নিজেকে টেলিভিশন ডিরেক্টর মনে করি না : পারভেজ আমিন
তিনি নন্দিত নাট্যনির্মাতা। নিভৃতচারী। নিজেকে প্রচারের আড়ালে রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তাঁর প্রায়ই নাটকে খুঁজে পাওয়া যায় জীবনবোধের ছায়া। এনটিভির জন্য নির্মাণ করেছেন একাধিক নাটক। আসছে ঈদুল আজহায় এনটিভির অনুষ্ঠানমালায় থাকছে তাঁর নির্মিত টেলিছবি। বলছি পারভেজ আমিনের কথা। তাঁর নির্মিত নাটক এবং প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে।
প্রশ্ন : আপনি প্রচারবিমুখ পরিচালক। কেন?
উত্তর : আমি যেটা মনে করি সেটা হলো শিল্পী বড় হয় না, শিল্প বড় হয়। কাজটাই আসল। আর আমি এখন পর্যন্ত এমন কোনো আহামরি কাজ করিনি যে কারণে নিজেকে প্রচার করতে হবে। তা ছাড়া নিজের প্রচারে আমি খুব একটা আগ্রহী নই।
প্রশ্ন : আপনাকে নান্দনিক নির্মাতা বলা হয়ে থাকে। আপনার কাছে নান্দনিকতার সংজ্ঞা কী?
উত্তর : আমার কাছে শিল্পটা হচ্ছে নান্দনিকতা। আমার ক্ষেত্রে যদি বলি, তাহলে এটি আমার কাছে দেবতার মতো। এই দেবতাকে আমি লালন করি, পালন করি এমনকি শাসন করি। তারপর আমি যেটা ভাবি সেটা শৈল্পিকভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি।
প্রশ্ন : এখনকার সময়ে যেসব নাটক নির্মিত হচ্ছে সেসব নাটকে নির্মাতারা কতটুকু নান্দনিকতার ছোঁয়া রাখতে পারছেন বলে মনে হয়?
উত্তর : একটুও না।
প্রশ্ন : কারণ?
উত্তর : বর্তমানে এটার কোনো সুযোগ নেই। এখন আমরা একটি জিনিস বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে, টেলিভিশনে কোনো নান্দনিকতার জায়গা নেই। আমাদের শুরুটা কিন্তু এমন ছিল না। এতদিন তো শিল্পটাকেই লালন পালন করে আসছিলাম। এখন টেলিভিশন আমাদের এমন একটি জায়গায় দাঁড় করিয়েছে যে, পরিচালকরা নান্দনিক নাটক নির্মাণের সুযোগ পান বলে মনে করি না।
প্রশ্ন : আপনিও তো টেলিভিশনের পরিচালক।
উত্তর : আমি নিজেকে কখনোই টেলিভিশন ডিরেক্টর মনে করি না। আমি টেলিভিশন ডিরেক্টর হওয়ার চেষ্টা করেছি, ব্যর্থ হয়েছি। আমি টেলিভিশনের জন্য যেসব নাটক নির্মাণ করেছি, সেসব নাটকের ভাষাটা চলচ্চিত্রের মতো হয়ে গিয়েছে। আমার এসব নাটক যে খুব হিট হয়েছে তা কিন্তু নয়। তবুও যে চ্যানেল কর্তৃপক্ষ আমার ওপর আস্থা রাখছেন তাতে আমি তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ।
প্রশ্ন : আপনি বলছিলেন, টেলিভিশনের পরিচালকরা নান্দনিকতা দেখানোর সুযোগ পান না। কেন?
উত্তর : পৃষ্ঠপোষক নেই। ভালো কাজ করার মানসিকতা নেই। তাই নান্দনিক কাজ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। আবার অনেকে আছেন যাঁরা ভালো নাটক নির্মাণ করলেও চ্যানেল থেকে সেভাবে মূল্যায়নটা পান না। এমন কিছু কিছু কারণে এখন আর তেমন নান্দনিক নাটক নির্মিত হয় না।
প্রশ্ন : এর জন্য দায়ী কারা?
