চলচ্চিত্র সমালোচনা
‘আয়নাবাজি’র অন্দর-বাহির
সাম্প্রতিক বাংলা সিনেমার আলোচনায় অমিতাভ রেজার ‘আয়নাবাজি’ একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। নানা কারণে এটি এখন কেবল সাধারণ বাংলা সিনেমার মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নেই। এরই মধ্যে বিবিধ মিথ এবং বাস্তবতা আয়নাবাজিকে ঘিরে সামনে এসেছে। মূলত, এই ছবির দুই ধরনের আলাপ সম্ভব বা আমি করব। একটা হচ্ছে খেলার মাঠে অর্থাৎ হলের পর্দায় দৃশ্য আকারে যা যা আলাপ উঠে আসছে সেগুলো এবং অন্যটা হচ্ছে মাঠের বাইরের আলাপ, যা হলের বাইরে তৈরি হওয়া নানা বিতর্ক এবং তৎসংশ্লিষ্ট কিছু ঘটনাপত্র।
আমার মতে দুই রকম আলাপই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দুই ঘটনা আলাদা আলাদা হলেও এগুলো একটি আরেকটিকে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করছে। এই প্যারাটা এখানে রেখে আমরা এবার একটু হলের বাইরে যেতে পারি। মানে আমরা হলের বাইরের আলোচনা দিয়ে লেখাটার দ্বার উন্মোচন করতে পারি।
বাহির
‘আয়নাবাজি’ দেখার নিমিত্তে রোববার বিকেল ৩টায় যখন বলাকা সিনেমা হলে যাই, হলের আশপাশে তখন উপচে পড়া ভিড়। ‘ভিড়’ শব্দটা এখানে ভিড়ের মাহাত্মকে ঠিক বোঝাতে পারছে না। তাই একটি ঘটনা দিয়ে বোঝানো যেতে পারে। হলে যাওয়ার আগেই টিকেট শেষ হওয়ায় উপায়ন্তর না দেখে ৫০ টাকা বেশি দিয়ে ব্ল্যাকে টিকেট কাটতে হলো। দাম এত বেশি কেন জানতে চাইলে ব্ল্যাকার বলল, ভাই অনেকদিন পর একটা ছবি হাতে আসছে যেটার টিকেট ব্ল্যাকেও বিক্রি হচ্ছে। এই বিষয়টা বাংলা সিনেমার একজন ‘পাঠক’ হিসেবে আমার জন্য বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ। এই ব্ল্যাকার নিশ্চিতভাবে ‘আয়নাবাজি’র দর্শক না। তবে সে বুঝতে পারছে অনেকদিন পর তার ব্যবসা জমছে। সে বেশি লাভ দিয়ে কটা টিকেট বিক্রি করতে পারছে। এমন দৃশ্য বাংলা সিনেমায় সাম্প্রতিক সময়ে কবে দেখা গেছে কে জানে? অন্তত এই অভিজ্ঞতা আমার জন্য প্রথম।
এ রকম ঘটনা এতদিন আমি শুনেছি কেবল। যা কেবল মিথ আকারে হাজির ছিল, অন্তত আমার ব্যক্তিগত ডিসকোর্সে। সে যাই হোক, এই উপচে পড়া ভিড় কোনো গিমিক না। এই দর্শক এমনি এমনি আসেনি। তাকে আনা হয়ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে অমিতাভ রেজা এমন কী জাদু করেছেন, যা বাকিরা এতদিন পারেননি? এই ছবি মুক্তির আগেই একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি করতে পেরেছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত তরুণ শ্রেণির তুমুল আগ্রহ ছিল এই ছবি নিয়ে। আগে থেকেই নিজেকে আলাপে রাখার কাজটা ‘আয়নাবাজি’ করতে পারছে কিংবা তার পরিচালক। বিশেষত সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমকে অমিতাভ দারুণভাবে প্রচারণার কাজে লাগিয়েছেন। এই ছবি নিয়ে দর্শকাঙ্ক্ষা এতটাই বেশি ছিল যে মুক্তির আগের দিন হাউসফুল। অনেকেই টিকেট কিনতে গিয়ে হতাশ হয়েছেন, পাননি। এমনকি মুক্তির তৃতীয় দিনে এসেও একই অবস্থা। বাকি সব আলাপ বাদ দিলে এখানেই ‘আয়নাবাজি’ সফল। অমিতাভ আক্ষরিক অর্থে দর্শককে হলে আনতে পারছেন। এই বিষয়টা আমার কাছে উল্লেখযোগ্যভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
এই ছবি মুক্তির ঠিক পরপর আরেকটা বাহাস তৈরি হয়েছে। বিষয়টা ছবির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না আবার বিযুক্তও না। সেটা হলো ‘বাঙালি মুসলমান’ সংক্রান্ত বিতর্ক। যেহেতু এই ইন্টারভিউ এখনো পুরোপুরিভাবে প্রকাশিত না, তাই সেটা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ নিষ্প্রয়োজন। তবে যে কোনোভাবে এই ডিসকোর্সটি সামনে এসেছে এই ছবিকে ঘিরে। এমনকি এই কথা যদি অমিতাভ না বলে থাকেন তবুও। এখন এই মুভির সঙ্গে বাঙালির মুসলমান এর কোনো সম্পর্ক আছে কি না, থাকলে সেটা কেমন সেই আলাপ আরেকটু পর। কিন্তু যেটা সত্যি, এই বিতর্ক তৈরি হওয়ার পর পরিচালক নিজেই আলাপের কেন্দ্রে চলে আসেন। অনেকে এই ছবিটি বয়কটের ঘোষণা দেন। কিন্তু এই বয়কটও আদতে ‘আয়নাবাজি’র পক্ষেই গিয়েছে। এটাও ছবির প্রচারণার কাজ করেছে একভাবে। যদিও হঠাৎ করে অমিতাভের বাঙালি মুসলমান প্রসঙ্গ টানা, এটা ছবির বিপণন কৌশলও হতে পারে বা অন্য কিছু। তবে এই বাহাস আরো যা করেছে তা হলো অমিতাভ ও তার ছবিকে টেনে এনে বুদ্ধিবৃত্তিক আলাপে ফেলেছে এবং কাউকে কাউকে অস্বস্তিতেও।
অবশ্য এসব আলাপ ছবি দেখার পর কতটা বর্তমান থাকবে, সেই বিতর্ক ভিন্ন। যদিও প্রাথমিক প্রোপাগান্ডা হিসেবেও এই আলাপ মন্দ না। অন্তত ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে তো বটেই।
অন্দর
প্রারম্ভিক কথাবার্তা শেষ। এবার আমরা মূল টেক্সট পাঠে মনোযোগ দিতে পারি। তবে কাহিনী বর্ণনা উহ্য রাখার চেষ্টা থাকবে। সেটা দর্শক হলে গিয়েও দেখতে পারবেন। আমি কেবল এই ছবির সঙ্গে আমার বোঝাপড়াটুকু বলার চেষ্টা করব।
লাশের একটা আলগা দৃশ্য দিয়ে এই ছবি শুরু হয়। ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোথাও উল্লেখ নেই এই লাশ কার কিংবা কেন! আমার মতো কেউ কেউ হয়তো জঙ্গি হামলা, পুড়ে মরা কোনো গার্মেন্টসকর্মীকেও সন্ধান করেছেন এই দৃশ্যে। তবে ছবির শেষের দিকে গিয়ে আমরা হয়তো আসল বিষয়টা আন্দাজ করতে পারি। এই লাশ সম্ভবত আয়নার মায়ের। যেহেতু উল্লেখ নেই, সেহেতু আমি ‘সম্ভাবনা’ হিসেবেই ধরে নিচ্ছি। এরপর ঢাকা শহরের পরিচিত গলিতে ‘হলিউড’ নামক একটা স্টুডিওর খোঁজ দিয়ে শুরু এবং ছবির শেষ পর্যন্ত কেউ না কেউ এই ‘হলিউড’ স্টুডিওকে খুঁজে বেড়িয়েছেন। কখনো কখনো পরিচালক স্বয়ং নিজেও। তাই এটা সিম্বোলিকভাবে হলেও গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে শুরুতেই এক বাচ্চা ছেলেকে পর্দায় এনে গিমিক দিলেন অমিতাভ।
এই বাচ্চাটি পুরো ছবিতে যখনই পর্দায় এসেছে একটা বিস্ময় এবং চমকের মতো ছিল। তার এক শব্দের ডায়ালগ থ্রোয়িং এক কথায় দুর্দান্ত। আমি বলব, এই ছবিতে সেরা অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে সে অন্যতম। এই ছবির মূল চরিত্র আয়না। চরিত্রটি নাগরিক নানা সংকট থেকে জন্ম নেওয়া। বিভিন্ন অপরাধীর চরিত্রকে সে নিজের মধ্যে ধারণ করে আলাদা একটা চরিত্র নির্মাণের চেষ্টা করেছে বারবার। যা নাগরিক যাবতীয় সংকট থেকে পালানোর একটা উপায়ও। যদিও আপাতদৃষ্টিতে একেবারেই গোবেচারা মনে হবে। একের অধিক চরিত্রে এখানে আয়না তথা চঞ্চল চৌধুরী বেশ ভালো অভিনয় করেছেন। তবে তাঁর অভিনয় দক্ষতাকে প্রমাণ করার জন্য পরিচালক সহায়ক আরো কিছু টুলস ব্যবহার করেন। যেগুলো কখনো কখনো অপ্রয়োজনীয়ও মনে হয়েছে। চঞ্চলের এই বিবিধ চরিত্রে অভিনয় মধ্যবিত্তের মাল্টিপল পরিচয়ের ভেতর দিয়ে নিজের আত্মপরিচয় পরিচয় নির্ণয় করার একটা চেষ্টাও বলা যায়। এই চরিত্র ঢাকাস্থ আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই। তবে আড়ালে আড়ালে ভয়ঙ্কর অপরাধমূলক মনোবৃত্তি গড়ে ওঠার যে সাম্প্রতিক লক্ষণ তাকেও চিহ্নিত করছে এই চরিত্রটি। শেষ পর্যন্ত এই আয়নার লড়াইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠে সে নিজেই।
কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনের অগ্নিগর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া এই পাগল সেই পাগলের চেয়ে ভিন্ন যাকে পুরো ছবিতে অমিতাভ বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে রাস্তার মধ্যে ‘সিম্বল’ হিসেবে হাজির করেছেন। আয়না ঠিক পাগল না। সে নিজেকে দাবি করে অভিনেতা হিসেবে, তবে প্রশ্নও হচ্ছে এও যে, উত্তরাধুনিক যুগের সব পাগলই কি তবে অভিনেতা? শেষ পর্যন্ত অভিনেতা চঞ্চলের জয় হয়েছে। তার অপরাধ ভয়ঙ্কর হওয়ার পরেও তার প্রতি সিম্প্যাথি তৈরির চেষ্টা করেছেন অমিতাভ এবং শেষ পর্যন্ত তাকে জিতিয়ে দিয়েছেন। গুড এবং এভিলের এই লড়াইয়ের ভেতর গুড অভিনেতার জয় হয়েছে এবং জিতেছে ‘সত্য সাংবাদিকতা’ও। নীতিবান সাংবাদিক পার্থ বড়ুয়া জিতেছেন। এই ছবিতে পার্থর অভিনয় কখনো কখনো অতি অভিনয় মনে হয়েছে। বিশেষ করে নিজের সাংবাদিক পরিচয়কে বারবার জাহির করার ক্ষেত্রে মনে হয় তিনি নিজেও সম্ভবত অস্বস্তিতে ছিলেন। এই ছবির কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রে নাবিলা ঠিক ততটুকুই অভিনয় করেছেন, যতটা দরকার ছিল। বিশেষ ইমোশনাল মোচড়গুলোতে তিনি হাজির থেকেছেন ভালোভাবেই। এবং মূল চরিত্রকে ভালোভাবে সাপোর্ট দিয়ে গেছেন।
