌধুরী এবং আমার হাত ধরে যিনি বসে থাকতেন, প্রধান নার্স জুলি ট্রেসি।
পাকিস্তানের একমাত্র যে জিনিসটি আমার কাছে ছিল তা হলো বাদামি রঙের একটি চাদর, যা ডা. জাভিদ আমাকে উপহার দেওয়ার জন্য ডা. ফিওনার দিয়েছিলেন, তাই তাঁরা আমার জন্য কাপড়চোপড়ও কিনে দিলেন। আমি কতটা রক্ষণশীল বা সোয়াত উপত্যকার একটি কিশোরী মেয়ে কি পোশাক পরত সে ব্যাপারে তাঁদের কোনো ধারণাই ছিল না। তাঁরা নেক্সট এবং ব্রিটিশ হোম স্টোরস থেকে ব্যাগভর্তি টি শার্ট, পায়জামা, মোজা এমনকি ব্রা নিয়ে ফিরলেন। ঈমা চৌধুরী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি সালোয়ার কামিজ পরব কি না, আমি মাথা নাড়ালাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার পছন্দের রং কী? অবশ্যই আমার উত্তর ছিল গোলাপি।
তাঁরা দুশ্চিন্তা করছিলেন কারণ আমি খাচ্ছিলাম না। কিন্তু আমি হাসপাতালের খাবারটা পছন্দ করতাম না এবং ভাবনা হলো এগুলো হালাল কি না। সেখানে আমি কেবল পুষ্টিকর মিল্ক শেক খেতাম। নার্স জুলি আবিষ্কার করলেন আমি কী কী পছন্দ করি, সেগুলোই তিনি এনে দিতেন। তাঁরা আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, ‘তুমি কী পছন্দ করো?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘ফ্রায়েড চিকেন’। ঈমা স্মল হেলথে একটা হালাল কেনটাকি ফ্রায়েড চিকেন খুঁজে বের করে সেখান থেকে প্রতি বিকেলে আমার জন্য মুরগির মাংস আর চিপস কিনে দিতেন। একদিন তিনি আমার জন্য একটা তরকারিও রেঁধেছিলেন।
আমাকে ব্যস্ত রাখতে তাঁরা একটি ডিভিডি প্লেয়ার কিনেছিলেন। প্রথম কয়েকটি চলচ্চিত্রের একটি ছিল ‘বেন্ড ইট লাইক বেকহাম’। তারা ভেবেছিলেন ঐতিহ্যগত সংস্কারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ফুটবল খেলা এক শিখ মেয়ের কাহিনী আমাকে প্রভাবিত করবে। মেয়েগুলো যখন অনুশীলনের জন্য শার্ট খুলে স্পোর্টস ব্রা পরেই অনুশীলনের জন্য নামল, তখন আমি এতই হতভম্ব হয়ে গেলাম যে নার্সদের দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সেটা বন্ধ করিয়ে দিলাম। এর পর থেকে তাঁরা আমার জন্য কার্টুন আর ডিজনির ছবি আনতেন। আমি শ্রেকের তিনটি ছবি দেখলাম আর দেখলাম ‘আ শার্কস টেল’। বাম চোখে তখনো ঝাপসা দেখতাম, তাই দেখার সময় সেটা ঢেকে রাখতাম, বাম কান দিয়ে রক্ত ঝরত তাই তুলা এবং পশমের কাপড় কানে দিয়ে রাখতে হতো। একদিন আমি এক নার্সের হাত আমার পেটে রেখে জিজ্ঞেস করলাম। এই পিণ্ডটা কিসের? আমার পেটটা ছিল বড় আর শক্ত, কেন তা আমি জানতাম না। ‘এটা তোমার খুলির ওপরের অংশ তিনি উত্তর দিলেন’। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।
কথা বলা শুরু করার পর আমি হাঁটতেও শুরু করলাম। বিছানায় হাত-পা নিয়ে আমি কোনো সমস্যা বোধ করিনি, শুধু বাম হাতটা ছিল অবশ, কারণ বুলেটটা আমার বাম কাঁধে গিয়ে থেমেছিল, তাই আমি যে ভালোভাবে হাঁটতে পারব না। সেটা বুঝিনি প্রথম কয়েকটি পদক্ষেপ এত কঠিন ছিল যে মনে হলে আমি যেন একশ কিলোমিটার দৌড়ে এসেছি। ডাক্তাররা বললেন যে আমি ভালো হয়ে যাব, কেবল পেশিগুলোকে সচল করার জন্য অনেক ফিজিওথেরাপি দরকার।
একদিন ফিওনা অ্যালেকজান্ডার নামে আরেক ফিওনা এসে আমাকে বললেন তিনি হাসপাতালের প্রেস অফিসের দায়িত্বে আছেন। আমার কাছে এটা খুব মজার মনে হলো। আমার কল্পনাতেই আসছিল না যে সোয়াতে সেন্ট্রাল হসপিটালে প্রেস অফিস থাকলে কেমন হবে। তিনি আসার আগে আমি জানতানই না আমাকে নিয়ে কী আলোড়ন হয়েছে। পাকিস্তান ছেড়ে আসার সময় আমার হওয়ার কথা ছিল লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা একটি খবর, কিন্তু আমার পাকিস্তান ছেড়ে যুক্তরাজ্যের যাওয়ার ছবি ফাঁস হয়ে যায় এবং মিডিয়া দ্রুতই বের করে ফেলে আমার গন্তব্য বার্মিংহাম। স্কাই নিউজ-এর হেলিকপ্টার মাথার ওপর চক্কর দিচ্ছিল, এবং অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মতো দূরের দেশ থেকেও মোটমাট প্রায় ২৫০ জন সাংবাদিক এসেছিলেন। ফিওনা অ্যালেকজান্ডার নিজে বিশ বছর সাংবাদিক ছিলেন এবং বার্মিংহাম পোস্টের সম্পাদক ছিলেন, তাই তিনিই সঠিকভাবে জানালেন কোন কথাটা বললে তারা ভেতরে আসার চেষ্টা বন্ধ করবে। আমার অবস্থার ওপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দৈনিক ব্রিফিং দেওয়া শুরু করল।
মানুষ আমাকে দেখতে চাওয়া শুরু করল, সরকারের কূটনৈতিক, রাজনীতিবিদ এমনকি ক্যান্টারবেরির আর্চবিশপের এক বিশেষ বার্তাবাহক। বেশির ভাগই ফুলের তোড়া আনতেন, এর মধ্যে কোনোটা হতো অপরূপ সুন্দর। একদিন ফিওনা আলেকজান্ডার আমার জন্য এক ব্যাগ কার্ড, খেলনা ও ছবি আনলেন। তখন ছিল ঈদুল আজহা বা বড় ঈদ, আমাদের মুসলিমদের হয়তো প্রধান ধর্মীয় উৎসব, তাই ভাবলাম কোনো মুসলিম হয়তো পাঠিয়েছে। তখন পোস্টেজের তারিখ দেখলাম ১০, ১১ অক্টোবর, বহুদিন আগের। তাই বুঝলাম ঈদ সংক্রান্ত কিছুই না, সারা বিশ্বের মানুষ যাদের অনেকেই স্কুলের শিক্ষার্থী, আমার দ্রুত আরোগ্য লাভের জন্য দোয়া করে এসব পাঠিয়েছে। আমার বিস্ময় দেখে ফিওনা হাসলেন। তুমি এখনো কিছুই দেখোনি। তিনি বললেন, ‘আরো বস্তা বস্তা, প্রায় মোট আট হাজার কার্ড আছে, কয়েকটার কেবল লেখা ‘মালালা, বার্মিংহাম’। একটাতে লেখা, ‘মাথায় গুলিবিদ্ধ মেয়েটিকে, বার্হিংহাম’। আমাকে দত্তক নেওয়ার প্রস্তাবও ছিল, যেন আমি পরিবারবিহীন, এমনকি একটা বিয়ের প্রস্তাবও ছিল।
রেহানা জানালেন যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ মানুষ এবং শিশুরা আমাকে সমর্থন করেছে এবং আমার জীবন রক্ষার্থে প্রার্থনা করেছে। আমি শুধু এই কারণেই বেঁচে গেছি। অন্যান্য উপহারও এসেছে। চকলেটের বাক্স এবং বিভিন্ন আকারের টেডি বিয়ার। সম্ভবত বেনজির ভুট্টোর দুই ছেলে বিলাওয়াল এবং বখতাওয়ারের কাছ থেকে মূল্যবান একটি পার্সেলও এসেছিল। তাঁরা তাঁদের পরলোকগত মায়ের ব্যবহৃত দুটো চাদর পাঠিয়েছেন। তাঁর সুবাস পেতে চাদরে আমি নাক ডুবিয়ে দিলাম। পরে আমি একটা চাদরে একটি লম্বা কালো চুল খুঁজে পেয়েছিলাম। যেটা ওই চাদরের বিশেষত্ব আরো বাড়িয়ে দেয়।
আমি বুঝতে পারলাম তালেবানরা আসলে আমার অভিযানটাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছে। নতুন পৃথিবীতে প্রথম পা ফেলার অপেক্ষায় আমি যখন বিছানায় শুয়ে আছি, তখন ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং শিক্ষা খাতের জন্য জাতিসংঘের বিশেষ বার্তাবহ গর্ডন ব্রাউন। আমি মালালা বলছি-এই স্লোগানের অধীনে একটি আবেদন পেশ করেন যাতে ২০১৫ সালের মধ্যেই সব শিশুর স্কুলে যাওয়া নিশ্চিত হয়। প্রধানমন্ত্রী ও চলচ্চিত্র তারকাদের কাছ থেকে বার্তা এসেছিল, আমাদের প্রদেশের সর্বশেষ ব্রিটিশ গভর্নর স্যার ওলাফ ক্যারো-এর নাতনিও একটি বার্তা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন তাঁর দাদা পশতু লিখতে ও পড়তে পারলেও, তিনি নিজে পশতু না পারায় লজ্জিত। বিয়োন্সে আমাকে উদ্দেশ্য করে একটি কার্ড লিখেছেন এবং সেটার ছবি ফেসবুকে দিয়েছেন।
সেলেনা গোমেজ আমাকে নিয়ে টুইট করেছেন, ম্যাডোনা আমাকে তাঁর একটি গান উৎসর্গ করেছেন। আমার প্রিয় অভিনেত্রী এবং সমাজকর্মী অ্যাঞ্জেলিনা জোলির কাছ থেকেও একটা বার্তা ছিল আমাকে নিয়ে। এতকিছু মানিবাকে বলার জন্য আর অপেক্ষা করতে পারছিলাম না।
তখনো বুঝিনি যে আমি আর বাড়ি ফিরছি না।
(চলবে)