উত্তর : সব বিভাগের লোকজনই দায়ী। পরিচালক থেকে আরম্ভ করে চিত্রনাট্যকার সবাই। চ্যানেল কর্তৃপক্ষ আরো বেশি দায়ী। তাঁরা ভালো কাজের আগ্রহটা দেখাচ্ছে না। অপ্রিয় হলেও সত্য, চ্যানেল কম টাকায় ভালো কাজ করানোর চেষ্টা করেন। আসলে কম টাকায় তো ভালো কাজ সম্ভব নয়। তা ছাড়া চ্যানেলগুলো আর্টিস্টনির্ভর হয়ে গিয়েছে। এমন কথা শুনেছি যে, তারকাশিল্পী নিয়ে কাজ করলে নাটকের মান যেমনই হোক না কেনো চ্যানেল সেটা সাদরে গ্রহণ করছে। আবার চ্যানেল থেকে তারকাশিল্পী নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। হয়তো দেখা যাচ্ছে চরিত্রের সঙ্গে ওই তারকা কোনোভাবেই মানানসই নয়, তবুও চ্যানেল কোনো আপত্তি করছে না। এদিকে ডিরেক্টররা চান প্রযোজকের লগ্নিকৃত টাকা ফেরত দিতে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে কম্প্রোমাইজ করে নাটক নির্মাণ হচ্ছে।
প্রশ্ন : আপনি কি এই ধরনের কোনো সমস্যায় পড়েছেন কখনো?
উত্তর : আমাকে এমন কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। কারণ আমি এটাকে সুযোগ দেইনি।
প্রশ্ন : নাটকের নন্দনতত্ত্ব থেকে এবার চলে যেতে চাই ভিন্ন প্রসঙ্গে। ঈদের নাটকের ব্যস্ততা নিয়ে কিছু বলুন।
উত্তর : একটাই টেলিছবি করলাম এনটিভির জন্য। এনটিভির ঈদ অনুষ্ঠানমালায় প্রচারিত হবে।‘মেঘবালিকা’ নাটকটিতে মোশাররফ করিম এবং কলকাতার সিরিয়ালের অভিনেত্রী মধুমিতা চক্রবর্তী অভিনয় করেছেন। মধুমিতা চক্রবর্তী বাংলাদেশে ‘পাখি’ নামে পরিচিত।
প্রশ্ন : বাংলাদেশি টেলিছবিতে কলকাতার অভিনেত্রী কেন?
উত্তর : এটি খুব ভালো একটি প্রশ্ন। গল্পের প্রয়োজনে আমার ভারতীয় একজন পরিচিত অভিনেত্রী দরকার ছিল। সেই প্রয়োজনীয়তা থেকে মধুমিতা চক্রবর্তী বা পাখিকে নেওয়া। তাঁর সঙ্গে আমাদের বোঝাপড়াটাও ভালো ছিল। যে কারণে কাজটা বেশ ভালোভাবে করতে পেরেছি।
প্রশ্ন : পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে দুই দেশের অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে কারা এগিয়ে?
উত্তর : পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে বলতে গেলে বলতে হয় বাংলাদেশের শিল্পীদের চেয়ে কলকাতায় শিল্পীরা অনেক এগিয়ে। আমি এখানে বাংলাদেশি শিল্পীদের ছোট করছি না। এমন হয়েছে নির্ধারিত কল টাইমে আমরা তৈরি হতে পারিনি। অথচ ওনারা ঠিকই তৈরি হয়ে উপস্থিত হয়েছেন। সময়ের প্রতি খুব মনোযোগী। ওনাদের আরেকটি দিক আমার খুব ভালো লেগেছে সেটা হলো, কলকাতার শিল্পীরা পরিচালককে দেবতার মতো সম্মান করেন।
প্রশ্ন : আপনার নির্মিত নাটকগুলোর কাহিনী বিশ্লষণ করলে দেখা যায় প্রতিটি নাটক গতানুগতিক ধারার বাইরে। একটি জীবনবোধের চিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতে দেখা যায়। এই জীবনবোধের নাটক নির্মাণে আপনি কি জীবন থেকে প্রভাবিত?
