নাসিক নির্বাচন
শেষ হাসি কার নৌকা, না ধানের শীষ?
আজ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনের ভোট গ্রহণ চলছে। এবারের নির্বাচনে মোট ভোটারের সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। এবারের নাসিক নির্বাচনে মেয়র পদে সাতজন, ২৭টি সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে ১৫৬ জন এবং নয়টি সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ডে ৩৮ প্রার্থী চূড়ান্তভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
তবে সর্বশেষ ১৭ ডিসেম্বর শনিবার বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের একটি শরিক দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) প্রার্থী কামাল প্রধান বিএনপির মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানের সমর্থনে তাঁর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন। যার ফলে বর্তমানে প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়াল ছয়জনে। এর আগে গণফোরাম তাদের সমর্থন দিয়েছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আইভীর পক্ষে। সর্বশেষ জাতীয় পার্টিও আইভীর পক্ষে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছে। জাতীয় পার্টির দলীয় এমপি সেলিম ওসমান এক সংবাদ সম্মেলনে এমন ঘোষণা দিয়েছেন। রাত পোহালেই আগামীকাল নাসিক নির্বাচন। মাসখানেক ধরে মিডিয়ার শিরোনাম হয়ে রয়েছে এই নির্বাচন।
এরই মধ্যে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন কমিশনে গিয়ে সেখানে পুনরায় সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়ে এসেছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সেনা মোতায়েন ব্যতিরেকেই নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সেখানে ১৭৪টি নির্বাচনী ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ১৩৭টিকে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র বিবেচনা করে সেখানে তিন দিনের জন্য প্রায় ২৩টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের দুদিন আগে, অর্থাৎ ২০ ডিসেম্বর বিএনপিদলীয় প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন জনসংযোগকালে গণমাধ্যমে তাঁর দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, এখন পর্যন্ত নির্বাচনের যে পরিবেশ, তাতে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে বলেই মনে হয়।
অন্যদিকে সরকারদলীয় প্রার্থী আইভী অন্যায়ভাবে প্রভাব খাটানোর দায়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসিকে বদলি করার দাবি জানিয়েছেন। সিদ্ধিরগঞ্জ, বন্দর ও সদর—এ তিনটি থানা নিয়ে নাসিক এলাকা। এর আগে নারায়ণগঞ্জ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পৌরসভা। গত টার্মে এটি প্রথমবার সিটি করপোরেশন হয়েছে। তবে সেবার সেই নির্বাচন প্রকাশ্যে দলীয় ব্যানারে দলীয় প্রতীক নিয়ে হয়নি। এবারই প্রথম স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আগের নির্বাচনগুলোতে যদিও দলীয় প্রতীক ছিল না, কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো অনানুষ্ঠানিকভাবে সেগুলোতে দলীয় মনোনয়ন ঘোষণা করত। সে জন্যই এর আগে গত নাসিক নির্বাচনে বিএনপি থেকে মেয়র পদে মনোনয়ন পেয়েছিলেন অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। কিন্তু নির্বাচনের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে দলীয় সিদ্ধান্তে তিনি প্রার্থিতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। ধারণা করা হয়, সে কারণেই তিনি এবারে আর মেয়র পদে নির্বাচনে দাঁড়াতে রাজি হননি। মূল প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি দলেই রয়েছে অন্তর্দলীয় কোন্দল। সেখানে আইভী ও শামীমের অন্তর্দ্বন্দ্ব আগে প্রকাশ্য হলেও এখন তাঁদের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে ঐক্যের সুর।
তাঁদের এ ঐক্যে ভোটার এবং দলীয় কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও ফিরতে শুরু করে এক ধরনের প্রাণচাঞ্চল্য। তারই অংশ হিসেবে ৯ ডিসেম্বর, শুক্রবার শামীম ওসমান এক সংবাদ সম্মেলন করে নৌকা ও আইভীর পক্ষে তাঁর অবস্থান তুলে ধরে বক্তব্য রেখেছেন। সেখানে আইভীকে তিনি তাঁর ছোট বোন আখ্যায়িত করে তাঁর পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। তিনি যেহেতু বর্তমানে নির্বাচিত এমপি, সে জন্য নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী তিনি সেখানকার প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন না। তিনি দলীয় আনুগত্য প্রকাশের নজির হিসেবে দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেছেন, তিনি নির্দেশ দিলে সংসদ সদস্য হিসেবে পদত্যাগ করে হলেও দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে আগ্রহী। সে জন্য ছোট বোন আইভীকে তিনি নৌকা প্রতীকখচিত এক জোড়া শাড়ি উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন।
আইভী অবশ্য বড় ভাই শামীমের শাড়ি সানন্দে ও ধন্যবাদের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। দুই বা ততোধিক বিবদমান ধারার মধ্যে যখন অসহিষ্ণুতা দেখা দেয়, তখন সমর্থকদের মধ্যেও এর প্রভাব লক্ষ করা যায়। কিন্তু নাসিক নির্বাচনের একটি নিরাপদ সময় আগেই এ রকম একটি ঐক্য ভোটারদের স্বস্তি দিয়েছে বলে মনে করছেন নির্বাচনী পর্যবেক্ষকরা। এর আগে আইভী প্রথমে পৌর মেয়র এবং পরে প্রথম সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। আইভীর বাবা আওয়ামী লীগ নেতা আলী আহমদ চুনকাও তাঁর জীবদ্দশায় দুবার পৌর চেয়ারম্যান ছিলেন। এটি আইভীর তৃতীয়বারের নির্বাচন হলেও নারায়ণগঞ্জ একটি শিল্পনগরী ও চিহ্নিত সন্ত্রাসের জনপদ হওয়ার কারণে সেখানে আইভী দীর্ঘদিনে দুর্নীতিমুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত ও উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ড করে ভোটারদের মনে স্থান করে নিয়েছেন বলে বিভিন্ন জরিপে উঠে আসছে। তার ওপর এবারে তার রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদ। কাজেই দলীয় ঐক্য, মার্কা, এলাকা, উন্নয়ন, ব্যক্তি ইমেজ, গণবান্ধব কাজ সব বিবেচনায় নিয়ে এখনো আইভীর পাল্লাই ভারী হিসেবে দেখছেন নির্বাচনী পর্যবেক্ষকরা।
অন্যদিকে বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন রাজনীতিতে নতুন হলেও তাঁর একটি ক্লিন ইমেজ রয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আর সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তিনিও জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী বলে বারবার জানাচ্ছেন তাঁর প্রতিক্রিয়ায়। যদিও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া পূর্বঘোষিত একদিন প্রচারে না আসায় নেতাকর্মীদের মধ্যে কিছুটা হতাশা লক্ষ করা গেছে। তবে সরকার, নির্বাচন কমিশন, দল আওয়ামী লীগ সবাই ভালোভাবে নির্বাচনটিকে সামলাচ্ছে, যাতে কোনো সমস্যা না হয়। সেখানে আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায় থেকে এ নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমেই একটি সর্বজনগ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করে সেই সুষ্ঠু নির্বাচনে জিতে দেখিয়ে দিতে চায়। সকল প্রকার ভয়, শঙ্কা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠাসহ সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হবে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা। আর সেটি করতে পারলে শেষ হাসি কে হাসবে, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। নৌকা না ধানের শীষ! সময়েই বলে দেবে শেষ হাসি কার।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।