কাজ করাই আমার প্রধান শখ : চৌধুরী আতিয়ুর রসুল
চৌধুরী আতিয়ুর রসুল। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপে হিসাব পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। গ্রুপে কোম্পানির সংখ্যা ৫০টি। সব কোম্পানির হিসাব পরিচালনার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বেশ দক্ষতার সঙ্গে পালন করছেন তিনি।
১৯৮০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাববিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও পরবর্তী বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন আতিয়ুর রসুল। এর পর সফলতার সঙ্গে শেষ করেছেন সি. এ. (ইন্টার) এবং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি (সিএ) কোর্স।
আতিয়ুর রসুলের জন্ম ও শৈশব কেটেছে কুষ্টিয়া শহরে। ১৯৭৫ সালে কুষ্টিয়া জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। নিজের সফলতা ও হিসাবরক্ষণের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. আখতারুজ্জামান।
এনটিভি অনলাইন : আপনার পেশাগত জীবন কীভাবে শুরু হলো?
আতিয়ুর রসুল : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স শেষ করে ভর্তি হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে প্রথম একটি চাকরির অফার পাই। ১৯৮২ সালে আমার চাকরিজীবন শুরু। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে হিসাব কর্মকর্তা (অ্যাকাউন্টস অফিসার) হিসেবে আমার চাকরি শুরু। পরে ভাবলাম, অ্যাকাউন্টস অফিসার হিসেবে যদি আমি চাকরি করতে থাকি, তবে খুব বেশি ওপরে উঠতে পারব না। চিন্তা করলাম, আমার প্রফেশনাল ডিগ্রি লাগবে। চাকরি ছেড়ে এসে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সিতে ভর্তি হই। ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে সি. এ. কোর্সটা শেষ করি। ১৯৮৭ সালের ১ জানুয়ারি বম্বে সুইটস অ্যান্ড কোম্পানির গ্রুপপ্রধান হিসাবরক্ষক হিসেবে যোগ দিই। সি. এ. শেষ করার পর ওটাই প্রথম চাকরি, যেখান থেকে আমাকে নিচের দিকে চাকরি করতে হয়নি। বিভাগীয় প্রধান পর্যায়েই কাজ করেছি আমি। আমি চার-পাঁচটা জায়গায় কাজ করেছি, প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার সৌভাগ্য হয়েছে।
এনটিভি অনলাইন : বৃহৎ একটি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন। প্রতিদিন কাজটা শুরু করেন কীভাবে?
আতিয়ুর রসুল : আমার কাছে সব সময় নোটবুক থাকে। যখন যেটা মনে আসে, লিখে ফেলি। পাশাপাশি মোবাইল ফোনেও নোট লিখে রাখি। আগে প্রায়োরিটি ঠিক করি, অর্থাৎ কোন কাজটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বের করি। এর পর দিনের কর্মসূচির তালিকা তৈরি করি। আমি একজন হিসাবরক্ষক। আমি ৩০ বছর আগে যে কাজ করেছি, সেই কাজ এখন করলে হবে না। প্রতিটি সমস্যার কোনো না কোনো ভালো সমাধান আছে। সুন্দর পরিকল্পনা এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কাজটা সম্পন্ন করতে হবে। সিদ্ধান্ত যত তাড়াতাড়ি দেওয়া যায়, সেটাই উত্তম। সকাল থেকেই কাজ শুরু করে দিই। সব সহকর্মীর সঙ্গে আমার কাজের বন্ধুত্বটা অন্য রকমের। আমরা মিলেমিশে আমাদের টার্গেট পূরণ করি। বলতে পারেন, আমি তাঁদের গাইড।
একটা মানুষ কিন্তু সবার কাজ করতে পারবে না। আমি চাই, আমার সঙ্গে সবাই কাজ শিখুক, আর আমি সেটাই করি। সবাইকে সবার দায়িত্ব থেকে কাজ করার মানসিকতা তৈরি করে দিতে পারি, তা হলে এমনিতেই ভালো একটা ফল আসবে।
এনটিভি অনলাইন : এ পেশায় যেমন ভালো ক্যারিয়ার গড়া যায়, তেমনি অনেকেই আবার ঝরে পড়েন। এটা কেন হয়?
আতিয়ুর রসুল : যে ঝরে পড়ে যায়, বুঝতে হবে ওই ব্যক্তি চাকরিকে আপন করে নিতে পারেনি। সে পারবে না। আর এটা ওই ব্যক্তির দুর্বলতা, চাকরির নয়। আপনি যেখানে আছেন, সেটাকে নিজের প্রতিষ্ঠান মনে করে কাজ করে যান, তাহলে আপনি কাজে ভালো ফল দিতে পারবেন। তখন আপনার বস খুশি হবেন; তখন আপনি আস্তে আস্তে উঠে যাবেন এবং এ পেশায় ভালো ক্যারিয়ার গড়তে পারবেন।
এনটিভি অনলাইন : অনেকে বলে থাকেন, হিসাবরক্ষক মানে অফিস সময় সীমাহীন। কথাটা কি ঠিক?
