নারায়ণগঞ্জে আইভীর বিজয়
সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে বহুল প্রতীক্ষিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এ নির্বাচনে নগরবাসী আজ আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকেই মেয়র হিসেবে বেছে নিয়েছে। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিদলীয় প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানকে সাড়ে ৭৯ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে পুনরায় মেয়র পদে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন।
ফলাফলের পর প্রতিক্রিয়ায় টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিজয়ী সেলিনা হায়াৎ আইভী তাঁর বিজয় দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসর্গ করেছেন। অপরদিকে সাখাওয়াত হোসেন খান বলেছেন, এই ফলাফলে ‘সূক্ষ্ম কিছু একটা হয়েছে’।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে শতকরা প্রায় ৭৯ ভাগ ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ভোটকেন্দ্রের গোটা শহরজুড়ে আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুরু হয় ভোট-উৎসব। কোনো ধরনের গোলযোগ ছাড়াই বিকেল ৪টা পর্যন্ত টানা ভোটগ্রহণ করা হয়। পৌনে পাঁচ লাখ ভোটারের মধ্যে এবার ভোট দিয়েছেন দুই লাখ ৯৬ হাজার ৩৬ জন। এবার ভোট বাতিল হয়েছে সাত হাজার ১৭১ ভোট। নির্বাচনে ৬২ দশমিক ৩৩ ভাগ ভোটার ভোট দিয়েছেন। গতবার এ হার ছিলো ৬৯ শতাংশ।
ভোট গণনা শেষে সন্ধ্যার কিছু পর থেকে ফলাফল আসতে শুরু করে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে। সেখান থেকেই ফলাফল ঘোষণা করছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান তালুকদার। ভোটের ফলাফল জানতে সন্ধ্যার পর থেকেই বিভিন্ন দলের নেতাকর্মী, প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকরা ভিড় করতে থাকেন নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের আশপাশে। ক্লাবেই স্থাপন করা হয়েছে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়। তবে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে সেখানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ।
রাত সাড়ে ১১টার দিকে রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান তালুকদার ঘোষণা করেন, ‘১৭৪টি কেন্দ্রের মধ্যে সবকটি ফলাফল পাওয়া গেছে। এতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন এক লাখ ৭৫ হাজার ৬১১ ভোট, অপরদিকে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান ধানের শীষ প্রতীকে পেয়েছেন ৯৬ হাজার ৪৪ ভোট।’
ফলাফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয় রাজধানীর পাশে নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা একসময়ের প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত শীতলক্ষ্যাপাড়ের এ শিল্পনগরীর দ্বিতীয়বারের ভোটযজ্ঞ। যদিও এবারই প্রথম স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে মেয়র পদপ্রার্থীরা সরাসরি জাতীয় রাজনৈতিক দলের মনোনয়নে ভোটের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
মেয়র পদে আইভী ও সাখাওয়াত ছাড়াও আরো পাঁচজন লড়ছেন। এর মধ্যে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির মেয়র পদপ্রার্থী অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান ইসমাইল কোদাল মার্কায় পেয়েছেন ৬৭৪ ভোট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মুফতি মাসুম বিল্লাহ হাতপাখা মার্কায় পেয়েছেন ১৩ হাজার ৯১৪ ভোট, ইসলামী ঐক্যজোটের মুফতি ইজহারুল ইসলাম মসজিদের মিনার মার্কায় ৯১০ ভোট পেয়েছেন, এলডিপির কামাল প্রধান ছাতা মার্কায় পেয়েছেন ৪৩২ ভোট, কল্যাণ পার্টির মেয়র পদপ্রার্থী রাসেল ফেরদৌস সোহেল মোল্লা হাতঘড়ি মার্কায় পেয়েছেন ৪৮০ ভোট।
এদিন মেয়র পদের পাশাপাশি নগরবাসী ২৭টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদপ্রার্থী এবং নয়জন সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর প্রার্থী নির্বাচিত করেছেন। যদিও এবার তাঁরা তাঁদের দলের কাছ থেকে সমর্থন পেলেও আইনি বাধ্যবাধকতার কারণেই প্রতীক নিয়ে যেতে পারেননি ভোটারের কাছে। তাদের লড়তে হয়েছে নির্বাচন কমিশনের প্রতীকে। একই অবস্থা নয়টি সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদপ্রার্থীর ক্ষেত্রেও।
স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হলেও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে প্রায় এক মাস ধরে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা ছিল গণমাধ্যমের আকর্ষণের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। সেই সূত্রে এই নির্বাচন নিয়ে সারা দেশের মানুষের আগ্রহও ব্যাপক।
অতীতে বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, কেন্দ্র দখল, জালিয়াতি আর প্রাণহানির ঘটনায় ‘বিতর্কিত’ বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) বলছিল, তারা একটি মডেল নির্বাচন উপহার দিতে চায় এখানে। ফলে আগামী ফেব্রুয়ারিতে বিদায়ের আগে সর্বশেষ ভোটের অগ্নিপরীক্ষার সামনে ছিল ইসি।
২০১১ সালের ৫ মে নারায়ণগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ ও কদম রসুল এ তিনটি পৌরসভা বিলুপ্ত করে ২৭টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত হয় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন। একই বছর ৩০ অক্টোবর প্রথমবারের মতো সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শামীম ওসমানকে পরাজিত করে সিটির প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন সেলিনা হায়াৎ আইভী। তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী, যিনি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে আইভী বিলুপ্ত হওয়া নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। সেই নির্বাচনে ভোটের কয়েক ঘণ্টা আগে মাঠ ছেড়ে যান বিএনপির প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার। তিনি ভোট পান প্রায় সাত হাজার।
এবার দলের মনোনয়ন পান আইভী। আগের প্রতিদ্বন্দ্বী সংসদ সদস্য শামীম ওসমান তাঁর পক্ষে থাকার কথা জানান। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আইভী এই নির্বাচনে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সমর্থনও পেয়েছে। গত ১৯ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির নেতারা নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে বসে সংবাদ সম্মেলন করে আইভীকে সমর্থনের কথা জানান।
আইভীর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
১৯৬৬ সালের ৫ জুন নারায়ণগঞ্জের এক রাজনৈতিক পরিবারে আইভীর জন্ম। বাবা আলী আহমেদ চুনকা ছিলেন স্বাধীনতা উত্তরকালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম চেয়ারম্যান। তিনিও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
১৯৮২ সালে মাধ্যমিক এবং ১৯৮৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে চিকিৎসাবিদ্যায় পড়শোনার জন্য স্কলারশিপ পেয়ে রাশিয়ায় চলে যান। সেখানে ওদিসা পিরাগভ মেডিকেল ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৯২ সালে এমডি ডিগ্রি লাভ করে দেশে ফিরে আসেন। পরে ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে ইন্টার্নশিপ করেন। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি নারায়ণগঞ্জে ২০০ শয্যা হাসপাতালে কাজ করেন। ১৯৯৫ সালে উচ্চতর পড়াশোনার জন্য নিউজিল্যান্ডে চলে যান। ২০০২ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। ২০০৩ সালের ১৬ জানুয়ারি বিপুল ভোটে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম নারী চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন।
সেলিনা হায়াৎ আইভী এখন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তিনি বিভিন্ন সময়ে নারায়ণগঞ্জ নগর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদকসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি আওয়ামী লীগপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) জেলা শাখার আহ্বায়ক।