মাশরাফি
ক্রিকেটের ধ্রুবতারা নিভছে...!
বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের মধ্যে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় তিনি। সম্ভবত বাঙালি ক্রিকেটারদের মধ্যে তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় আর একজনই আছেন। তিনি সম্ভবত বাঙালি ক্রিকেটের সৌরভ গাঙ্গুলী। পরিসংখ্যানে হয়তো অনেকের চেয়ে মাশরাফি পিছিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু দৃঢ়চেতা মনোভাব, ব্যক্তিত্ব আর সহজাত ক্রিকেটীয় মেধার সঙ্গে দারুণ নেতৃত্বগুণ অন্য আরো ১০ জন ক্রিকেটার থেকে আলাদা করে চিনিয়েছে মাশরাফিকে। ক্রিকেটে তাঁর মতো ইনজুরি জয় করা খেলোয়াড় আর একজন আছেন বলে ইতিহাস সাক্ষী দেয় না। বাংলাদেশের ক্রিকেটে তিনি ধ্রুবতারা!
আর ক্রিকেটে তাঁর আবির্ভাব ধূমকেতুর মতো। যখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে প্রয়োজন ছিল একজন বোলারের, ঠিক সেই সময়ে প্রতিভা আর পরিশ্রমের মিশ্রণে একটু ভিন্ন ধাতুতে গড়া এই তরুণের খোঁজ পেল এ দেশের ক্রিকেট। তিনি এখন বাংলাদেশের সফলতম পেস বোলারদের একজন। সফলতম অধিনায়ক। আক্রমণাত্মক, গতিময় বোলিং দিয়ে অনূর্ধ-১৯ দলে থাকতেই তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ সাবেক ফাস্ট বোলার অ্যান্ডি রবার্টসের নজর কেড়েছিলেন। যিনি কি না তখন দলটির অস্থায়ী বোলিং কোচের দয়িত্বে ছিলেন। রবার্টসের পরামর্শে মাশরাফিকে সরাসরি বাংলাদেশ ‘এ’ দলে নেওয়া হয়। সেই পথচলায় অনেক বাধা পেরিয়ে আজও খেলছে আমাদের ক্রিকেট ‘বস’।
একটু একটু করে বেড়ে ওঠা আমাদের আজকের মাশরাফি ‘ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাস্টিক’। জয় করেছে হাজারও ক্রিকেটপ্রেমীর মন। শুধু খেলা দিয়ে নয়, বিনয় আর লড়াকু মনোভাবের সঙ্গে সহজাত নেতৃত্বের গুণ তাঁকে আর দশটা ক্রিকেটার থেকে আলাদা করে রেখেছে। ইনজুরিতে পড়ে পায়ে অপারেশনের এখন আর কোনো জায়গা বাকি নেই! তবুও তিনি মাঠে ফিরেছেন ক্রিকেটকে ভালোবেসে। জীবন বাজি রেখে, দেশকে ভালোবেসে খেলে যাচ্ছেন ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম নির্ভীক এই ক্রিকেটার।
ক্রিকেটীয় মেধার বাইরে এই মানুষটার কাছে আরো অনেক মন্ত্র আছে! যার ছোঁয়ায় বশ করেছে কোটি জনতাকে। তাঁর বিনয়ী ভাবটা মুগ্ধ করে সবাইকে। বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা তো আছেই; সঙ্গে ভালোবাসা ও উদারতার এক উদাহরণও তিনি। এই তো কদিন আগে নিরপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে মাঠে ঢুকে পড়া এক ভক্তকে যেভাবে বুকে টেনে নিলেন, তা হৃদয় ছুঁয়ে গেছে হাজারও ক্রিকেটপ্রেমীর। পরে তো আবার নিরাপত্তাকর্মীদের হাত থেকে তাঁকে রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে গেলেন নিজেই।
মাশরাফির সবচেয়ে বড় শক্তি বোধ হয় দলের সবার কাছ থেকে সেরাটা বের করে নিয়ে আসা। জুনিয়রদের কাছে তাই সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা দলের ক্যাপ্টেন ‘মাশরাফি ভাই’ নিজেই। দলটাকে সাজিয়ে রেখেছেন তিনি নিজের ঘরের মতো! নেই কোনো ভেদাভেদ, নেই কোনো কোন্দল। আর যাই হোক, এর পেছনে মাশরাফির অবদানই সবচেয়ে বেশি। মাঠের আচরণ দেখলেই বোঝা যায়, কতটা আন্তরিক তিনি। একদিন তো মাশরাফিকে ছেড়ে যেতে হবে! অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী মাশরাফি বিন মুর্তজা কৌশিক কি আমরা আর একটা পাব?
শত প্রতিকূলতাকে জয় করে তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন সংশপ্তকের মতো। দেশসেরা এ পেসারের শুধু বল করলেই চলে না, দলের প্রয়োজনে ব্যাটও চালাতে হয়। টেস্ট ক্রিকেটে দেখা যায় না তাঁকে, এখন আর দেখা যাবে না ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত সংস্করণে! সাদা পোশাক তুলে রাখা হয়নি, ঘটা করে এবার রঙিন পোশাকের একটি তুলে রাখলেন। বাকি রইল আর একটি। এখন পর্যন্ত একদিনের ক্রিকেট খেলে যাবেন বলে প্রত্যাশা করলেও কতটুক পাবরেন তিনি? যেভাবে টি২০ ক্রিকেট ছাড়লেন, তাতে করে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার তেমন কিছু থাকছে না!
সেই যে ২০০১ সালে সাদা ক্যাপে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাত্রা শুরু, টি-২০ ক্রিকেটে অবসরের মাধ্যমে শেষের শুরুটা করে ফেললেন। এ দেশের ক্রিকেটে মাশরাফি বিন মুর্তজা কৌশিক একটি অধ্যায়। সেই অধ্যায়ের সমাপ্তির আর একটু পর্ব বাকি। একদিনের ক্রিকেটের রঙিন পোশাক তুলে রাখলেই শেষ! মাঠে সহজাত খেলার বাইরে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়ায় তাঁকে দেখা যায় না। তাঁরই ক্ষুরধার নেতৃত্বে বাংলাদেশে ক্রিকেট দল আজ বিশ্বেও অন্যতম ক্রিকেট পরাশক্তি। একটা দলকে কীভাবে বদলে দিতে হয়, এটা তিনিই সবচেয়ে ভালো জানে। ক্রিকেট পরাশক্তিতে পরিণত হওয়া এই মাশরাফির বাংলাদেশ এখন রীতিমতো গবেষণার বিষয়! আর মাশরাফি? সে তো আমাদের ক্রিকেটর ‘বস’! ম্যাশ, এ দেশে তুমি একজন শুধু একজন ক্রিকেটার নও। তুমি এক একটি স্বপ্নের সারথি!
লেখক : প্রতিনিধি, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়