কুমিল্লায় দ্বন্দ্ব মেটাতে ব্যস্ত আওয়ামী লীগ
কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে অন্তর্কোন্দল চলছে দীর্ঘদিন ধরে। বিশেষ করে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আফজাল খান ও সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার জেলা আওয়ামী লীগকে দুই ভাগ করে দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করে যাচ্ছেন। এমন বাস্তবতায় ৩০ মার্চ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচন। এতে দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বকে পেছনে ফেলে আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে জেতাতে চান বলে জানিয়েছেন দলটির প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুমিল্লায় আফজাল খান ও বাহারের বিভাজিত রাজনীতি শুধু বাগবিতণ্ডার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বিভিন্ন সময় নানা ইস্যুতে পক্ষে-বিপক্ষে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে উভয় পক্ষের কর্মী হতাহত হয়েছে। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বারবার এই দ্বন্দ্ব সমাধানের চেষ্টা করলে কোন্দলের বাহ্যিক রূপটা স্বাভাবিক মনে হলেও ভেতরে ভেতরে এই অন্তর্ন্দ্বন্দ্ব ক্রমশ বেড়েছে।
আসন্ন কুসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা আফজাল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে মনোনয়ন দেওয়ায় বাহারপন্থীদের পুরোনো ক্ষোভ নতুন করে দেখা দিয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক নেতা মনে করেন, আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দল বিএনপি সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর জয়ের পথকে সুগম করবে।
তবে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার ভাষ্য, দলীয় বোঝাপড়া ও কুসিকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের অপরিহার্যতার কথা যৌক্তিকভাবে তুলে ধরা হবে। এর মাধ্যমে সীমাকে জয়ী করার চেষ্টা চলবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক (চট্টগ্রাম) এ কে এম এনামুল হক শামীম এনটিভি অনলাইনকে জানান, এটা মতানৈক্য। এসব অসঙ্গতি দলে থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে দলের সম্মানের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ নেতারা ঐক্যবদ্ধ হতে দ্বিধাবোধ করে না। এমন উদাহরণ নারায়ণগঞ্জসহ সারা দেশে আছে। তাই কোন্দল মিটিয়ে দলের প্রার্থীকে জয়ী করতে দ্বিধাহীন চিত্তে সবাই কাজ করবে।
‘ইতিমধ্যে বাহাউদ্দিন বাহার আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে, তিনি আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে বিজয়ী করতে কাজ করবেন। সুতরাং প্রত্যাশা করছি আমরা বিজয়ী হব’, বলেন শামীম।
স্থানীয় দুই নেতার দ্বন্দ্ব নিরসনে তৎপর কেন্দ্র
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে কুমিল্লা সদর আসনে নৌকা মার্কা পেয়ে জয়ী হন বাহাউদ্দিন বাহার। আর ২০১২ সালে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আফজাল খানকে সমর্থন দেয় আওয়ামী লীগ। এই নির্বাচনে জয়ী হোন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু। এ জন্য বাহারের অনুসারীদের অসহযোগিতার পাশাপাশি তাঁর বিরুদ্ধে ভোট দেওয়াকে দায়ী করেছিলেন আফজাল-সমর্থকরা।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে কুমিল্লা সদর আসনে আবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান বাহাউদ্দিন বাহার। সে সময় মনোনয়ন চেয়েছিলেন আফজাল খান। কিন্তু তাঁকে প্রার্থী করেনি দল। এর পর তাঁর ছেলে মাসুদ পারভেজ খান ইমরান স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বাহারের কাছে হেরে যান।
এর মাধ্যমে বাহার-আফজাল দ্বন্দ্ব আরো স্পষ্ট হয়। এমন পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচনে বাহাউদ্দিন বাহার কেন্দ্রীয় নেতাদের পরামর্শে সুলতানা সীমার পক্ষে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও গোপনে তাঁর বিরোধিতা করতে পারেন বলে মনে করছেন স্থানীয় কিছু নেতা।
তবে ভেতরে ভেতরে কোনোভাবে যেন বিভেদের দেয়াল উঠতে না পারে সে জন্য বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম এনামুল হক শামীম। তিনি জানান, তাঁর নেতৃত্বে কৃষি ও সমবায়বিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী, ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আফজাল হোসেন, বন ও পরিবেশ সম্পাদক দেলওয়ার হোসেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক আবদুস সবুর, শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক শামসুন্নাহার চাঁপা, স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রোকেয়া সুলতানা, উপপ্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, কার্যনির্বাহী সদস্য গোলাম রব্বানী চিনু, আনোয়ার হোসেন, ইকবাল হোসেন অপু, মেরিনা জাহান, ডাক্তার শাম্মি আহম্মেদ, মারুফা আক্তার পপি কুসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে জেতাতে কাজ করবেন।
এদিকে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একটি সূত্রে জানা যায়, আফজাল ও বাহারকে গণভবনে ডেকে বক্তব্য শুনবেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দলীয় প্রার্থীর জয়ী হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, নির্বাচনের আগেই কুমিল্লার দ্বন্দ্ব নিরসন হবে। নারায়ণগঞ্জে সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং শামীম ওসমানের মধ্যে বিরোধ ছিল। সেটা যেভাবে মীমাংসা হয়েছে কুমিল্লাতেও আফজাল খান ও বাহাউদ্দিন বাহারের মধ্যে বিরোধের অবসান হবে ও দলীয় প্রার্থী জয়ী হবে।
আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘যেখানে নৌকা সেখানেই আমি। তবে একজন সংসদ সদস্য হিসেবে আমি প্রচারণায় নামতে পারি না। এতে আচরণবিধি লঙ্ঘন হবে। তবে নৌকার বাইরে আমি ভিন্ন কিছু ভাবতে পারি না।’
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাফর উল্লাহ বলেন, 'অনেক প্রশ্নের উত্তর কুসিকে আওয়ামী লীগের বিজয়ের মধ্যে দিয়ে পাওয়া যাবে। বড় দলে মতানৈক্য থাকে। কিন্তু দলের প্রয়োজনে সব এলাকার হয়ে যায়। আওয়ামী লীগে এ রকম নজির অনেক। ইতিমধ্যে কুমিল্লায় সে পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে। বাকিটা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হবে।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা বলেন, ‘নৌকাকে বিজয়ী করার প্রশ্নে কুমিল্লার আওয়ামী লীগ নেতারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমার বিশ্বাস সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় নৌকার জয় হবে।’
আগামী ৩০ মার্চ কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের ভোটগ্রহণ করা হবে। নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য পাঁচজন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। তাঁরা হলেন- বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা, জাসদ মনোনীত প্রার্থী শিরিন আক্তার, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলের (পিডিপি) অ্যাডভোকেট সোয়েবুর রহমান, স্বতন্ত্র প্রার্থী অবসরপ্রাপ্ত মেজর মো. মামুনুর রশীদ। এদের মধ্যে ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় অবসরপ্রাপ্ত মেজর মামুনুর রশীদের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে।