সিনেমার পেছনের কাহিনী
‘রইস’ আসলে কে?
শাহরুখ খানের বহুল প্রতীক্ষিত ‘রইস’ ছবির ট্রেইলারের উত্তাপে এখন তেতে রয়েছে পুরো বলিউড। এই ছবিতে শাহরুখ খানকে দেখা যাবে ‘রইস আলম’ নামের এক দুর্ধর্ষ মদ ব্যবসায়ীর চরিত্রে। তবে এই ছবিতে শাহরুখ তথা ‘রইস’-এর চরিত্রটি গড়ে উঠেছে গুজরাটের কুখ্যাত গ্যাংস্টার আবদুল লতিফের জীবন নিয়ে, যাকে বলা যেতে পারে আসল ‘রইস’!
ছবিতে শাহরুখের চরিত্রটি একেবারে সরাসরি এই আন্ডারওয়ার্ল্ড ডনের জীবন থেকে টুকে নেওয়া, সে বিষয়ে সংগত কারণেই মুখ ফুটে কিছু বলেননি নির্মাতারা। তবে বিষয়টি সব মিলিয়ে মোটামুটি নিশ্চিত, আবদুল লতিফের উত্থান-পতনের গল্পে ভর করেই তৈরি হয়েছে ‘রইস’। ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডেতে প্রকাশিত হয়েছে এ নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন, যাতে পুরো পরিচয় পাওয়া যাবে প্রকৃত ‘রইস’-এর।
১৯৯৭ সালে আহমেদাবাদে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে মৃত্যু ঘটে আবদুল লতিফের। বেশ কয়েকটি ভারতীয় গণমাধ্যমে খবর এসেছে, আবদুল লতিফের ছেলে মুস্তাক আহমেদ আবদুল লতিফ শেখের সঙ্গে দেখা করার জন্য বেশ কয়েকবার গুজরাট গেছেন শাহরুখ। আবদুল লতিফের চরিত্রকে ভালোভাবে বুঝে ওঠার জন্যই ছিল এই সাক্ষাৎ। এ ছাড়া অনুমতির কিছু বিষয় তো থাকতেই পারে।
শাহরুখ বুঝতে পেরেছিলেন, মুস্তাকের সঙ্গে ঘন ঘন দেখা করলে রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত থেকেও সমস্যায় পড়তে পারেন তিনি। এ জন্য তিনি মুস্তাকের সঙ্গে দেখা করা বন্ধ করে দেন, তার থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করেন। মুস্তাক এতে ক্ষিপ্ত হন, এমনকি তিনি নাকি শাহরুখের কাছ থেকে ১০ কোটি রুপিও দাবি করেন। তবে এ বিষয়টি ঠিক নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি বলে তা গুজব হিসেবেই রয়ে গেছে।
কে ছিলেন আবদুল লতিফ?
আবদুল লতিফের জীবনের গল্প আহমেদাবাদের সড়ক থেকে শুরু। কিশোর বয়সে তিনি জুয়ার টেবিলে টেবিলে মদ পরিবেশন করার কাজ করতেন। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে অবৈধ মদের ব্যবসায় তিনি প্রবেশ করেন; সেইসঙ্গে যুক্ত হন বিভিন্ন অপরাধে। সময়ে সময়ে রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে নিয়ে একসময় তিনি গুজরাটে গড়ে তোলেন নিজের বিশাল অবৈধ মদের ব্যবসা। উচ্চাভিলাষী এই গ্যাংস্টার নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার আর ব্যবসার পরিধি বাড়াতে সময় নেননি। এর মধ্যে তিনি পেশাদার খুনি হয়ে ওঠেন, জমির দালালি-দখলবাজির সঙ্গেও যুক্ত হন। গুজরাটের পশ্চিমপাড়ের একটি গ্রামের এলাকা দিয়ে তিনি চোরাচালানকৃত অস্ত্র ও গোলাবারুদের ব্যবসাও শুরু করেন।
মুসলমানদের রবিনহুড?
গুজরাটের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য আবদুল লতিফ এক অঘোষিত রবিনহুড হয়ে উঠেছিলেন বলেও কথিত আছে। বেকার মুসলিম যুবকদের কাজ দেওয়া, থাকার জায়গা করে দেওয়া, খাবার সরবরাহ এবং অন্যান্য সাহায্য তিনি নিয়মিত করতেন। তাঁর নাকি আলাদা বিচারব্যবস্থাও ছিল। গুজরাটের হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরাট অংশ লতিফকে কট্টর সাম্প্রদায়িক হিসেবেই জানত, এ কারণে লতিফের গ্রেপ্তারের পর তারা স্বস্তি পায়।
দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা
মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে লতিফের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ১৯৯২ সালের মুম্বাই বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত ১৯২ জনের মধ্যে লতিফের নাম ছিল না বটে, তবে গ্রেপ্তার হওয়ার পর লতিফ স্বীকার করেন যে করাচিতে ১৫ মাস অবস্থানকালে তিনি ‘প্রায় প্রতিদিন’ দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
গ্রেপ্তার এবং পতন
দুই মাসের এক কঠিন অভিযানের পর ১৯৯৫ সালের ১০ অক্টোবর দিল্লির জামে মসজিদ এলাকা থেকে লতিফকে গ্রেপ্তার করা হয়। পাবলিক টেলিফোন থেকে কথা বলার কারণেই তাঁর অবস্থান পুলিশের পক্ষে চিহ্ণিত করা সম্ভব হয়েছিল। গুজরাট পুলিশের অ্যান্টি-টেররিস্ট স্কোয়াড এ সময় তাঁকে হন্য হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিল।
লতিফের বিরুদ্ধে মামলা
আবদুল লতিফের বিরুদ্ধে সব মিলিয়ে ৯৭টি মামলা ছিল, যার মধ্যে ১০টি ছিল হত্যা মামলা। এ ছাড়া বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসার অভিযোগ তো ছিলই। লতিফের ছেলে মুস্তাক ‘রইস’ ছবির পরিচালকের বিরুদ্ধে তাঁর বাবাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের অভিযোগ করেছেন।
পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মৃত্যু
২০০৮ সালে গুজরাট পুলিশের একজন অবসরপ্রাপ্ত ডিরেক্টর জেনারেল টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেন, ‘গুজরাটে বিজেপির অবস্থানই লতিফের রাজ্য নড়বড়ে করে দেয়। জনতা দল সরকারের সঙ্গে (১৯৯০-৯৫) লতিফের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন চিমনভাই প্যাটেল। তবে এরপর ভারতীয় জনতা পার্টি সেখানে ক্ষমতায় এলে লতিফ তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন।’
এ সময়, ১৯৯৫ সালের দিকে লতিফ পাকিস্তানে গা-ঢাকা দেন। বিজেপির সব জনসভাতেই তখন লতিফের সঙ্গে দাউদের যোগাযোগের বিষয়টি উল্লেখ করা হতো। লতিফ গ্রেপ্তার হওয়ার পর গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী সিএম কেশুভাই প্যাটেলকে ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ উপাধি দেওয়া হয়।
গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে লতিফকে সবরমতী কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ২৯ নভেম্বর জেল থেকে পালানোর চেষ্টার সময় তিনি ধরা পড়েন। পরে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তাঁর মৃত্যু হয়।