আতিয়ুর রসুল : আমি এই ধারার বিপরীত। রাত-দিন অফিস করতে পছন্দ করি না। অনেকে আছে রাত ১২টা পর্যন্ত অফিস করলে বিশাল কিছু হয়ে যায়, এমন মনে করে। আমি আট ঘণ্টার জায়গায় ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত অফিসে থাকি। আপনি যে সময়টা অফিসের কাজ করবেন, সেটার একটা প্রডাক্টিভিটি থাকতে হবে। আমার একদিনে অনেক কাজ আসবে, সেটা হয়তো শেষ নাও করতে পারি। আমাকে দেখতে হবে, আজ যে কাজটা শেষ করে যাওয়া উচিত ছিল, সেটা করলাম কি না। সেটার জন্য যদি রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়, করতে হবে।
এনটিভি অনলাইন : যাঁরা এই পেশার মাধ্যমে পেশাজীবন শুরু করতে চান, তাঁদের কোন বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া দরকার?
আতিয়ুর রসুল : যাঁরা শুরু করতে চান, তাঁদের সামনে যে কাজ আসবে, তা সিরিয়াস হয়ে করতে হবে; জ্ঞান আহরণ করতে হবে। সত্যবাদী ও নিষ্ঠাবান হতে হবে, ভালো প্ল্যান ও ডিসিশন মেকার হতে হবে। টার্গেট ওরিয়েন্টেড হতে হবে।
এনটিভি অনলাইন : এ পেশায় ভাষার ব্যবহার নিয়ে কিছু বলুন।
আতিয়ুর রসুল : এখনো অ্যাকাউন্টিং সার্ভিসের ব্যালান্স শিট ইংরেজি ভাষায় আছে। এগুলো এখন পর্যন্ত বাংলায় হয়নি। টপ ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তাটা ইংরেজিতেই হয়। অফিসে বাংলা বলা নিষেধ। বাংলা না বলতে পারলে আমাদের অশান্তি লাগে। যখন বেশি খারাপ লাগে, তখন একে অন্যের সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে বাংলা বলি। এর অর্থটা হচ্ছে, ইংরেজি ভাষাটাকে ভালোভাবে আয়ত্ত করতে হবে। তবে আপনি যা বলবেন, তা সুন্দরভাবে সাবলীল ভাষায় বলুন।
এনটিভি অনলাইন : আপনার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কিছু বলুন। প্রতিষ্ঠানটি দেশের বাইরেও ব্যবসা করছে। ওই যোগাযোগটা কীভাবে করেন?
আতিয়ুর রসুল : ১৯৮১ সালে মরহুম মেজর জেনারেল আমজাদ খান চৌধুরীর (অব.) হাতে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের যাত্রা শুরু হয়। তখন এর নাম ছিল রংপুর ফাউন্ড্রি লিমিটেড (আরএফএল)। পরে পরিবর্তন করে নাম রাখা হয় প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ।
বর্তমানে বিশ্বের ১৩৪টি দেশে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। আমরা ইন্টারন্যাশনাল ফুড ফেয়ারগুলোতে অংশগ্রহণ করি। সেখানে আমাদের পণ্যের কোনো মার্কেট পাওয়া যায় কি না, সেটা বের করার চেষ্টা করি। এভাবে বহির্বিশ্বে আমাদের ব্যবসার পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এনটিভি অনলাইন : প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ বর্তমানে কত ধরনের পণ্য উৎপাদন করছে?
আতিয়ুর রসুল : আমাদের প্রতিষ্ঠান ৩২০০ ধরনের পণ্য উৎপাদন করছে। কিছু পণ্য আছে, যেগুলো বিদেশ থেকে নিয়ে এসে বাজার যাচাই করা হয়। বাজার ভালো হলে আমরা তৈরির প্রক্রিয়ায় যাই।
এনটিভি অনলাইন : প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের মাধ্যমে বর্তমান কতজনের কর্মসংস্থান হয়েছে?
আতিয়ুর রসুল : কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যাপারে এগিয়ে আছি আমরা। আমাদের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সরাসরি এক লাখ আর পরোক্ষভাবে তিন লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। একসময় এ প্রতিষ্ঠানে মানবসম্পদ বিভাগ (এইচআর) ছিল একটি। আর এখন ওই বিভাগের সংখ্যা তিনটি। প্রতিবছর ৩০ হাজারের বেশি লোক আমাদের প্রতিষ্ঠানে যোগ দেয়।
এনটিভি অনলাইন : আপনার এই পেশার মূলমন্ত্র কী?
