ঢালিউড ২০১৬
ঢাকাই চলচ্চিত্রের সালতামামি
হাঁটি হাঁটি করে ঢাকাই চলচ্চিত্র পার করল আরো একটি বছর। ফেলে আসা বছরে ঢাকাই চলচ্চিত্রের হালচাল সম্পর্কে এবার হিসাব-নিকাশ করার পালা। বিগত কয়েক বছর ধরে ঢাকাই চলচ্চিত্র নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। এই অভিযোগ মূলত ব্যর্থতার আর ভেঙে পড়ার। প্রতিবছর নতুন প্রত্যাশা নিয়ে আরম্ভ হলেও দিন শেষে ব্যর্থতার পাল্লা ভারী করে বছর শেষ করতে হয়। এখন দেখার বিষয় এই বছর ঢাকাই চলচ্চিত্র কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে!
মূল আলোচনা আরম্ভ করার আগে পেছন থেকে ঘুরে আসা যাক। প্রযোজক এবং পরিবেশক সমিতির তথ্যমতে, গত বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে দেশে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের সংখ্যা ছিল প্রায় ৬৩টির মতো। যার ভেতর ছিল একক নির্মাণের দেশি চলচ্চিত্র ছাড়াও যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র। যদি তার আগের বছরের কথা উল্লেখ করি, তাহলে দেখা যাবে ২০১৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল সর্বসাকল্যে ৭৬টির মতো চলচ্চিত্র।
বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে বিগত বছরগুলোর তুলনায় দেশে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের সংখ্যা কমেছে। চলতি বছর ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছে ৫৫টি চলচ্চিত্র। আরো দুটি চলচ্চিত্র মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাহলে সব মিলিয়ে চলচ্চিত্রের সংখ্যা দাঁড়াবে ৫৭টি। শুধু সংখ্যার দিক থেকে চলচ্চিত্র কমেনি, সেই সঙ্গে কমেছে মান এবং ব্যবসা। তবে এখানে তৃপ্ত হওয়া যায় এই কথা ভেবে যে, ব্যবসায়িক ব্যর্থতার সমূহ সম্ভাবনা জেনেও প্রযোজকরা অর্থ লগ্নি করছেন। আবার একই সঙ্গে অতৃপ্তির বিষয় হলো প্রযোজকরা চলচ্চিত্রের পেছনে অর্থ লগ্নি করলেও দর্শকের রুচির দিকটি বিবেচনায় রাখেননি। অপাত্রে অর্থলগ্নি এবং মানহীন চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে সারা বছর ঢালিউড তেমন কোনো সম্ভাবনার চলচ্চিত্র উপহার দিতে পারেনি।
তবে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের মধ্যে কিছু চলচ্চিত্র ছিল ব্যতিক্রম, যা দর্শকরা বেশ ভালোভাবে গ্রহণ করেছেন। আবার কিছু চলচ্চিত্র ব্যবসায়িকভাবে সফল না হলেও প্রশংসিত হয়েছে। যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র ‘শিকারী’ এবং ‘বাদশা’ এ বছর মুক্তি পাওয়া ব্যবসাসফল দুটি চলচ্চিত্র। এ ছাড়া ‘রাজা- ৪২০’, ‘বসগিরি’, ‘শ্যুটার’‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী-২’ বেশ ভালো চলেছে। ঢাকার বলাকা, পূর্ণিমা, আনন্দ প্রভৃতি সিনেমা হলগুলোর ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে, কিছু তথ্য বেরিয়েছে চলচ্চিত্রবিষয়ক কিছু পত্রিকাতেও। যদিও উল্লিখিত সিনেমা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতিবাচক সমালোচনায় সরব ছিল। বছরের শেষের দিকে সব মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রকে ছাড়িয়ে যায় অমিতাভ রেজা পরিচালিত ‘আয়নাবাজি’ চলচ্চিত্রটি। এই বছরের সবচেয়ে ব্যবসাসফল ছবি হিসেবে অবহিত করা হচ্ছে এটিকে। এর বিপরীতে ছবিটির বিরুদ্ধে ছিল নকলের অভিযোগ এবং ত্রুটিপূর্ণ কাহিনী নিয়ে।
গৌতম ঘোষ পরিচালিত যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র ‘শঙ্খচিল’ দুই বাংলায় সমাদৃত হয়েছে, কিন্তু ব্যবসা করতে পারেনি। ছবির প্রযোজক এমনটাই বলেছিলেন দৈনিক ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে। এ ছাড়া ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ হলেও প্রশংসিত হয়েছে মেহের আফরোজ শাওন পরিচালিত হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘কৃষ্ণপক্ষ’ এবং তৌকীর আহমেদ পরিচালিত ‘অজ্ঞাতনামা’। রেদওয়ান রনির ‘আইসক্রিম’ চলচ্চিত্রটিও প্রশংসিত হয়েছে। যদিও চলচ্চিত্রটি মুক্তির কয়েকদিন পর প্রেক্ষাগৃহ থেকে নামিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে।
চলতি বছর বেশকিছু কলকাতার চলচ্চিত্র আমদানি করা হয়েছে। আমদানীকৃত চলচ্চিত্রগুলো হলো ‘বেপরোয়া’, ‘বেলাশেষে’, ‘কেলোরকীর্তি’। বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে কলকাতার এসব ছবি মুক্তির বিরোধিতা বিষয়ে সরগরম ছিল এফডিসি। অনেককে এই চলচ্চিত্র বিনিময়কে শুভংকরের ফাঁকি বলে প্রতিবাদ জানাতে দেখা গিয়েছে।
এই যখন চলচ্চিত্রের অবস্থা তখন সাধারণ দর্শকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল বছরের মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্র সম্পর্কে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলচ্চিত্র নিয়ে লেখালেখি করেন মালিক বাহাদুর। তিনি ২০১৬ সালের চলচ্চিত্র সম্পর্কে বলেন, ‘গত দুই-চার বছরের তুলনায় এ বছর ভালো ছবি নির্মাণের চেষ্টা ছিল। তবে যৌথ সিনেমা আমাদের জন্য হুমকি বলা যায়। হুমকি হলেও এর একটি ইতিবাচক দিক আছে। সবাই কারিগরি দিক এবং প্রচারণা সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে, যা অনেক আগে থেকে হওয়া উচিত ছিল।’
মাজহার মুন্না প্রায় হলে গিয়ে বাংলা ছবি দেখেন। একটি সংবাদমাধ্যমে চাকরি করেন। তাঁর মতে, ২০১৬ সালে বাণিজ্যিক ছবি থেকে বিকল্পধারার ছবি এগিয়ে ছিল। ‘অজ্ঞাতনামা’ তার কাছে বছরের সেরা চলচ্চিত্র।
ঠিক একই বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল চলচ্চিত্র নির্মাতা সুস্ময় সুমনকে। চলতি বছর মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্র সম্পর্কে তাঁর ব্যাখ্যা এমন, ‘বছরের সেরা ছবি আমার কাছে ‘অজ্ঞাতনামা’। ‘আয়নাবাজি’ও বেশ ভালো। কিন্তু কথা হলো সাধারণ দর্শক যদি ১০০ টাকার টিকেটে চকচকে মাসালা ছবি দেখতে পায় সে ক্ষেত্রে তারা অল্প বাজেটের ছবি দেখবে কেন? তাই আমাদের যৌথ ছবি প্রযোজনার ব্যাপারে আরো ভেবে দেখা উচিত।’
নির্মাতা মোস্তাফিজুর রহমান মানিক চলতি বছরের চলচ্চিত্র নিয়ে বলেন, ‘যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্রগুলো ভালো করেছে। শিকারী, বাদশা তার উদাহরণ। লোকাল প্রোডাকশনগুলো তেমন সফল হয়নি।’ ভালো না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি উত্তরটা এভাবে দেন, ‘লোকাল প্রোডাকশনগুলোর লুক ভালো ছিল। তবে স্ক্রিনপ্লের দুর্বলতার কারণে সফল হয়নি।’
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ২০১৬ সাল ঢাকাই চলচ্চিত্র রংহীনভাবে পার করেছে। হাতে গোনা কয়েকটি চলচ্চিত্র ব্যবসা করলেও সেগুলো আশাজাগানিয়া নয়। আসছে নতুন বছর দেশীয় চলচ্চিত্র নতুনভাবে জেগে উঠতে পারবে কি না, সেটা সময় বলে দেবে। তবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায়, আগামী বছরটি হবে ঢাকাই চলচ্চিত্রের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ বছর।