অজ্ঞাতনামা
বাস্তবধর্মী কাহিনীর সৃজনশীল নির্মাণ
একটি চলচ্চিত্রের প্রাণ হলো কাহিনী ও চিত্রনাট্য। কোনো সূত্র থেকে কাহিনী সংগ্রহ করে সেটাকে চিত্রনাট্য আকারে রূপ দিয়ে দৃশ্যায়নের মাধ্যমে পর্দায় তুলে ধরা হয়। কিছু কিছু চলচ্চিত্রের কাহিনী আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সূত্র থেকে সংগ্রহ করা হয়। সেসব চলচ্চিত্র যখন পর্দায় দেখা হয়, তখন গল্প খুব পরিচিত মনে হয়। মিলে যায় বাস্তবতার সঙ্গে। মূলত এটাকেই বলে বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্র।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্র খুব বেশি নির্মিত না হলেও মাঝেমধ্যে যে অল্প পরিমাণ নির্মিত হচ্ছে, সেগুলো কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহ আর দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে; বাণিজ্যিকভাবে সেভাবে মুক্তি পায় না। বুকিং এজেন্টরা আগ্রহ দেখায় না। তা ছাড়া দেশের সাধারণ দর্শকের রুচিবোধের একটি ব্যাপার এখানে জড়িত।
যা হোক, আমাদের আলোচ্য তৌকীর আহমেদের ‘অজ্ঞাতনামা’, এটি বাস্তব কাহিনীর ওপর নির্মিত একটি চলচ্চিত্র। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, চলচ্চিত্রের কাহিনীটি তিনি তাঁর গৃহকর্মীর কাছ থেকে শোনেন। তার পর কিছু সংযোজন-বিয়োজন করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, চলচ্চিত্রের কাহিনী আমাদের চারপাশেই রয়েছে। শুধু সেটাকে তুলে আনার কৌশল জানতে হয়। তৌকীর আহমেদ সেই কৌশল জানেন। আর তাই এমন একটি কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করার সাহস দেখিয়েছেন।
‘অজ্ঞাতনামা’র কাহিনীতে দেখা যায়, ফজলুর রহমান বাবুর ছেলে গলাকাটা পাসপোর্টে মধ্যপ্রাচ্যে যায় কর্মসংস্থানের জন্য। এখানে চেনার সুবিধার্থে প্রকৃত নাম ব্যবহার করছি। ছয় মাস পার হওয়ার পর হঠাৎ একদিন খবর আসে, তার ছেলে সেখানে এক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। সরকারের তরফ থেকে এয়ারপোর্টে লাশ আনতে যেতে বলা হয়। ছেলের মৃত্যুর খবর আসে যার পাসপোর্ট নকল করে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়েছিল, তার বাড়িতে। পরে দালাল চরিত্রে অভিনয় করা শহীদুজ্জামান সেলিমের কাছে পুলিশ জানতে পারে, ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে ফজলুর রহমান বাবুর ছেলের কাছে পাসপোর্ট বিক্রি করে দেয়।
খবরটি পাওয়ার পর কান্নায় ভেঙে পড়ে পরিবারের সবাই। ছেলের শোকে মা বিছানা নেয়। স্ত্রী অতি শোকে পাথর হয়ে যায়। সন্তানের ভেতর বাবা মারা যাওয়ার কোনো অনুভূতি কাজ করতে দেখা যায় না, কারণ সে বয়সে ছোট।
এয়ারপোর্টে লাশ আনার জন্য খরচের প্রয়োজন হলে দালাল নিজেকে বাঁচানোর জন্য সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। গলাকাটা পাসপোর্ট দিয়ে বিদেশে লোক পাঠানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ, এটা সে জানে। এয়ারপোর্ট থেকে লাশ আনার সময় ফজলুর রহমান বাবুকে শিখিয়ে দেওয়া হয়, গলাকাটা পাসপোর্ট অনুযায়ী ছেলের নাম ও তার বাবার নাম বলতে। প্রথম দিকে সে এই ঝামেলা কাটিয়ে উঠলেও পরে ছেলের লাশের পাশে কাঁদতে কাঁদতে সঠিক নাম আর পরিচয় বলে দেয়। কাস্টমস কর্মকর্তা এতে সন্দেহ প্রকাশ করলে শহীদুজ্জামান সেলিম তাকে টাকা দিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলে। এখানে কাস্টমস কর্মকর্তাদের দুর্নীতির চিত্র ফুটে ওঠে।