আতিয়ুর রসুল : আদর্শ, সততা, শৃঙ্খলা (ডিসিপ্লিন), কঠোর পরিশ্রম, সুচিন্তা, সময়ের কাজ সময়ে করা এবং জ্ঞান অর্জন—এ পেশার মূলমন্ত্র। আদর্শ হতে পারে কোনো বাজে অভ্যাস না থাকা। সততা হচ্ছে, আপনার দ্বারা কেউ প্রতারিত হয় না। আপনি মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করেন না। শৃঙ্খলা হচ্ছে, আপনি সময়ের সঠিক ব্যবহার করবেন। কঠোর পরিশ্রম না করলে কোনো সফলতাই আসবে না। আপনার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন। আপনি যে কাজ করছেন, ওই বিষয়ের ওপর ভালো জ্ঞান রাখতে হবে। সেটা যে বিষয়েরই হোক না কেন।
এনটিভি অনলাইন : আপনি কর্মব্যস্ত মানুষ। শখ পূরণ করার সময় পান? আরো যদি বলি, অবসরে কী করা হয়?
আতিয়ুর রসুল : কাজ করাই আমার প্রধান শখ। তবে বাগান করা পছন্দ করি। বাসার ছাদে একটা ছোট বাগান আছে। আর অবসর সময়ের একটা অংশ কাটে ওই বাগানেই। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই ছাদের ওই বাগানে যাই। নিজ হাতে গাছে পানি দিই। যখন আমি গাছগুলোর কাছে যাই, তখন যেন মনে হয় তারা খুশি হয়। আমারও ভালো লাগে। এখন আমার গাছের ছাদে প্রচুর বরই। আছে পেয়ারাগাছ। সেখানে প্রচুর পেয়ারা ধরেছে। পেয়ারাগুলো পলিথিন দিয়ে বেঁধে রেখেছি, যাতে করে পাখি খেতে না পারে। একটা গাছে গোটা চল্লিশেক আমড়া আছে।
হ্যাঁ, বলা যায় আরেকটা শখের কথা। বিদেশ ভ্রমণ করতে আমার খুব ভালো লাগে। সুযোগ পেলেই বিদেশ ভ্রমণের চেষ্টা করি ।
এনটিভি অনলাইন : আপনি কার অনুপ্রেরণায় আজ এই জায়গায়?
আতিয়ুর রসুল : জীবনে চলার জন্য অনুপ্রেরণা প্রয়োজন। আমার অনুপ্রেরণা রকিবুল হোসাইন নামের এক ব্যক্তি। তিনি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের পরিচালক (অর্থ) ছিলেন। আমার প্রথম চাকরিজীবন শুরু হয় ওখান থেকেই। তিনি আমাকে খুব অনুপ্রেরণা দিতেন। সব সময় তাঁর কথা মনে থাকবে।
এনটিভি অনলাইন : এখন অনলাইন হচ্ছে ব্যবসা প্রসারের অন্যতম মাধ্যম, এ বিষয়টা কীভাবে দেখছেন?
আতিয়ুর রসুল : বর্তমানে চলছে ইন্টারনেটের যুগ। এখন এর বাইরে কোনো কিছুই কল্পনা করা যায় না। কেউ যদি তাঁর ব্যবসার পরিধি বাড়াতে চান, তাঁকে অবশ্যই অনলাইনের আওতায় আসতে হবে। আগে যে কাজটা কয়েক দিন লাগত, এখন তা কয়েক মিনিটেই করা যায়। নিজের ব্যবসা সম্পর্কে খুব দ্রুত সারা পৃথিবীকে অনলাইনের মাধ্যমেই জানানো যাচ্ছে।
এনটিভি অনলাইন : যাঁরা হিসাবরক্ষকের পেশায় আসতে চান, তাঁদের উদ্দেশে কিছু বলুন।
আতিয়ুর রসুল : যাঁরা এ পেশায় আসতে চান, তাঁরা একটা প্রফেশনাল ডিগ্রি করে এলে ভালো হয়, সেখানে অভিজ্ঞতার বিশাল সুযোগ। যাঁরা জীবনে দারুণ কিছু করতে চান, তাঁরা এ পেশাকে গ্রহণ করতে পারেন। দেশের/বিশ্বের বেশিরভাগ বড় ব্যবসার এন্টারপ্রিনিয়র কিন্তু এই পেশা থেকেই হয়। আমার ছেলে ব্যবসা প্রশাসনে এসেছে, কারণ এখানে কম সময়ের মধ্যে ভালো করা যায়। ব্যবসায় প্রশাসন (বিবিএ) নিয়ে স্নাতক করতে চার বছর সময় লাগে। আর ভালো ছাত্র হলে সি. এ. পাস করতে তিন বছর লাগে। তবে তাকে মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে, শিখতে হবে এবং জানতে হবে।
এনটিভি অনলাইন : আপনাকে ধন্যবাদ।
আতিয়ুর রসুল : এনটিভি অনলাইন পরিবারকেও ধন্যবাদ।