ঈদের নাটক তারুণ্যনির্ভর
দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল ঈদ। সেইসঙ্গে প্রায় শেষ চ্যানেলগুলোর ঈদ আয়োজন। দর্শকের চাহিদার কথা মাথায় রেখে চ্যানেলগুলো চেষ্টা করেছে ভিন্নমাত্রার কিছু অনুষ্ঠান উপহার দিতে। তবে বরাবরই ঈদে দর্শকের চাহিদার শীর্ষে ছিল নাটক। আর এই নাটক নিয়ে ছিল চ্যানেলগুলোর নীরব প্রতিযোগিতা।
কয়েক বছর ধরে চ্যানেলে নাটক প্রচারিত হওয়ার পর সেটা সঙ্গে সঙ্গে অনলাইনে উন্মুক্ত করে দেওয়ার রীতি চালু হয়েছে। সেখানেই দর্শক নাটকের ভালো-মন্দ বিভিন্ন বিষয়ে মতামত দিচ্ছেন। অনলাইনে নাটক উন্মুক্ত করার বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলাম সময়ের জনপ্রিয় তরুণ নির্মাতা মাবরুর রশীদ বান্নাহকে। তিনি বিষয়টি ইতিবাচক মনে করছেন। সেইসঙ্গে তিনি বলেন, ‘চ্যানেলের মতো ইউটিউব হচ্ছে আরেকটি মাধ্যম। চ্যানেলগুলো কিন্তু ইউটিউবে নাটক আপলোড করছে। এতে যাঁরা নাটকটি দেখতে পারেননি, তাঁরা দেখতে পারছেন। সেইসঙ্গে যাঁরা বিজ্ঞাপন এড়িয়ে যেতে চান, তাঁরা ইউটিউবে চলে আসেন। এতে করে নাটকের দর্শকসংখ্যা বাড়ছে।’
একই বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলাম আরেক তরুণ নির্মাতা মিজানুর রহমান আরিয়ানের কাছে। তিনি বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করলেও তাঁর ব্যাখ্যা এমন, “এখনো নাটক দেখার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো টিভি চ্যানেল। এটা স্বীকার করতেই হবে। পরিবার নিয়ে টেলিভিশনের সবাই একসঙ্গে নাটক দেখা উৎসবের বড় অংশ। কিন্তু এখন মানুষ ইউটিউবের দিকে ঝুঁকছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ বিজ্ঞাপন। ঈদে এনটিভিতে প্রচারিত হওয়া আমার নির্মিত নাটক ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস’ দুদিনে প্রায় দুই লাখ মানুষ দেখেছেন। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, ধীরে ধীরে মানুষ ইউটিউব-নির্ভর হয়ে পড়ছে। যদিও এখন চ্যানেলগুলো স্বল্প বিরতি কিংবা ব্রেক ফ্রি নাটক প্রচার করছে। মানুষ এখন তাই টেলিভিশনেও নাটক দেখছে। তবে আমি মনে করি, ভালো নাটক হলে বিজ্ঞাপন সহ্য করে দেখবে।”
ঈদের নাটকের মান খারাপের বিষয়ে অনেকে অনেকভাবে অভিযোগ করে আসছেন। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে সাধারণ দর্শক থেকে শুরু করে মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। এর মধ্যে ভাষা বিকৃতি, নিম্নমানের গল্প, নির্মাণ দুর্বলতা অন্যতম অভিযোগ। এতসব অভিযোগ থাকার পরও দেখে নেওয়া যাক এবারের ঈদের নাটক কেমন ছিল।
অন্যসব ঈদের মতো এই ঈদেও ছিল ভালো-মন্দ নাটকের সংমিশ্রণ। ভালো নাটক যেমন ছিল, তেমন দৃশ্যের পর দৃশ্য জোড়া লাগানো নামধারী নাটকও ছিল। তরুণ নির্মাতাদের হাতেই ছিল নাটক নির্মাণের দায়িত্ব। চ্যানেলগুলো তাদের প্রতি আস্থা রাখলেও কিছু নাটক মানসম্মত হলেও কিছু নাটক মান বজায় রাখতে পারেনি। মান বজায় রাখতে না পারার কারণ হিসেবে তাঁরা বাজেটকে দায়ী করছেন। এদিকে, ঈদের নাটকগুলোতে তারকা শিল্পীদের বেশি অভিনয় করতে দেখা গেছে। জাহিদ হাসান, মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী, সিদ্দিক, মেহজাবীন, শখ, তিশা প্রমুখ এক বা একাধিক নাটকে অভিনয় করেছেন। এ ছাড়া যাঁরা নিয়মিত নাটকে অভিনয় করেন না বা বিশেষ দিনের জন্য নাটকে অভিনয় করেন, তাঁরাও ঈদের নাটকে অভিনয় করেছেন। তাঁদের ভেতর ছিলেন রিয়াজ, নোবেল, জন কবির, তাহসান, মিথিলাসহ আরো অনেকে।