উত্তর : সত্যি কথা বলতে আমি মফস্বলের ছেলে। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। ছোট থেকে বড় হয়েছি সুখ, দুঃখ, সংগ্রাম দেখে। আমি আমার জীবন থেকে যা শিখেছি, যা দেখেছি সেসব নাটকের মাধ্যমে পর্দায় ফুটিয়ে তুলি। মানুষের জীবনের নানা অব্যক্ত কথা চরিত্রের মাধ্যমে বলানোর চেষ্টা করি।
প্রশ্ন : বর্তমানের তরুণ নির্মাতাদের নাটক সম্পর্কে কিছু বলুন।
উত্তর : সোজা কথা এই প্রজন্মের দেখার পরিসর অনেক ছোট। জানার পরিসর আরো ছোট। এদের ভেতর এক্সাইটমেন্টটা বেশি। একটা নাটক নির্মাণের পর তাঁরা যেভাবে আত্মতুষ্টিতে ভোগে, সেটা অনুচিত। নির্মাতাদের আত্মতুষ্টির সুযোগ কম।
প্রশ্ন : ‘ঘণ্টিঘর’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন বেশ আগে। সেটির সর্বশেষ কী অবস্থায় আছে।
উত্তর : প্রায় শেষ পর্যায়ে। কিছু কাজ বাকি আছে। ঈদের পর কয়েকদিন শুটিং করলে পুরো কাজ শেষ হয়ে যাবে। তারপর পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ করতে ভারতে রওনা হব।
প্রশ্ন : পোস্ট প্রোডাকশন ভারতে কেন?
উত্তর : আমি কিন্তু আমার দেশকে অসম্ভব ভালোবাসি। আমাদের দেশে যে খুব ভালো এডিটর নেই সেটা বলব না। তবে আমাদের এডিটরদের টাইম ফ্রেমিংয়ের মধ্যে থাকতে পারি না। কারণ তাঁরা এত ব্যস্ত যে সময় দিতে পারেন না। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে পোস্ট প্রোডাকশনের যে খরচ, সেই একই খরচে ভারতে আরো ভালো আউটপুট আমি পাব। আমার ফিল্মের স্বার্থেই ভারতে পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া। তা ছাড়া আমাদের দেশে একটি ফিল্ম শেষ করার মতো ভালো মানের স্টুডিও এখনো হয়নি। আমার জানা মতে, এখানে প্রফেশনাল কোনো নয়েজপলি কোনো স্টুডিও নেই।
প্রশ্ন : এখনো বাংলাদেশে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত স্টুডিও তৈরি না হওয়ার কারণ কি?
উত্তর : সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছার বড় অভাব। এ দেশে এখন পর্যন্ত শিল্পটা গড়ে ওঠেনি। সে কারণে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে ব্যয়বহুল স্টুডিও নির্মাণের চিন্তা কেউ করেনি।
প্রশ্ন : চলচ্চিত্রের নাম ‘ঘণ্টিঘর’ কেন?
উত্তর : ফিল্মের যে প্রধান চরিত্র সে একজন রেললাইনের সিগন্যালম্যান। সিগন্যালম্যান যে ঘরটিতে থাকে, সেটিকে ‘ঘণ্টিঘর’ বলে। এই ঘণ্টিঘরকে নিয়েই ফিল্মের কাহিনী আবর্তিত হয়। এই কারণেই ছবির নাম ‘ঘণ্টিঘর’।
প্রশ্ন : ‘ঘণ্টিঘর’ কোন ধারার চলচ্চিত্র?
উত্তর : এটি কোনো ধারার নয়। একটি শুধুমাত্র একটি ছবি। অন্যকিছু না।
প্রশ্ন : বুকিং এজেন্টদের কতটুকু সন্তুষ্ট করতে পারবে বলে মনে হয়?
উত্তর : আমি বুকিং এজেন্টনির্ভর নির্মাতা নই। তাঁরা যদি ছবিটি প্রদর্শন করতে না চান, আমি নিজ উদ্যোগে মানুষকে এটা দেখানোর ব্যবস্থা করব। কারণ এই ধরনের জীবনবোধের ছবি মানুষের দেখা উচিত।
প্রশ্ন : কবে নাগাদ ‘ঘণ্টিঘর’ মুক্তি পেতে পারে?
উত্তর : ডিসেম্বর শেষের দিকে আশা করি ছবিটি মুক্তি দিতে পারব।