ছবির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক ছিল এর ঝরঝরে স্টোরি টেলিং। টাইমিং এতটুকু মিস করতে দেখিনি। জাম্পগুলোও দুর্দান্ত। দৃশ্য থেকে দৃশ্যের পরিবর্তন একটুও চোখে লাগেনি। এই গল্প একেবারেই যে অপরিচিত এবং আহামরি তা না। কিন্তু বয়ানভঙ্গি যথেষ্ট গোছানো ছিল। এসবের পরেও যা সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে সেটা সম্ভবত এর সিনেমাটোগ্রাফি। এই ছবিতে রাশেদ জামানের কাজ আমার অনেকদিন মনে থাকবে। কন্টেম্পোরারি ঢাকা সিটির এই প্রেজেন্টেশন বেশ অভিনব। সেই সঙ্গে কিছু কিছু শট মাথায় গেঁথে থাকার মতো। ছবির গানগুলোও ভালো লাগার মতোই।
এবার আমরা বাঙালি মুসলমান সংক্রান্ত বিতর্কটা এই সিনেমায় কীভাবে হাজির হয়েছে, আদৌ হয়েছে কি না সেটা দেখে নিতে পারি। পুরো ছবিতে দুটি দৃশ্য বাদ দিলে আমি বাঙালি মুসলমানের কোনো উল্লেখ পাইনি। এই বিতর্ক সামনে না এলে আমি হয়তো এই দুটি দৃশ্য মনেও রাখতাম না। একটি দৃশ্যে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে পার্থর সামনে এক বোরকা পরা মহিলার উপস্থিতি। সবদিক থেকে এটি এই ছবির বাজেভাবে অভিনীত এবং মেলোড্রামাটিক একটি দৃশ্য। অন্য দৃশ্যটি কোনো দৃশ্য নয়, একটি বাক্য মাত্র। সেখানেও অবশ্য বাঙালি মুসলমান উপস্থিত নেই। আয়নার বাবাকে মৌলবাদীরা গ্রাম থেকে বের করে দিয়েছে তার মা যাত্রাপালা করত বলে। এটুকুই। যা মোটেই উল্লেখ করার মতো কিছু না। অন্য আর একটি দৃশ্যে একইভাবে মার্কস, লেনিন প্রসঙ্গ এসেছে অনেকটা একইভাবে; যা স্রেফ বাহুল্য মনে হয়েছে। এই ছবি মূলত মধ্যবিত্তের জন্য তৈরি। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত তরুণ সমাজের জন্য একটা থ্রিলার ছবি। এখানে বাঙালি মুসলমান কিংবা মার্কসীয় ধ্যান-ধারণার যেটুকু উপস্থিতি সেটাও অনুপস্থিত থাকার মতোই এবং মার্কস-লেনিনের প্রসঙ্গ টানা কিছুটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতও মনে হয়েছে।
তবে সব মিলিয়ে এই ছবি এক বসাতে দেখে শেষ করার মতো। শুরুর পাঁচ মিনিট এবং বিরতির পর ১০ মিনিট বাদ দিলে এই ছবি কোথাও খাপছাড়া মনে হয়নি। আর যে আলাপ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যেভাবেই দর্শক হলে আসুক না কেন, ছবি দেখার পর সে খুশি। ছবি হাউসফুল এবং দর্শক বিনোদিত। বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য আপাতত এটুকুই অনেক।