বেশির ভাগ নাটকের গল্প ছিল তারুণ্যনির্ভর, তরুণদের প্রেম-ভালোবাসাকেন্দ্রিক। তরুণরা এসব বেশ ভালোভাবেই গ্রহণ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। তারুণ্যনির্ভর গল্প ছাড়াও ছিল ব্যতিক্রমী কিছু গল্প ও কমেডি ঘরানার নাটক। সিক্যুয়াল নাটক ছিল এর ভেতর।
আলাদাভাবে দর্শকের চাহিদার শীর্ষে থাকা নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস’, ‘কেন এই নিঃসঙ্গতা’, ‘লালরঙা স্বপ্ন’, ‘হেট ইউ’, ‘ইটস মাই লাভ স্টোরি’, ‘বুলেটপ্রুফ ম্যারেজ’, ‘লেটার বক্স’, ‘চল সবে ডায়েট করি, ‘মিরর গেম, ‘এক মুঠো ভালোবাসা’, ‘ভূতের ভ্যালেন্টাইন’, ‘সাবলেট গুবলেট’, ওয়াও সিক্যুয়ালের ‘ওয়াও সুপারহিট’, ‘মানি ইজ প্রবলেম’সহ আরো বেশ কিছু নাটক।
নির্মাতারাও তাঁদের নির্মিত নাটক নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। নিজের নাটক সম্পর্কে মাবরুর রশীদ বান্নাহ বলেন, “আমি আমার নির্মিত নাটকগুলো থেকে বেশ ভালো ফিডব্যাক পেয়েছি। বিশেষ করে ‘হেট ইউ’ এবং ‘ইটস মাই লাভ স্টোরি’ নাটক থেকে খুব ভালো ফিডব্যাক পেয়েছি। সামনে আরো ভালো কিছু নির্মাণ করে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার চেষ্টা থাকবে।”
মিজানুর রহমান আরিয়ান নিজের নাটক সম্পর্কে বলেন, ‘আমি যতটা আশা করেছিলাম, তার চেয়ে বেশি ফিডব্যাক পেয়েছি। অনেকে আমাকে ফোনে এবং মেসেজে নাটকের প্রশংসা করেছেন।’ ঈদে প্রচারিত অন্যান্য নির্মাতার নাটক সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এবার ঈদে ভালো কাজের সংখ্যা কম। তবে কিছু কিছু নির্মাতার কাজ ব্যক্তিগতভাবে আমার ভালো লেগেছে।’
আশার কথা হলো, চ্যানেলগুলো অতিমাত্রার বিজ্ঞাপনের বিষয়ে সচেতন হয়েছে। স্বল্প বিরতি এবং ‘ব্রেক ফ্রি’ নাটকের আয়োজন করেছে চ্যানেলগুলো। এতে ঈদের নাটকের দর্শক বেড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। যদিও এটা যথেষ্ট নয় বলে সাধারণ দর্শক মনে করছেন। দর্শকের মতে, চ্যানেলগুলোর উচিত বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ভালো মানের নাটক প্রচারের ক্ষেত্রে ছাড় না দেওয়া।
এ কথা স্বীকার করতেই হবে, দর্শক এখন আগের থেকে অনেক সচেতন। নাটক নিয়ে তাঁদের প্রত্যাশা থাকে আকাশচুম্বী। কোনো মানহীন নাটক গ্রহণ করতে তাঁরা রাজি নন। সে কারণে এই ঈদে ভালো নাটকের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। দর্শকের সচেতনতার কারণে কিন্তু এসব সম্ভব হচ্ছে। নির্মাতারাও চাইছেন কিছু ভালো নাটক নির্মাণ করতে। যদিও একেবারে মানহীন নাটক নির্মাণ শূন্যের কোঠায় আনা সম্ভব নয়, সে জন্য সময়ের প্রয়োজন। দর্শকদের সচেতনতা, চ্যানেলগুলোর দায়বদ্ধতা এবং নির্মাতাদের ভালো কিছু করার আকাঙ্ক্ষার সমন্বয় হয়তো নাটকের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনবে। কেননা, সংশ্লিষ্ট সবাই এখন বুঝতে পারছেন, মানহীন নাটক দিয়ে দর্শকদের আটকে রাখা সম্ভব নয়।