লাশ বাড়িতে নিয়ে আসার পর ঘটে আরেক ঘটনা। গোসল করাতে গিয়ে দেখে, লাশের খতনা করা নয়। অমুসলিম। আবার লাশটি তার ছেলের নয়। অন্য কারো। কেউ কেউ বলে লাশটি দক্ষিণ ভারতের কারো। আবার কেউ কেউ বলে লাশটি শ্রীলঙ্কান। ফজলুর রহমান বাবুর মনে আশা জাগে এই ভেবে যে তার ছেলে বেঁচে আছে। সে এই অচেনা অজ্ঞাত লাশটি ফিরিয়ে দিতে চায়। কিন্তু কীভাবে, কার কাছে গেলে এই লাশ ফিরিয়ে দেওয়া যাবে, তা জানে না! বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে গিয়ে সঠিক তথ্য পায় না। হয়রানির স্বীকার হয়। লাশ নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে সে জানতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যে দুর্ঘটনায় যে ছয়জন মারা গেছে, তাদের মধ্যে তার ছেলেও আছে। তবে ভুলক্রমে অন্য একটি লাশ চলে আসে। সন্তানের শোকে কাতর ফজলুর রহমান বাবু অজ্ঞাত লাশটিকে নিজের সন্তান ভেবে সৎকার করার সিদ্ধান্ত নেয়।
চলচ্চিত্রটির কাহিনী পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এখানে পরিচালক তৌকীর আহমেদ নানা অনিয়মের দৃশ্য তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশের অনেক লোক বিদেশে পাড়ি জমায় কর্মসংস্থানের জন্য। প্রচুর রেমিট্যান্স আসে। অথচ এই লোকগুলো বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে দালালদের দ্বারা প্রতারিত হয় এবং সেখানে কোনো কারণে মৃত্যুবরণ করলে লাশ দেশে আনতে যে ধরনের দুর্ভোগ পোহাতে হয়, তার একটি চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
চরিত্রগুলো সম্পর্কে বিশ্লেষণ করার আগে চলচ্চিত্রটির নামকরণের সার্থকতা নিয়ে কয়েকটি কথা বলতে চাই। নামকরণ চলচ্চিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কারণ, নামকরণ রুচিবোধ সম্পর্কে ধারণা দেয়। গল্পের সঙ্গে মানানসই সুন্দর নামকরণ দর্শকের চাহিদা সৃষ্টি করার প্রাথমিক কাজটি করে দেয়। সে ক্ষেত্রে ‘অজ্ঞাতনামা’ চলচ্চিত্রের নামকরণ যথার্থ এবং রুচিশীল হয়েছে। কাহিনীর সঙ্গে নামের যোগসূত্র পাওয়া যায়।
চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র ফজলুর রহমান বাবু গ্রামের ছাপোষা চরিত্রে দারুণভাবে মানিয়ে গেছেন। অভিনয়ে অতিরঞ্জিত ভাব পরিলক্ষিত হয়নি। অতি শোকে গলে পড়তে দেখা যায়নি। যতটুকু প্রয়োজন ছিল, ঠিক ততটুকু অভিনয় করেছেন।
এয়ারপোর্ট থেকে ছেলের লাশ আনতে টাকার প্রয়োজন হলে ফজলুর রহমান বাবু ছেলের লাশ আনার দায়িত্ববোধ থেকে সরে যাননি। তাই তিনি একপর্যায়ে বলেছেন, ‘দরকার হলে মহাজনের কাছ থেকে ধার নেব। ছেলে আমার, দায়িত্বও আমার।’ পৃথিবীর সব বাবার কাছে সংলাপটি অনুকরণীয় বটে। এ ছাড়া চলচ্চিত্রের শেষ দিকে অজ্ঞাতনামা লাশটির সৎকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একটা মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় তো সে মানুষ। একটা সৎকারের অধিকার তো তার আছে।’ সংলাপটি এক অসাম্প্রদায়িক চেতনার উদাহরণ হয়ে থাকবে।
চলচ্চিত্রটির পুরো কাহিনী সংবেদনশীল গুরুগম্ভীর বিষয়ের ওপর নির্মাণ করা হলেও দর্শকের যেন একঘেয়েমি না লাগে, সে জন্য হাস্যরসের দৃশ্য রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। আর এই হাস্যরস সৃষ্টিতে পরিচালক শহীদুজ্জামান সেলিম ও মোশাররফ করিমের ওপর ভরসা করেছেন। সফল হয়েছেন। তবে এখানে শহীদুজ্জামান সেলিমের কথা আলাদাভাবে বলতে হয়। তাঁকে এখানে নেতিবাচক চরিত্রে দেখানো হলেও যথেষ্ট ইতিবাচক ছিলেন। তাঁর চরিত্রে কোমল ভাব ছিল। লাশ ফেরত দেওয়ার সময় যখন টাকা জোগাড় করতে ফজলুর রহমান বাবু মহাজনের কাছে জমি বন্ধক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি মানা করে নিজেই টাকা জোগাড় করেন। একদম শেষে যখন পুলিশ তাঁকে ফজলুর রহমান বাবুর ছেলের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে, তখন তিনি অনুতপ্ত হন। কেঁদে ফেলেন, ক্ষমা চান। এখানে তাঁর চরিত্রের কোমলতার পরিচয় পাওয়া যায়।
অন্যরা সবাই নিজ নিজ চরিত্রে সেরাটাই দিয়েছেন। শতাব্দী ওয়াদুদ, নিপুণ আক্তার, আবুল হায়াত, শাহেদ শরীফ খানসহ সবাই চরিত্র অনুযায়ী ভালো করেছেন।
সিনেমাটোগ্রাফি, সম্পাদনা, আবহ সংগীত ভালো হলেও সূচনা সংগীত ততটা উন্নতমানের হয়নি। গানের কথা ভালো ছিল। তবে সেটা ভালো সংগীতায়োজনের অভাবে অন্তরকে স্পর্শ করেনি। আরো ভালো করার সুযোগ ছিল।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কৌশলে পণ্য স্থাপনের বিষয়টি এখন আর নতুন নয়। অহরহ স্পন্সরশিপ প্রতিষ্ঠানকে কোনো না কোনো দৃশ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ‘অজ্ঞাতনামা’ সে পথেই হেঁটেছে। সুকৌশলে সিম্ফনি মোবাইল ও এনার্জিপ্যাকের বিজ্ঞাপন ব্যবহার করা হয়েছে। বলিউডসহ অন্যান্য দেশের চলচ্চিত্রে পণ্য স্থাপন হরহামেশাই হচ্ছে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, চলচ্চিত্র বিজ্ঞাপনের জায়গা নয়।
এখানে আমার কয়েকটি বিষয় বোধগম্য হয়নি। লাশ নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ যেসব মন্ত্রণালয় দেখানো হয়েছে, সেসবের বাইরে থেকে দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে। শুধু সাইনবোর্ড থেকে বোঝানো হয়েছে কোনটা কোন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের ভেতরের কোনো দৃশ্য ধারণ করা হলে বিশ্বাসযোগ্যের জায়গাটা আরো দৃঢ় হতো। আবার যখন লাশের ট্রাক রাস্তায় সারা দিন-রাত দাঁড়ানো, দুর্গন্ধ বের হচ্ছে—তখন কোনো পুলিশ এসে বিষয়টি জানতে না চাওয়া আদৌ যুক্তিযুক্ত ছিল কি না, জানা নেই। মেনে নিলাম মোশাররফ করিম পুলিশ। কিন্তু টহল পুলিশ যদি আসত, তাহলে পরিচয় দেওয়ার আগে জানার কথা না যে সে পুলিশ।
শেষ করব। শেষ করার আগে বলতে চাই, সব মিলিয়ে ‘অজ্ঞাতনামা’ আবেগকে স্পর্শ করা একটি চলচ্চিত্র। প্রতিটি ফ্রেমে সৃজনশীলতার ছাপ স্পষ্ট। একটি সত্য ঘটনাকে এতটা সুনিপুণভাবে চিত্রায়ণ করে তৌকীর আহমেদ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।